কলিকাতা নামক একদা মহানগরটিকে অনেকে অনেক ভাবে দেখিয়াছেন। তাহাকে একটি সুবিশাল, উন্মুক্ত শৌচাগার বলিলে কোনও ভুল হয় না। অলিগলি বা অন্ধকার কোণ তো বটেই, রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে বহু জনের সম্মুখে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও নগরবাসীর বাধে না। দৃশ্যটি এমনই পরিচিত যে অনেকের চোখে তাহা অস্বাভাবিকও ঠেকে না। পুরসভার কর্তাদের চোখে তো নহেই। ফলে, কয়েক কদম দূরত্বে পুরসভার শৌচাগার থাকিলেও নগরবাসী দেওয়াল ছাড়িয়া নড়িতে নারাজ। কেন, জিজ্ঞাসা করিলে একটি উত্তর ফিরিয়া ফিরিয়া আসে: আর পাঁচ জন করিতেছে দেখিয়া আমিও দাঁড়াইয়া পড়িলাম। অর্থাৎ, পাঁচ জনে করে যাহা, আমিও তাহাই করিলে আলাদা করিয়া লজ্জা পাওয়ার, বা অপরাধবোধে ভুগিবার নাই। সঙ্ঘবদ্ধ হইবার গুণ অনেক।
পুরসভার দৃশ্যতই তাহাতে বিশেষ আপত্তি নাই। কিন্তু, অপরের দেহনিঃসৃত তরলে সিক্ত শহরে বাস করিতে কিছু কলিকাতাবাসীর আপত্তি থাকিতে পারে। এই প্রবণতা ঠেকাইবার কিছু প্রচলিত এবং অপ্রচলিত পথ আছে। ধরিয়া জরিমানা করা তেমনই একটি পথ। অবশ্য, পুলিশ-প্রশাসনের অবস্থা দেখিয়া এই পথে বেশি হাঁটিবার পরামর্শ দিতে সাহসের প্রয়োজন। দ্বিতীয় পন্থাটি, আচরণগত অর্থনীতির তত্ত্বের ভাষায়, ‘নাজ’ করা, অর্থাৎ, মানুষকে, তাহার অবচেতনেই, ফুটপাথ হইতে শৌচাগারের দিকে ঠেলিয়া দেওয়া। যেমন, নিকটবর্তী শৌচাগারটি কোন দিকে, কত দূরে, তাহা যদি দেওয়ালে স্পষ্ট লিখিয়া দেওয়া থাকে, রাস্তায় যদি সেই মর্মে সাইনবোর্ড থাকে, তবে অনেককেই হয়তো সেই শৌচাগার অবধি পৌঁছাইয়া দেওয়া যাইবে। অন্তত, অনেক শহরে তাহা সম্ভব হইয়াছে। দেওয়ালে উচ্চ তরল-প্রতিফলন ক্ষমতাসম্পন্ন রঙ লাগানোও আর একটি পন্থা। তাহাতে পড়িলে যে কোনও তরল পদার্থ প্রতিচালিত হইয়া তাহার মালিকের দেহে লাগে। মোট কথা, প্রকাশ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রবণতাটি ঠেকাইতে প্রকৃতির ভরসায় থাকিলে চলিবে না। তাহার জন্য একটু নড়িয়া বসিতে হইবে। অবশ্য, কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, ফুটপাথে যদি হকারদের অধিকার সিদ্ধ হয়, দেওয়ালের উপর নাগরিকেরই বা অধিকার থাকিবে না কেন? তাঁহাদের কি ভোট নাই? পুরসভা এই প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিবে বলিয়া সন্দেহ হয় না।
আরও একটি প্রশ্ন পুরসভার মুখ চাহিয়া থাকিবে। দেওয়ালকে নিষ্কৃতি দিয়া কলিকাতাবাসী যদি সত্যই সুলভ শৌচাগারের পথ ধরেন, সেখানে কোন দৃশ্য তাঁহাদের অপেক্ষায় থাকিবে? জল-থইথই মেঝে, জমিয়া থাকা ময়লা, এবং সুতীব্র দুর্গন্ধ ভিন্ন আর কিছু প্রত্যাশা করা সম্ভব কি? বাস্তব অভিজ্ঞতা বলিবে, না। পুরসভা এই শৌচাগারগুলিকে ভুলিয়া থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা দুর্বল, নজরদারি নাই। ফলে, যাহা হইবার, তাহাই হইয়াছে। পথে সুলভ শৌচাগার পড়িলে নাকে কাপড় চাপিয়া যত দ্রুত সম্ভব জায়গাটি পার হইয়া দেওয়াল বাছিয়া লওয়াই কলিকাতাবাসীর অভ্যাস হইয়াছে। অতএব, নিকটেই শৌচাগার থাকিলেও মানুষ তাহা ব্যবহার করেন না এই সমস্যা জোগানের, না চাহিদার, সে রহস্য ভেদ করা দুষ্কর। শৌচাগার ব্যবহারের চাহিদা বাড়াইবার জন্য যাহা করণীয়, করিতে হইবে। কিন্তু, শৌচাগার পরিচ্ছন্ন রাখিবার প্রাথমিক দায়িত্বটি পুরসভা পালন করুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy