সারা বছর লেখাপড়া না করিয়া শেষ রাত্রে বাজিমাত করিবার দক্ষতায় কোনও কোনও পরীক্ষার্থী কৃতবিদ্য। এক দিনের ক্রিকেট বা, বিশেষত, টি টোয়েন্টি নামক ক্রীড়ার ময়দানেও শাহিদ আফ্রিদিদের জয়জয়কার। নির্বাচন নিশ্চয়ই পরীক্ষাবিশেষ, আবার ক্রিকেট ম্যাচের সহিত তাহার তুলনাও যে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এমন কথা বলা চলে না। কিন্তু পাঁচ বছর একমনে নিষ্ক্রিয়তার সাধনা করিয়া শাসক দলের নেতারা নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে সহসা কাজ দেখাইতে অতি তৎপর হইয়া উঠিলে কিঞ্চিৎ বিসদৃশ দেখায় বইকী। ইউ পি এ’র প্রধান শরিক কংগ্রেস গত কিছু দিন তেমন উদ্ভটনাট্যই রচনা করিয়াছে। যেন তেন প্রকারেণ তেলঙ্গানা সৃষ্টির জন্য বিল পাশ করাইয়া লওয়া, জাঠদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, বেতন কমিশন নিয়োগ ইত্যাদি বিবিধ তৎপরতার পরে, নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগে তড়িঘড়ি অর্ডিনান্স জারি করিয়া দুর্নীতি নিবারণী আইন সংশোধনের শেষ চেষ্টা শেষ অবধি ফলপ্রসূ হয় নাই বটে, কিন্তু সেই উদ্যোগ যে আদৌ দেখা গিয়াছে, তাহাই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। লক্ষণীয়, এই চেষ্টার পিছনে প্রধান উদ্যোগী হিসাবে যাঁহার ভূমিকা উদ্ভাসিত হইয়াছে, তিনি সরকারের কোনও সদস্য নহেন, তিনি শাসক দলের সহ-সভাপতি। নেপথ্য হইতে সরকার চালনার ইহা আরও এক অসুস্থ নজির। মানিতেই হইবে, সরকারের অন্দরমহল হইতে, এমনকী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে প্রশ্ন তথা আপত্তি উঠিবার ফলেই শেষ অবধি এই চেষ্টা বানচাল হইয়াছে, এইটুকুই আশার কথা। তবে কংগ্রেস নামক দল বা তাহার হাই কমান্ড এই অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লইবে কি না, তাহা বলা কঠিন।
বস্তুত, নীতিপঙ্গুতা নামক যে ব্যাধিটির কথা গত কয়েক বছরে বারংবার উঠিয়াছে, তাহা কংগ্রেস তথা ইউ পি এ’র দ্বিতীয় দফার রাজত্বের একটি ব্যাধি, একমাত্র নয়। সমস্যা কেবল নীতি নির্ধারণের নয়, সমস্যা ছিল প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজ চালাইবার ক্ষেত্রে অকল্পনীয় ব্যর্থতার। দুর্নীতির যে অভিযোগে এই সরকার ক্রমাগত নাজেহাল হইয়াছে, তাহার প্রতিকার তথা মোকাবিলাতেও প্রয়োজনীয় তৎপরতার তিলমাত্রও দেখা যায় নাই। এমনকী ব্যক্তিগত ভাবে সততার প্রতিমূর্তি বলিয়া পরিচিত প্রধানমন্ত্রীও আপন নিয়ন্ত্রণাধীন দফতরের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে যে নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করিয়াছেন, তাহা কেবল লজ্জাকর নয়, ভয়ঙ্করও বটে। দুর্নীতি নূতন ছিল না, কিন্তু দুর্নীতির প্রতিকারে এতখানি নিষ্ক্রিয়তা ভারতীয় মাপকাঠিতেও সুলভ নহে। আম আদমি পার্টির উত্থান ও নির্বাচনী সাফল্য কতটা স্থায়ী হইবে, তাহা লইয়া ইতিমধ্যেই বড় প্রশ্ন উঠিয়া গিয়াছে, অরবিন্দ কেজরীবাল ও সহকর্মীদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, কংগ্রেসের রাজনৈতিক সমস্যা এই আন্দোলনের ফলে বহুগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। শেষ মুহূর্তে সেই সমস্যা সামাল দিবার তাড়নাতেই রাহুল গাঁধীর তৎপরতা, তাহাও স্পষ্ট।
কিন্তু ইহাতে হিতে বিপরীত হইবার সম্ভাবনাই প্রবল। জনস্মৃতি দুর্বল হইতে পারে, কিন্তু ভারতীয় ভোটদাতাদের সম্পূর্ণ স্মৃতিহীন বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। তাঁহারা শেষ ওভারের ধুন্ধুমার ব্যাটিং দেখিয়া বাকি ম্যাচ ভুলিয়া যাইবেন, এমন ভাবনার মধ্যে বিস্তর বুদ্ধিহীনতার পরিচয় আছে। আর, চোখ বুজিয়া ব্যাট চালাইলেই যে বাউন্ডারি হইবে, এমন নিশ্চয়তা টি টোয়েন্টির কেতাবেও লেখা নাই। ইউ পি এ সরকার দীর্ঘ দিন নিষ্ক্রিয়তার করুণ ইতিহাস সৃষ্টি করিবার পরে যখন (অতি)সক্রিয়তা দেখাইতে গেল, তখন ইতিহাস করুণতর হইল। নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তির ঘোষণা কংগ্রেস নেতাদের অন্তত একটি উপকার করিয়াছে। তাঁহাদের আর কাজ দেখাইতে হইবে না। এই নিষ্কৃতির জন্য রাহুল গাঁধী মনে মনে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy