Advertisement
E-Paper

জাপানের সঙ্গে সখ্য মানেই চিনের সঙ্গে শত্রুতা নয়

নরেন্দ্র মোদী চিনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাইছেন না। এই সংঘাতের পথে যাওয়াটা তো হবে এক চরম মুর্খামি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালআমেরিকার বাসিন্দা, সাংবাদিক এডগার স্নো, মাত্র বাইশ বছর বয়সে সুদূর প্রাচ্যে এসেছিলেন। একটানা সাত বছর থেকে চিনকেই নিজের দেশ করে তোলেন। তিনি ইয়েনচিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বেজিংয়ের হিমেল পরিবেশে দাঁড়িয়ে বিদেশি বন্ধু এই স্নোকে বিদায় জানানোর সময় মাও জে দং তাঁকে বলেছিলেন, আকাশে ঝড় আর দুযোর্গের তুফান উঠেছে, কোন দিকে যে তার গতি, বলা যাচ্ছে না।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এএফপি।

চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এএফপি।

আমেরিকার বাসিন্দা, সাংবাদিক এডগার স্নো, মাত্র বাইশ বছর বয়সে সুদূর প্রাচ্যে এসেছিলেন। একটানা সাত বছর থেকে চিনকেই নিজের দেশ করে তোলেন। তিনি ইয়েনচিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বেজিংয়ের হিমেল পরিবেশে দাঁড়িয়ে বিদেশি বন্ধু এই স্নোকে বিদায় জানানোর সময় মাও জে দং তাঁকে বলেছিলেন, আকাশে ঝড় আর দুযোর্গের তুফান উঠেছে, কোন দিকে যে তার গতি, বলা যাচ্ছে না।

উত্তর ষাটে আন্তর্জাতিক ভারসাম্যের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এল, তাতে চিনে যে কত পরিবর্তন হল তা আজ সকলেরই জানা। চিন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ১৯৪৯ থেকে ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতার চরিত্র কী তা নিয়ে অনেক সমালোচনা, অনেক বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিনের ড্রাগনের নিঃশ্বাস শুধু এশিয়া নয়, মার্কিন মুলুকেও কতটা এসে পড়েছে, তা-ও তো সবাই দেখছি।

এ অবস্থায় চিনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক চাইছেন? জাপানে গিয়ে মোদী এক অসাধারণ সখ্য গড়ে তুলেছেন, চিনের প্রসারবাদী মনোভাব সম্পর্কে পরোক্ষ মন্তব্য করে বিতর্কের ঝড় তোলেন। তখন অনেকে ভেবেছিলেন, জাপান ও চিনের সংঘাতের ঐতিহাসিক আবহে এই মন্তব্য সুপরিকল্পিত। তবে কি মোদীর সরকার চিন বিরোধী আক্রমণাত্মক লাইন নিতে চাইছে?

তখন সেটা মনে হলেও এখন মোদীর জন্মদিনে চিনের প্রেসিডেন্টের ভারত আগমন, তাঁর জন্য সবরমতী নদীতীরে যে ভাবে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করা হচ্ছে তাতে এটাও স্পষ্ট, ভারত কিন্তু চিনের সঙ্গে কোনও ভাবেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতেও চাইছে না। জাপান ও ভারত সুসম্পর্কের ঝোড়ো হাওয়ায় কূটনীতিতেও অনেক স্তর আছে। ভারতের পরমাণু চুক্তির সিদ্ধান্তকে এখনও মানতে প্রস্তুত নয় জাপান। এটা সার্বভৌম জাপানের পরমাণু বিরোধী চিরায়ত অবস্থান। আবার জাপান চাইছে ‘কোঅপারেশন ফর পিস কনসার্ন’ নামের এক নতুন রাষ্ট্রগোষ্ঠী গড়ে তুলতে। তাতে চিন থাকবে না। ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিনস, এমনকী, রাশিয়া এই গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারে। তার আগে জাপানের বিদেশমন্ত্রী ও বিদেশ সচিবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই সব দেশের বিদেশমন্ত্রী ও বিদেশ সচিবদের আলোচনার আবহ তৈরি করতে চাইছে জাপান। বস্তুত, এই কাঠামো গড়ে তুলতে জাপান সক্রিয় হচ্ছে। একে বলা হয় ২+২ কাঠামো।

কিন্তু এই গোষ্ঠীতে সামিল হয়ে চিনকে চটাতেও ভারত রাজি নয়। জাপানের কাছ থেকে ৫ বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলার প্রাপ্তি সম্ভাবনার চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এটাও ভারত জানে, চিনের সঙ্গে এত বছরের যুদ্ধের ইতিহাস হলেও চিনে জাপানের বিনিয়োগ ভারতের চেয়ে শতকরা ৩৫ ভাগ বেশি। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আ্যসোসিয়েট প্রফেসর শ্রাবণী রায়চৌধুরী বলেন, আসলে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ দিন ‘একলা চলো রে’ কূটনীতি চালিয়েছিল। তাতে কিন্তু দেখা গেল ওদের লোকসানই হয়েছে। গোটা পৃথিবী যখন আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্যে এক অভিন্ন বাজার অর্থনীতির পথে হাঁটছে তখন একা একা সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা সফল কূটনীতি আনতে পারে না। আবার ভারত ওটাও চাইছে যে, অতীতের যে জোট নিরপেক্ষ কূটনীতির ট্র্যাডিশন সেটাকেও রক্ষা করা প্রয়োজন। জাপান ও চিনের সংঘাতের ক্ষেত্রে ভারত একটি দেশের পক্ষ নেবে কেন? তার মানে কিন্তু আবার এমন নয় যে তিব্বতের রাজনীতি ভুলে অখণ্ড চিনের রাজনীতির কথা ভারত মেনে নেবে, সে ক্ষেত্রে ভারতের পাল্টা শর্ত, অরুণাচল প্রদেশকেও অখণ্ড ভারতের অঙ্গ হিসাবে চিনকে মেনে নিতে হবে। চিন যেমন মাঝে মাঝেই অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে ঝামেলা করে, তেমনই ভারতও নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ভবনে তিব্বতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানায়। দলাই লামার প্রসঙ্গ না হয় ছেড়েই দিলাম। তবে এ বার চিনা প্রেসিডেন্টের সফরের সময় দলাই লামাকে দিল্লিতে আসতে বা কোনও কর্মসূচি গ্রহণে মানা করা হয়েছে, কারণ তাতে তিক্ততা বাড়ে। আর ঠিক এমনটাই দলাই লামা করেছিলেন মনমোহন সিংহের আমলে।


জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে মোদী। ছবি: এপি।

আসলে চিন বন্ধু না শত্রু? এই প্রশ্নের এক কথায় কোনও জবাব বের করে নিয়ে তার ভিত্তিতে সম্পর্ক রচনা, হয় প্রেম না হয় যুদ্ধ, মনে হয় আজকের কূটনীতি ঠিক এতটা সরল নয়। বরং তা বহুস্তরীয় ও জটিল। অরুণ শৌরির মতো লেখকরা বলেন, ভারত হাত বাড়ালেও চিন কখনওই বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়নি। তিনি বার বার এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে শক্তিধর চিন রাষ্ট্র কখনওই বিশ্বাসযোগ্য নয়। নেহরুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত চিন ভারতের সঙ্গে শত্রুতাই করে এসেছে। এমনই মনোভাব আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী চিনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাইছেন না। এই সংঘাতের পথে যাওয়াটা তো হবে এক চরম মুর্খামি। সেটা নরেন্দ্র মোদীর ‘আর্ট অফ ওয়ার’ হতেও পারে না।

ভৌগোলিক ভাবে এত কাছে থেকেও চিন ও ভারত এক জন আর এক জনের কাছ থেকে কত দূর! গত আড়াই হাজার বছর ধরে দু’দেশের মধ্যে যে ভাবের বিনিময় হয়েছে তাও কিন্তু এক বিস্ময়কর ঘটনা। কত মানুষ সে দেশ থেকে ভারতে এসেছেন, কত জন আবার ভারত থেকে চিনে গিয়েছেন। সম্প্রতি লেখক শংকর ১৯০২ সালের বাঙালি লেখক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন যাত্রী পুনঃপ্রকাশ করে শতবর্ষ আগের ভ্রমণ কথায় ভারতীয়দের চিন-চর্চার কথা বলেছেন। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের কথাও এখানে আলোচনার বাইরে আনা যাবে না। নরেন্দ্র মোদী দু’দেশের এই প্রাচীন সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও সাযুজ্যের দিকটির দিকেও গুরুত্ব দিতে চান।

তাই এটা বোঝা যাচ্ছে, মোদী সরকার চিনের সঙ্গে রাজনৈতিক দর কষাকষির পরিসরটুকু রক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু শত্রুতা?

নৈব নৈব চ!

jayanta ghosal shahi sahi japan china modi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy