Advertisement
E-Paper

নির্যাতন ও সুরক্ষা, পিতৃতন্ত্রের দুই দিক

এক দিকে মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন, অন্য দিকে তার নিরাপত্তার নামে স্বাধীনতা খর্ব করার নানান ফিকির। অর্ধেক নাগরিককে দমিয়ে রেখে আমরা নিজের পায়ে কুড়ুল মারছি।মানার (নাম পরিবর্তিত) বয়স ছয়। বাড়ি কপনা। কলকাতা শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে একটি গ্রাম। মানার বাবা ভ্যান চালান। সবে পাড়ার স্কুলে যেতে শুরু করেছে মানা। স্কুলের পড়াশোনা বুঝে নিতে পাড়ার এক দিদিমণির বাড়িতে নিয়মিত যায় সে। এক দিন পড়তে গিয়ে দেখে, দিদিমণি বাড়ি নেই। দিদিমণির স্বামী একা বাড়িতে আছে। তার বয়স ৫১।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১

মানার (নাম পরিবর্তিত) বয়স ছয়। বাড়ি কপনা। কলকাতা শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে একটি গ্রাম। মানার বাবা ভ্যান চালান। সবে পাড়ার স্কুলে যেতে শুরু করেছে মানা। স্কুলের পড়াশোনা বুঝে নিতে পাড়ার এক দিদিমণির বাড়িতে নিয়মিত যায় সে। এক দিন পড়তে গিয়ে দেখে, দিদিমণি বাড়ি নেই। দিদিমণির স্বামী একা বাড়িতে আছে। তার বয়স ৫১। সে মানাকে একা পেয়ে তার যোনিতে আঙুল প্রবেশ করায়। ছ’বছরের মেয়ের জাঙ্গিয়া রক্তাক্ত, উরু ক্ষতবিক্ষত, সে চিত্‌কার করে ওঠে। মানার পরিবার এবং পাড়ার লোক গিয়ে দিদিমণির বাড়ি ভাঙচুর করে। স্বামী পালিয়ে যায়। পুলিশ বাড়ি ভাঙচুরের অপরাধে মানার পরিবার এবং পাড়ার লোকদের নামে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে। দিদিমণির স্বামী রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে আত্মীয়তার সুবাদে পুলিশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। মেয়েটির পরিবারও জনপ্রতিনিধির দ্বারস্থ হয়, সাহায্যের আশ্বাস পায়। প্রতিনিধির প্রভাবেই হোক, নারী আন্দোলনের কর্মীদের হস্তক্ষেপেই হোক, অভিযুক্ত ধরা পড়ে।

দৌলপুর গ্রামের চোদ্দো বছরের মেয়ে নমি (নাম পরিবর্তিত) স্কুল যাওয়ার পথে ধর্ষিত হয়। অভিযুক্ত দুটি ছেলে ভিন্ন ধর্মের। নমির পরিবার এবং গ্রামের লোকজন গিয়ে ওই ভিন্নধর্মাবলম্বীদের পাড়ায় লুটপাট চালায়। দু’পক্ষে যথাক্রমে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারা দাঁড়ায়। ঘটনায় ধর্মের রং লাগে। উত্তেজনা ছড়ায়। র্যাফ নামে।

পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এ রকম ঘটনা এখন হরদম ঘটছে। রাজনৈতিক দাদাদের মাতব্বরি আগেও ছিল, কিন্তু আইনের বাইরে গিয়ে নির্যাতনকারীর জ্ঞাতিগুষ্টির ওপর প্রতিশোধ নেওয়া ও এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি, এ রাজ্যের এক নতুন ধারা। ‘তোমার পরিবার আমার পরিবারের বৈরী, অতএব তোমাকে আমি ‘নষ্ট’ করব’ পশ্চিমবঙ্গে এই পারিবারিক শত্রুতা অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। মেয়ে-শরীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ক্রমশই এই প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এলাকার শান্তিরক্ষার প্রশ্ন বেশি জরুরি হয়ে পড়ছে, শান্তিভঙ্গের কারণ গৌণ হয়ে যাচ্ছে, বিশেষত সেটা যদি যৌন নির্যাতনের ঘটনা হয়।

যৌন নির্যাতন থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার এই প্রয়াস কিন্তু কাকতালীয় নয়। রাজনীতিতে ক্ষমতাশালী সব দলই কমবেশি এই প্রয়াসে শামিল। এর একটি ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। সে রাজনীতি বলতে চায়, ‘ওই সব যৌন হেনস্থা-টেনস্থা তুচ্ছ ব্যাপার। মেয়েরা নিজেরাই ও সব ডেকে আনে। আসল উদ্বেগের বিষয় হল, পাড়ায় পাড়ায় হানাহানি, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দাঙ্গা।’ নিঃসন্দেহে প্রতিবেশীদের মধ্যে মারামারি দুশ্চিন্তার। কিন্তু এই দাঙ্গা যখন কৃত্রিম ভাবে উস্কানি দিয়ে তৈরি করা হয়, মেয়েদের, এমনকী বাচ্চা মেয়েদের প্রতি ধর্ষণ অথবা যৌন নিপীড়নকে যখন রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা দ্বিমাত্রিক উদ্বেগের জন্ম দেয়।

মেয়েদের উপর প্রত্যেকটি যৌন নির্যাতনের ঘটনার সুস্পষ্ট রাজনীতি আছে। সে রাজনীতি ক্ষমতার। স্থান, কাল, কুশীলব আলাদা আলাদা হলেও তার মোদ্দা কথা সর্বত্রই এক। ‘তোমার বড় বাড় বেড়েছে, দাঁড়াও তোমার ডানা ছাঁটছি।’ শুধুমাত্র অপরাধী নয়, সমাজসুদ্ধ লোক মেয়েদের ‘ডানা ছাঁটা’র জন্য তত্‌পর। সেই জন্যই মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন আইনি অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তাকে সামাজিক মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা হয়। নির্যাতনের জুতসই ‘কারণ’ খুঁজে বার করার চেষ্টা করা হয়। নিশ্চয়ই মেয়েটা ছোট জামা পরেছিল, নিশ্চয়ই মদ খেয়েছিল, নিশ্চয়ই ছেলেবন্ধুর কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল, নিশ্চয়ই রাতবিরেতে রাস্তায় ঘুরছিল। নিশ্চয়ই!

এ রাজনীতি দলীয় রাজনীতিতে সীমিত নয়। এর প্রসার আরও ব্যাপক, আরও গভীরে এর শিকড়। নির্যাতনের দায় নির্যাতিতার ঘাড়ে চাপিয়ে অপরাধীকেই আড়াল করা হয় না, মেয়েদের চার পাশে বিধিনিষেধের বেড়াজাল আরও অটুট করা হয়। মেয়েদের ‘নষ্ট’ হওয়া থেকে বাঁচাতে, মেয়ে-বউয়ের ‘সম্মান = পরিবারের সম্মান’ রক্ষা করতে আরও ‘না’ চাপানো হয় মেয়েদের ইচ্ছেগুলোর ওপর। এখানে যাবে না, এটা পরবে না, ওটা খাবে না, এ কাজ মেয়েদের মানায় না ইত্যাদি। আর সবই নাকি করা হয় মেয়েদের ‘মঙ্গল’-এর জন্য, ‘সম্মান’-এর তরে।

এ ‘সম্মান’ কি আদৌ মেয়েদের যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচাতে পারে? কখনওই না। এ হল সম্মানের নামে মেয়েদের যোনির ওপর জুলুম কায়েম, তাদের অপরিসীম খাটুনির ক্ষমতাকে বেগার খাটানোর মতলব। এ হল মেয়েদের ক্ষমতার সোপানের নীচের ধাপে রাখার রাজনীতি। এতে বিনা পয়সায় তাদের ঘরে-বাইরে খাটানো যায়, তাদের রোজগারের টাকা পরিবারের সম্পত্তি মনে করে হাতানো যায়, সর্বোপরি ইচ্ছেমতন তাদের শরীরের ওপর দখল নেওয়া যায়। অবশ্যই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের মাথারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে এ সব সুবিধা ভোগ করেন এবং এই সম্ভোগ জিইয়ে রাখার জন্য রাজনীতি চালান। আর সে রাজনীতিরই প্রকাশ ঘটে মেয়েদের ওপর ঘরে-বাইরে যৌন অত্যাচারে। যে মেয়ে ক্ষমতাবানদের এই অন্যায় সম্ভোগের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, যে মেয়ে অনুশাসনকে পাত্তা দেন না, তাঁর কপালে জোটে যৌন নিপীড়ন, এমনকী মৃত্যুও।

এ রাজনীতির একটা উল্টো পিঠও আছে। সে হল সুরক্ষার গল্প। সুরক্ষার মাধ্যমে সুকৌশলে মেয়েদের ‘রক্ষক’-এর ছত্রচ্ছায়ায় রাখার ব্যবস্থা চলে। ক্ষমতার ছড়ি থাকে ‘রক্ষক’-এর হাতে, মেয়েরা তার হাতের পুতুলমাত্র। যাঁরা মেয়েদের উপর যৌন নির্যাতনের বিরোধিতা করেন, তাঁরা বেশির ভাগ সময়ই মেয়েদের ‘রক্ষাকর্তা’র দরকার বলে মনে করেন। মেয়েদের ওপর যত অত্যাচার বাড়ছে, ততই ‘রক্ষাকর্তা’র ভূমিকাকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে ‘ভাল পুরুষ’ মানে সে মেয়েদের ‘রক্ষা’ করতে এগিয়ে আসে। রাজনৈতিক দলও নির্বাচনী প্রচারে মেয়েদের ‘মর্যাদা রক্ষা’র প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রশ্ন হল, মেয়েদের কেন রক্ষা করতে হবে? তাঁরা কি ‘আধা-মানুষ’? আর মেয়েদের আলাদা করে ‘মর্যাদা’রই বা মানে কী? কীসের এই মর্যাদা? নারীদেহের? নির্দিষ্ট ভাবে যোনির? সুরক্ষা নয়, চাই স্বাধীনতা।

মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে নিঃশর্তে মেনে নেওয়ার মতন সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় পরিবেশ জরুরি। নারী-পুরুষ সমান এ কথা শুধু সংবিধানের বুলিমাত্র নয়, যথার্থ সমান-সমান-এর মানে, দেশের মেয়েরা যখন যেখানে খুশি যেতে পারবেন, যে কোনও পোশাক পরতে পারবেন, জীবনকে অকুণ্ঠে ভোগ করতে পারবেন। দেশের সকলকে প্রতিনিয়ত মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রণ যে কোনও মানুষকেই ছোট করে, অসম্মান করে।

মেয়েদের যৌন নির্যাতন এবং তা থেকে মেয়েদের ‘রক্ষা’র এই ধারণায় ক্ষতি শুধু মেয়েদের নয়, ক্ষতি দেশের, সমাজের। দেশের অর্ধেক নাগরিক যদি নিঃশঙ্ক চিত্তে, উচ্চ শিরে ইচ্ছেমতন দিনযাপনের সুযোগ না পায়, তা হলে তাদের কর্মক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়, রোজগার বাড়ে না, জাতীয় আয়ের ভাণ্ডারেও শ্রীবৃদ্ধি হয় না। শুধু টাকার অঙ্কেই নয়, সৃষ্টিশীলতার দিক থেকেও দেশের উন্নতি ব্যাহত হয়। যৌন অত্যাচারের ভয়ে কুণ্ঠিত মেয়ে দেশের প্রগতির পথে বড় অন্তরায়। সংকীর্ণ রাজনীতির খেসারত দিতে গিয়ে আমরা নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়ুল মারছি।

dolan gangopadhyay patriarchal society oppression security
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy