Advertisement
E-Paper

জোর দিতে হবে মানবসম্পদের উন্নয়নে

মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং মানব উন্নয়নের দ্বৈত লক্ষ্য পূর্ণ হলে বিনিয়োগ ও ভোগব্যয় বাড়বে, অন্য দিকে মানবসম্পদের প্রসার ঘটবে। বাজেটে এই প্রত্যাশা মিটবে কি?ভারতীয় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণগুলি স্পষ্ট। এমনকী ২০১১-১২’কে ভিত্তিবর্ষ ধরে নতুন হিসেব কষে দেখা গেছে, বর্তমান আর্থিক বছরে, অর্থাত্‌ ২০১৪-১৫ সালে প্রকৃত জিডিপি বাড়ছে ৭.৪ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির হারও কমেছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনও অবকাশ নেই। মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণে রেখে কী ভাবে আয়বৃদ্ধির গতি বাড়ানো যায়, ২০১৫-১৬’র বাজেটে সেটাই হবে অর্থমন্ত্রীর প্রধান চ্যালেঞ্জ। তার সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা বিষয়ে নজর দিতে হবে। সেটা হল মানব উন্নয়ন।

চন্দ্রজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৩

ভারতীয় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণগুলি স্পষ্ট। এমনকী ২০১১-১২’কে ভিত্তিবর্ষ ধরে নতুন হিসেব কষে দেখা গেছে, বর্তমান আর্থিক বছরে, অর্থাত্‌ ২০১৪-১৫ সালে প্রকৃত জিডিপি বাড়ছে ৭.৪ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির হারও কমেছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনও অবকাশ নেই। মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণে রেখে কী ভাবে আয়বৃদ্ধির গতি বাড়ানো যায়, ২০১৫-১৬’র বাজেটে সেটাই হবে অর্থমন্ত্রীর প্রধান চ্যালেঞ্জ। তার সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা বিষয়ে নজর দিতে হবে। সেটা হল মানব উন্নয়ন। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো যে বিষয়গুলিকে মানব উন্নয়ন সূচক নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়, সেগুলিকে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করেছেন, যেমন স্বচ্ছ ভারত অভিযান, গঙ্গা সাফাই মিশন বা একশো স্মার্ট সিটি নির্মাণ। বাজেটে সেগুলিও গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এই প্রকল্পগুলি সুষ্ঠু নগরায়ণের গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ। তার পাশাপাশি দরকার জনপরিবহণের উন্নতি, কম খরচে আবাসনের বন্দোবস্ত, নাগরিক পরিকাঠামোর উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার ইত্যাদিও। এই সব উদ্যোগের ব্যয় সংস্থানের জন্য ‘স্পেশাল পারপাস ভেহিক্ল’ (এসপিভি) নামক বিশেষ তহবিলের সাহায্য নেওয়া যায়; দিল্লি মুম্বই শিল্প করিডরের ক্ষেত্রে সেটাই করা হয়েছে।

মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারি আয়ব্যয়ের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সরকার এই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে যে, ২০১৫-১৬ সালে রাজকোষ ঘাটতি (কার্যত নেট সরকারি ঋণ) জিডিপি’র ৩.৬ শতাংশে বেঁধে রাখা হবে, ২০১৬-১৭’য় সেই অনুপাত নামিয়ে আনা হবে ৩ শতাংশে। এই লক্ষ্য পূরণ করা আবশ্যক। একই সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের কাঠামো এমন ভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে আয়বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান উত্‌সাহিত হয় এবং অপচয় কম হয়।

ভর্তুকির যথাযথ ব্যবহার দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার ফলে এখন সরকারের সুযোগ আছে, যাতে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা পরিবারগুলিকে প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং জ্বালানি ভর্তুকি দিয়ে সস্তায় দেওয়া যায়। এই সুযোগে জ্বালানির জন্য একটা তহবিল তৈরি করা যায়, যা দিয়ে ভবিষ্যতে তেলের দামের অস্বাভাবিক উত্থানপতন থেকে উপভোক্তাদের বাঁচানো যাবে। প্রসঙ্গত, কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও এমন একটা তহবিল তৈরি করা যায় এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে খাদ্যপণ্যের চলাচল অবাধ করে তোলা যায়। সেচে বাড়তি বিনিয়োগ তো আবশ্যক বটেই। সারের জন্য প্রদত্ত ভর্তুকির ক্ষেত্রেও সংস্কারের প্রয়োজন আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলি মূল্যবান।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। তাদের অনেকগুলিই লোকসানে চলছে। লোকসানে চলা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ অথবা কাঠামো সংস্কারের একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা জরুরি, তার সঙ্গে সঙ্গে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে সেই সম্পদ পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা দরকার। বিশেষত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সরকারের মালিকানা ৫১ শতাংশে নামিয়ে এনে ব্যাঙ্কের পুঁজি বাড়ানো জরুরি।

এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে নির্ধারিত প্রকল্পগুলির খরচ সরকারি বাজেটের বাইরে রাখা যাবে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলি থেকে অর্থের সংস্থানেও সুবিধে হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রকল্প রূপায়ণের ফলে সেগুলি ঠিক সময়ে শেষ করার সম্ভাবনা বাড়বে।

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কর্মসংস্থান খুবই আবশ্যক। ২০১১-১২ সালের হিসেবে, মোট ৪৭ কোটি ৩০ লক্ষ কর্মীর মধ্যে মাত্র ৩ কোটি সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন। গত পাঁচ বছরে বেসরকারি উদ্যোগে ২ কোটির বেশি নতুন কাজের সংস্থান হয়েছে, এ বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগকে আরও বেশি উত্‌সাহ দেওয়া দরকার।

শ্রম আইনে নমনীয়তা চাই, শ্রমিকের সংখ্যা যেমন প্রয়োজন মাফিক বাড়ানো ও কমানোর স্বাধীনতা দরকার, তেমনই অন্য দিকে উদ্বৃত্ত কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আয়োজন জরুরি, পাশাপাশি সাময়িক কাজের নির্দিষ্ট মেয়াদ স্থির করা এবং ঠিকা শ্রমিকের নিয়োগ ব্যবস্থার সরলীকরণ আবশ্যক। শ্রম আইন সংস্কার জরুরি, তবে সময়সাপেক্ষ। সরকার কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য কোম্পানি আয়করের কাঠামোয় ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে, কর্মসংস্থানের মাত্রার উপর সেই সুবিধে নির্ভর করব।

শিক্ষা, দক্ষতা সৃষ্টি, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো মানব উন্নয়ন সূচকগুলিতে ভারত রীতিমত পিছিয়ে আছে। ২০১৫ সালের জন্য যে ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রাগুলি নির্ধারিত হয়েছিল, ভারতে তার অনেকগুলিতেই পিছিয়ে আছে, যেমন শিশুমৃত্যুর হার বা সাফাই ব্যবস্থার প্রসার। এ বিষয়ে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা দরকার। তিন বছরের মধ্যে শিক্ষা খাতে মোট সরকারি ব্যয় জিডিপি’র ৬ শতাংশে পৌঁছনো দরকার, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপি’র ৩ শতাংশে। দারিদ্র রেখার নীচে থাকা পরিবারগুলির জন্য শিক্ষা ভাউচার প্রবর্তন করা যায়, এর ফলে স্কুলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং শিক্ষা অর্জনে উন্নতি ঘটবে। দক্ষতা বাড়ানোর কাজে বেসরকারি সংস্থাকে উত্‌সাহ দেওয়ার জন্য পরিষেবা কর এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড়ের বন্দোবস্ত করা যায়— যে সব সংস্থা কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ করবে, তারা এই ছাড় পাবে। মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার বরাদ্দ অর্থের একাংশ এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়।

মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং মানব উন্নয়নের দ্বৈত লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে এক দিকে বিনিয়োগ এবং ভোগব্যয় বাড়বে, অন্য দিকে মানবসম্পদের প্রসার ঘটবে। দুইয়ে মিলে আয়বৃদ্ধি উত্‌সাহিত হবে এবং তার ফলে মানুষের উন্নতির আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হবে। এই কর্মকাণ্ডে ভারতীয় শিল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল

chandrajit bandyopadhyay post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy