Advertisement
E-Paper

ডব্লুটিও ভেঙে গেলে কিন্তু ভারতের ক্ষতি

ভারত জানিয়েছে, খাদ্য সুরক্ষার জন্য ভর্তুকি মেনে না নিলে ডব্লুটিও’র চুক্তিতে সই করবে না। কঠোর হওয়ার কারণ আছে, যুক্তিও। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকা নতুন করে জোট বাঁধছে, তাই ডব্লুটিও-র থাকা দরকার। সাহানা ঘোষভারত জানিয়েছে, খাদ্য সুরক্ষার জন্য ভর্তুকি মেনে না নিলে ডব্লুটিও’র চুক্তিতে সই করবে না। কঠোর হওয়ার কারণ আছে, যুক্তিও। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকা নতুন করে জোট বাঁধছে, তাই ডব্লুটিও-র থাকা দরকার।

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫

বিজেপি সরকারের কাছে বিশ্ববাজারের অনেক আশা। নতুন সরকার ব্যবসা-বন্ধু, অতএব ভারতে বাজার অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেবে, এ তো ধরেই নেওয়া যায়। এ হেন সরকার কিনা বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের (ডব্লুটিও) অগ্রগতি রুখে দিল! তা-ও আবার এমন এক বিষয় নিয়ে খাদ্য সুরক্ষা, যা কিনা সরাসরি বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত নয়।

এ মাসের গোড়া থেকে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে গেল গেল রব উঠেছে। গত ডিসেম্বরে বালিতে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিবর্গের অধিবেশনে অন্যতম আলোচ্য ছিল বাণিজ্য সরলীকরণ (ট্রেড ফেসিলিটেশন) চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী স্থির হয়, ডব্লুটিও-র ১৬০টি দেশ বাণিজ্য সংক্রান্ত নিয়মকানুন সরল আর সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে। আপাতদৃষ্টিতে এই চুক্তি খুব নিরীহ এবং তা সব দেশের পক্ষেই মঙ্গলকর। ভারতের পক্ষেও। এর ফলে আমদানি রফতানি উৎসাহিত হবে, অর্থনীতির অগ্রগতি হবে, চাকরির সুযোগ বাড়বে। তা হলে কেন শেষ মুহূর্তে ভারত চুক্তি সই করতে নারাজ হল? ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সব দেশের বালি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা ছিল। ডব্লুটিও-র নিয়ম হল, প্রত্যেক সদস্য দেশ সই না করলে কোনও চুক্তিই কার্যকর হবে না। তাই ভারত বেঁকে বসায় চুক্তি এখন খারিজ হওয়ার পথে। ফলে, বিশ্ব বাণিজ্যের দরবারে ভারত এখন খলনায়ক।

এমন নয় যে, ভারত মুক্ত বাণিজ্য চায় না। বরং পশ্চিম দুনিয়ার বাণিজ্যের দুয়ার, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি এবং অন্যান্য পরিষেবার ক্ষেত্রে, আরও খোলা হচ্ছে না বলে ভারত বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হিসেব করা হয়েছে, বাণিজ্য সরলীকরণ চুক্তির ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যোগ হবে এক লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার, দু’কোটি দশ লক্ষ বাড়তি কর্মসংস্থান হবে, যার মধ্যে এক কোটি আশি লক্ষই উন্নয়নশীল দুনিয়ায়। অবশ্য এর কোনও হিসেবই নিশ্চিত নয়, তর্কাতীতও নয়। এবং এই সরলীকরণের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া, এ থেকে ভারতের ঠিক কতটা সুবিধে হবে, সেটাও স্পষ্ট নয়। বিশ্ববাজারে ভারতের শিল্পজাত পণ্যের রফতানির অনুপাত এখনও খুব কম। শেষ বিচারে সরলীকরণের ফলে সুবিধেটা প্রধানত উন্নত দেশগুলিরই।

ডব্লুটিও-র বালি অধিবেশনে ভারতের তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী আনন্দ শর্মা চুক্তি সই করতে রাজি হয়েছিলেন, কেবল শর্ত ছিল, খাদ্য সুরক্ষার জন্য প্রদত্ত ভর্তুকির প্রশ্নে ডব্লুটিও ২০১৭ সালের মধ্যে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থায় পৌঁছবে। এখনও পর্যন্ত ডব্লুটিও’তে আছে শান্তি অনুচ্ছেদ (পিস ক্লজ), যার কল্যাণে কোনও দেশের খাদ্য সুরক্ষা বাবদ প্রদত্ত ভর্তুকির জন্য অন্য দেশ তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে না। বালিতে এই অনুচ্ছেদ ২০১৭ পর্যন্ত বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভারত এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ চায়, এই অনুচ্ছেদ পাকাপাকি ভাবে বহাল করা হোক, অর্থাৎ স্থির করা হোক যে, খাদ্য সুরক্ষা হবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, অর্থাৎ ডব্লুটিও’র আওতার বাইরে।

বালি চুক্তি সই করার সময়সীমার শেষ প্রান্তে এসে নতুন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন যে, ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। এখন ভারতের দাবি, খাদ্য সুরক্ষা ভর্তুকির ব্যাপারটা ২০১৭ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা চলবে না, বাণিজ্য সরলীকরণ এবং খাদ্য সুরক্ষা ভর্তুকির প্রশ্ন দুটির একই সঙ্গে মীমাংসা করতে হবে। ডব্লুটিও’র পরের অধিবেশন ডিসেম্বরে। ভারতের অনুমান, তার মধ্যে অন্য সদস্যরা এই দাবিতে একমত হবে। যদিও কিউবা, ভেনেজুয়েলা এবং বলিভিয়া ছাড়া এখনও কেউ ভারতের পাশে নেই। এমনকী রাশিয়া, চিন, ব্রাজিল ব্রিক্স-এর অন্য সদস্যরাও এখনও এই প্রশ্নে মুখ খোলেনি।

কৃষি ভর্তুকি ডব্লুটিও’তে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়। এখন যে নিয়ম চালু আছে, তাতে কোনও দেশের সরকার খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য উৎপাদনের মোট মূল্যের দশ শতাংশের বেশি ভর্তুকি দিতে পারে না। ভারত সরকারের খাদ্যশস্য মজুত যে হারে চলছে, তাতে ভর্তুকি এই বিপদসীমার কাছে পৌঁছে গেছে। খাদ্য নিরাপত্তার নতুন আইন বলবৎ হওয়ার ফলে ভর্তুকির মাত্রা দ্রুত বাড়তে পারে। তবে তার চেয়েও বড় কথা, যখন ওই দশ শতাংশ ভর্তুকির নিয়ম স্থির হয়েছিল, তখনকার তুলনায় খাদ্যশস্যের বিশ্ববাজারে এখনকার অবস্থা অনেক আলাদা, গত দেড় দশকে বাজারে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। ২০০১ সালে ডব্লুটিও’র দোহা রাউন্ড যখন শুরু হয়, তখন ইউরোপ আর আমেরিকায় কৃষি উৎপাদনের বাড়বাড়ন্ত। ফলে তারা গরিব দেশে প্রচুর শস্য কম দামে ঢেলে দিত। অথবা তাদের সরকার নিজের দেশের চাষিদের ভর্তুকি দিত খাদ্যশস্য উৎপাদন কম রাখার জন্য, যাতে রফতানির বাজারে দাম না পড়ে যায়। পশ্চিম দুনিয়া থেকে প্রচুর শস্য আমদানির ফলে গরিব দেশের গরিব চাষিদের তখন নাভিশ্বাস উঠেছিল। সেই সময় খাদ্য ভর্তুকির মাত্রা দশ শতাংশের মধ্যে রাখা কঠিন ছিল না।

গত দশকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করে। প্রধানত চিনের বাজারে খাদ্যশস্যের চাহিদায় বিপুল বৃদ্ধির ফলে ২০০৭-০৮ থেকেই শস্যের মূল্যবৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব বাজারে গমের দাম দ্বিগুণ, চালের দাম তিনগুণ হয়ে যায়। অনেক উন্নয়নশীল দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়, তাতে সমস্যা আরও বাড়ে। উন্নয়নশীল দেশে চাষিদের আয় সমান হারে না বাড়ায় খাদ্য বাণিজ্য দিয়ে খাদ্য সুরক্ষা আনা সম্ভব কি না, সে বিষয়ে সংশয় দেখা দেয়। লক্ষণীয়, রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও বা ‘ফাও’) খাদ্য সুরক্ষা বলতে বোঝায় এই যে, সারা পৃথিবীর মানুষ যেন যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ আর পুষ্টিকর খাদ্য পায়, এবং সেই খাদ্য যেন তাদের সঙ্গতির মধ্যে থাকে। কিন্তু এই খাদ্য দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি থেকেই জোগান হবে না আমদানি করা হবে, সেটা উহ্য থেকে যায়। বিশ্বব্যাঙ্ক তো সরাসরি বলেই দেয় যে, খাদ্য সুরক্ষার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলি উন্নয়নের প্রশ্নে আপস করছে। তাদের মতে, ডব্লুটিও’র মতেও, খাদ্য আমদানির হাত ধরেই খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং সরবরাহের বৈচিত্র বাড়ানো যায় এবং অবশ্যই আনা যায় খাদ্য সুরক্ষা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতের মতো দেশকে খাদ্য ভর্তুকির দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় ডব্লুটিও। খাদ্য অর্থনীতির বাজারীকরণ ও অবাধ খাদ্য আমদানির পথে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ। এই প্রেক্ষিতেই এখন ডব্লুটিও তথা উন্নত দেশগুলির সঙ্গে ভারত এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের দড়ি টানাটানি।

২০০১ সালে শুরু হওয়া দোহা রাউন্ড সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল ২০০৪ সালে। নতুন নতুন জটিলতা সৃষ্টির ফলে তা কোনও দিন সত্যিই সমাপ্ত হবে কি না, তা নিয়েই এখন গভীর সন্দেহ। উন্নত ও উন্নতিশীল দুই বর্গেরই বিভিন্ন দেশের নিজেদের মধ্যে পৃথক বাণিজ্য চুক্তির হিড়িক অব্যাহত। ফলে ডব্লুটিও’র মতো বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সংস্থার গুরুত্ব কমছে। বালি অধিবেশন ছিল ডব্লুটিও’কে বাঁচিয়ে তোলার একটা জোরদার চেষ্টা। এ কথাও অবশ্য ঠিক যে, নব্বইয়ের দশকে যখন নর্থ আমেরিকা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (নাফ্টা) বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জোট বাঁধছে, সেই সময়েই ডব্লুটিও’র জন্ম। কিন্তু এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা পরিস্থিতি, আর্থিক সংকটের মেঘ কাটছে না। এখন যখন আবার প্রধানত উদীয়মান চিনকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে: আমেরিকা, ইউরোপ এবং খানিকটা নিমরাজি জাপানের মধ্যে ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট-এর মাধ্যমে নতুন জোট বাঁধার কথা উঠছে, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষেও ডব্লুটিও’কে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তিতে মার্কিন আধিপত্য কমানো বা উন্নয়নশীল দেশের রফতানির গুণমান সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ খানিকটা শিথিল করা এ সব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলি এখনও তেমন কোনও পদক্ষেপ করেনি। মনে রাখতে হবে, কিছু দিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডব্লুটিও’তে সৌরপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক চাপানোর জন্য ভারতের নামে নালিশ জানিয়েছিল। পরিবেশ সংরক্ষণের যুক্তিতে সেই অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।

এই সময়ে ভারতের কঠোর মনোভাব কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনও বার্তা দেয়? বিশেষত তা যখন দেখানো হল নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফরের আগেই?

ইউনাইটেডওয়ার্ল্ড স্কুল অব বিজনেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

editorial sahana ghosh wto
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy