Advertisement
E-Paper

জনমত উপেক্ষা করে তেতো দাওয়াই দেওয়া কঠিন

শিল্পপতিদের জন্য যতই সহানুভূতি থাক, কোথাও নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিদেরও বলতে হয়, মুকেশ অম্বানিদের জন্য নয়— আমরা আমজনতার সেবক! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালশিল্পপতিদের জন্য যতই সহানুভূতি থাক, কোথাও নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিদেরও বলতে হয়, মুকেশ অম্বানিদের জন্য নয়— আমরা আমজনতার সেবক! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০৩

ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের শহিদ জুলিয়াস ফুচিক। ১৯০৩ সালে প্রাগের এক শ্রমিক পরিবারে জুলিয়াসের জন্ম হয়েছিল। বাবা ছিলেন ইস্পাত কারখানার শ্রমিক। অভিনয়ের শখ ছিল জুলিয়াসের। সঙ্গীতের এক বিখ্যাত কম্পোজার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু নিরুপদ্রব খ্যাতির জীবন ছেড়ে কমিউনিস্ট হয়ে ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান তিনি। পরে চেক সরকার তাঁকে জেলে পোরে। ১৯৪৩ সালে তাঁকে বার্লিনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হয় তাঁর।

এ হেন ফুচিকের একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ হল লেনিনের হাসি। সেই প্রবন্ধে ফুচিক লিখেছিলেন, লেনিন ক্ষমতায় আসার পর ভাণ্ডারলিপ নামে এক বিশিষ্ট শিল্পপতি লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তখন সবে বলশেভিক বিপ্লব করে লেনিন ক্ষমতায় এসেছেন। একে বিশ্বযুদ্ধ তার উপরে গৃহযুদ্ধের ফলে মস্কো তখন জেরবার। খাদ্য নেই, কারখানাগুলি বসে গিয়েছে, ক্ষেতে বীজ বপন হয়নি। পশ্চিমের শিল্পপতিরা ধরে নিয়েছিলেন, অক্টোবর বিপ্লবের দায় এখন তাঁদের কিনে নিতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পুঁজিবাদ। সোভিয়েত দেশের এক প্রতিভাময়ী লেখিকা ছিলেন লারিসা রাইসনা। ধনকুবের ভান্ডারলিপের সঙ্গে লেনিনের সাক্ষাৎকার নিয়ে লারিসা একটি চমৎকার নিবন্ধ লেখেন। তার ভিত্তিতে জুলিয়াসের রম্য রচনা।

লেনিন ও ভান্ডারলিপের কী কথা হয়েছিল তা জুলিয়াস জানতেন না। কিন্তু এটি জানতেন, ওই পশ্চিমি শিল্পপতি লেনিনকে বলেছিলেন, রাশিয়ার এখনকার সমস্ত ক্ষুধা আমি কিনে নিতে চাই। আপনি বলুন, আপনার কত টাকা প্রয়োজন? জুলিয়াসের ভাষায়, কত চাই আপনার মৃতপ্রায় শিশুদের জন্য? যন্ত্রপাতিবিহীন ক্ষেত-খামারের জন্য? ভেঙে পড়া বাড়িগুলির জন্য? বালি আর বরফ চাপা রাস্তাঘাটের জন্য? জাহান্নমে যাওয়া বিপ্লবের দগদগে ক্ষতগুলির জন্য? জবাবে লেনিন কোনও কথা বলেননি। শুধু হেসে উঠেছিলেন। জুলিয়াস ফুচিক বলেছেন, পরবর্তী কালে ওই হাসির অর্থ বোঝা গিয়েছিল। ভান্ডারলিপের পুঁজি দিয়ে তিনি মস্কোয় শিল্পায়ন করেননি। কিন্তু জলবিদ্যুৎ থেকে অন্যান্য ভারী শিল্প— এক নয়া আর্থিক নীতি কিন্তু লেনিন বাস্তবায়িত করেছিলেন। যে উন্নয়নের প্রশংসা রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন।

ধান ভানতে আজ শিবের গীত গাইছি। সেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। সেই প্রাচীন সমাজতন্ত্রও নেই। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার প্রায় ৭০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে যখন নরেন্দ্র মোদীর মতো এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হন, ত্রিশ বছরে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় একদলীয় বিজেপি শাসন, তখনও কিন্তু অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বাজেটে ধ্বনিত হয় গরিব মানুষের কথা। কোনও কোনও মহল থেকে বরং অভিযোগ ওঠে, তেতো ওষুধ না দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার রাস্তাতেই কেন হাঁটলেন অরুণ জেটলি? এ কি নির্বাচনী রাজনীতির চক্রব্যূহ? তথাকথিত নেহরুবাদী সমাজতন্ত্র কি ভারতের রাজনীতির সংস্কৃতিতে শিকড় গেড়েছে? আর তাই জগদীশ ভগবতী থেকে অরবিন্দ পানাগড়িয়া যতই আওয়াজ তুলুন যে ভর্তুকি সংস্কৃতি বন্ধ কর, সামাজিক প্রকল্পের নামে সনিয়া গাঁধীর আম-জনতার রাজনীতিকে প্রকাশ্যে বাতিল কর, উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের বৃদ্ধির উন্নতি ঘটাও, তাতেই মানুষের উন্নতি, তাতেই কর্মসংস্থান আর তা থেকেই আসবে সাম্য।

নরেন্দ্র মোদীর সরকার অন্তত বাজেটে সেই কঠোর সংস্কারবাদী পথের বিজয় কেতন ওড়ানোর চেষ্টা করেননি। দক্ষিণপন্থী পুঁজিবাদী দর্শনের প্রতিভূ হতে কি লজ্জাবোধ আছে? মার্কিনি রিপাবলিকান পার্টি বা লন্ডনের টোরি পার্টির দোসর বললে কি এ দেশের কেজরীবাল মার্কা রাজনীতির উপভোক্তাদের উপর আঘাত লাগে? আর সেই কারণে শিল্পপতিদের জন্য যতই সহানুভূতি থাক না কেন কোথাও নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিদেরও বলতে হয়, মুকেশ অম্বানি বা আদানীর জন্য নয়— আমরা আমজনতার সেবক!

সংসদ ভবন। বাজেট পেশের আগের মুহূর্ত। জুলাই, ২০১৪।

লেনিনের হাসির মধ্যে একটি শক্তিশালী মতাদর্শ ছিল। ঠাণ্ডা যুদ্ধের আগে পর্যন্ত গোটা পৃথিবী পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্র, দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। তখন মার্কিন পুঁজির সোভিয়েত ইউনিয়নে বিনিয়োগ ছিল এক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্পৃশ্যতা। পরে দেং জিয়াও পিং বললেন, পুঁজির কোনও রং হয় না। বিড়ালের রং দেখার অর্থ হয় না। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়াল ইঁদুর মারতে পারে কি না। তত দিনে এই যুদ্ধের অবসানের পর পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে অনেক অভিযোজন হয়েছে। সমাজতন্ত্র এখন খোলা বাজারের অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছে। আর পশ্চিমি পুঁজিবাদ এখন সমাজতন্ত্রের সাম্য ও ন্যায্যতাকে গ্রহণ করেছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে এখন তাই মিশ্র অর্থনীতি। ভারতে ’৯১ সালে নরসিংহ রাওয়ের বিপ্লবের পরেও অর্থনীতির পথটি হল— খোলাবাজারের অর্থনীতি ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় নীতির মিলন। ইউরোপেও এই ধারাটিই জয়ী হয়েছে।

যাঁরা বলেন, স্বাধীনতার পর ভারতের অর্থনীতির কোনও উন্নতি হয়নি, কেবল এক সঙ্কট থেকে অন্য সঙ্কটে গড়িয়ে গিয়েছে তা কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। ১৯৫০ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত এই ৪০ বছরে কৃষি উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। শিল্প উৎপাদনও বেড়েছে ১০ গুণ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। প্রত্যাশিত আয়ু বেড়েছে। আবার এটাও সত্য, বাজার নির্ভর অর্থনীতি না সমাজতন্ত্র— ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো আমাদের মনোভাব ক্রমাগত দুলেছে। সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ টমাস কেটির ক্যাপিটাল নামে একটি বই লিখেছেন। ১৮৬৭ সালে কার্ল মার্কস ক্যাপিটাল লিখেছিলেন। টমাসের বইটির বিষয় হল: এক পক্ষের বক্তব্য, মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে, সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্য দূর হলে তা হলেই বৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু আর একটি মতবাদ হল, যত দিন মেধার উৎকর্ষ থাকবে তত দিন অসাম্য ঘুচবে না। তবে প্রতিটি নাগরিককে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় বা প্রতিযোগিতায় লড়ার সুযোগ করে দিতে পারলে এই অসাম্য অনেকটাই কমবে।

সুতরাং, মোদীর বাজেট শেষে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে যে যতই আমরা কঠোর সংস্কার বা মার্গারেট থ্যাচারের মতো কঠিন সংস্কারের ইঞ্জিন চালাই না কেন, এক দিকে ফ্লাইওভারের নীচে থাকা মানুষ, অন্য দিকে মুকেশ অম্বানীর মতো ব্যবসায়ী— দু’পক্ষের শ্রীবৃদ্ধি করাই সরকারের কর্তব্য। কারও সঙ্গে কারও সংঘাতের পরিবর্তে দু’পক্ষই একে অন্যের পরিপূরক। বাস্তবে অবশ্য তা করতে গিয়ে অর্থনীতির সেই শ্রেণি সংঘাত ও শ্রেণি সমন্বয়ের সাবেক বিতর্ক থেকেই গিয়েছে। এখনও মোদীর মতো প্রশাসককেও বাজেট করতে গেলে শ্যাম ও কুল, দু’তরফে নজর রেখে এগোতে হয়। উপর থেকে তেতো দাওয়াই দেওয়ার সুপারিশ করা যতটা সোজা, তলা থেকে জনমতের চাপ উপেক্ষা করা কোনও ভারতীয় রাজনেতার পক্ষেই বোধহয় সম্ভব নয়!

shahi samachar jayanta ghosal narendra modi julius fuchik public opinion union budget budget 2014
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy