Advertisement
E-Paper

পুরনো কাসুন্দি তিনি এমনি ঘাঁটতেন না

এক জন ‘ইনস্টিটিউশন বিল্ডার’ হিসেবেই তাঁকে চিনে এসেছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে কী ভাবে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ছক ভেঙে গড়ে তুলতেন স্বতন্ত্র পরিসর, সেটা হয়তো অনেকেই জানেন না। সম্প্রতি বিদায় নিয়েছেন যশোধরা বাগচী।আমি প্রথম যশোধরাদিকে দেখি ১৯৮৪ সালে কল্যাণী কার্লেকর-নলিনী দাশদের বাড়ির উঠোনে ‘সচেতনা’ নামের নারীবাদী সংগঠনের একটি ঘরোয়া সভায়। তিনি সভায় কী বলেছিলেন তা আজ একেবারেই মনে নেই, কিন্তু এখনও শুনতে পাই তাঁর সে দিনের গান: আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী; নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
ছাত্রজীবনে। ষাটের দশকে অক্সফোর্ডে যশোধরা বাগচী (১৯৩৭-২০১৫)

ছাত্রজীবনে। ষাটের দশকে অক্সফোর্ডে যশোধরা বাগচী (১৯৩৭-২০১৫)

আমি প্রথম যশোধরাদিকে দেখি ১৯৮৪ সালে কল্যাণী কার্লেকর-নলিনী দাশদের বাড়ির উঠোনে ‘সচেতনা’ নামের নারীবাদী সংগঠনের একটি ঘরোয়া সভায়। তিনি সভায় কী বলেছিলেন তা আজ একেবারেই মনে নেই, কিন্তু এখনও শুনতে পাই তাঁর সে দিনের গান: আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী; নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী। গানটা আমার কাছে নতুন করে অর্থবহ হয়ে ওঠে সে দিন থেকে। তার পর গত তিরিশ-একতিরিশ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁর গলায় শোনা খুব চেনা অনেক গান আমার কাছে বয়ে এনেছে নতুন নতুন মানে। যেমন বিনায়ক সেনের মুক্তির দাবিতে আহূত এক পথসভায় তিনি গাইছেন: আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে।

সুকণ্ঠী যশোধরাদি সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না। তবে শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত-অতুলপ্রসাদী নয়, কানন দেবী বা কিশোরকুমারের গানও তাঁকে অনেক বার গাইতে শুনেছি। তাঁর সঙ্গীতপ্রেম কোনও ছুতমার্গ ধরে এগোয়নি সেটা জানতাম। তা সত্ত্বেও গত বছর ‘সুর ও বাণীর মালা’ নামে তাঁর একটি লেখা পড়ে নতুন করে অনুভব করি কত বিভিন্ন ঘরানার গানকে তিনি প্রাণের মাঝে গ্রহণ ও লালন করেছিলেন। তাঁর মা-মাসি-দিদিমা, যাঁরা কেউ পেশাদারি সঙ্গীতচর্চা করেননি কিন্তু যাঁদের ডালিতে বিচিত্র গান ছিল, প্রধানত তাঁরাই ছিলেন যশোধরাদির সঙ্গীতপ্রেমের উত্‌সে।

আমার মনে হয়, অল্প বয়সে প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত আবহে নানা জায়গার প্রাণস্পর্শী গানকে সাদরে গ্রহণ করার যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন, তার প্রভাব যশোধরাদির জীবনে ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁর সঙ্গীতপ্রেমের মধ্যে যে দর্শন ছিল, অনেকটা সেই জীবনদর্শন থেকেই তিনি সমস্ত জীবন নানা বয়সের, নানা মত ও পথের গুণী পথিকদের আপন করে নিয়েছিলেন। উজাড় করে দিয়েছিলেন উত্‌সাহ, স্নেহ, ভালবাসা। কার্পণ্য কথাটা যশোধরা বাগচীর অভিধানে ছিল না বোধহয়। বিশেষ করে নতুন লেখক, গবেষক, শিল্পী বা সংগঠকদের গুণের কদর করে তাঁদের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে তাঁর জুড়ি ছিল না। আবার নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান যাঁরা রেখেছেন, তাঁরা অনেক সময় ভিন্নমতাবলম্বী হলেও যশোধরাদি তাঁদের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে কখনও কসুর করেননি। যে সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের সভানেত্রী ছিলেন, সে ক’বছর ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে কমিশন থেকে যাঁদের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার ও কলকাতা শহরের সেই গুণিজনদের নামের তালিকার দিকে তাকালেই আন্দাজ পাওয়া যায় কতখানি ছিল তাঁর মনের প্রসার।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও পরে সেখানে মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাত্রী হিসেবে তাঁর খ্যাতি সুবিদিত এবং তাঁকে এক জন ‘ইনস্টিটিউশন বিল্ডার’ বা প্রতিষ্ঠান-স্থপতি হিসেবেই আমরা চিনে থাকি। তবে তাঁর কাজের যে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো আলোচিত হয়নি বললেই চলে, সেগুলো হল, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে কী ভাবে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ছক ভেঙে গড়ে তুলতেন স্বতন্ত্র পরিসর এবং সুকৌশলে জায়গা করে দিতেন কোনও কারণে প্রতিষ্ঠানে স্থান না হওয়া গুণী তথা সম্ভাবনাময় মানুষদের। এই প্রসঙ্গে আমাদের আর এক প্রসিদ্ধ শিক্ষকের মুখে শুনেছি, যশোধরাদিই সত্তরের দশকের মধ্যভাগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তাঁকে এমএ ক্লাসের ছাত্র করে নিয়েছিলেন। বিএ পরীক্ষার ফল ভাল না হওয়ায় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে তাঁর ভর্তি হওয়ার বাধা ছিল। দূরদর্শী যশোধরাদি প্রথমে তাঁকে ক্লাসে বসবার অনুমতি দেন এবং কিছু দিন পর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের মধ্য দিয়ে পথ করে খাতায়-কলমে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র করে নেন।

উপাচার্য শঙ্কর সেন ও আরও অনেকের সহৃদয় সহযোগে ১৯৮৮ সালে যাদবপুরে যখন মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র শুরু করেন যশোধরাদি, তখন প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ছাপিয়ে ব্যক্তিগত সংযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমে তিনি ওই কেন্দ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের ও বাইরের অনেক লোককে টেনে আনলেন। অনেক ধরনের মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে তাঁর পথ চলার ক্ষমতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটল এই পর্বে। কলা বিভাগের একতলার একটি ঘর কেন্দ্রের ঠিকানা হলেও, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের নানা প্রান্ত থেকে উত্‌সাহী শিক্ষকদের নিয়ে আসা হল কেন্দ্রের অ্যাকাডেমিক কমিটিতে। ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিজ্ঞানের কয়েক জন শিক্ষক ছিলেন সেই কমিটিতে, তাঁরা যোগ দিতেন মানবীবিদ্যার আলোচনাসভায়। মানবীবিদ্যার দৃষ্টিতে কী ভাবে পাঠ্যসূচিতে বদল আনা যায়, তার জন্য বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের ডেকে ডেকে এনে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও অন্যত্র আলোচনাসভা বসানো হত।

কেন্দ্রের গোড়াপত্তনের কিছু দিনের মধ্যেই এক বার বিজ্ঞান কংগ্রেস হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করে ‘নারী ও বিজ্ঞান’ নিয়ে একটি বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করেন যশোধরাদি। এটা সেই সময়ের কথা, যখন এ ধরনের বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান কংগ্রেসে আলোচনা মঞ্চ পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল, নারীবাদী বিজ্ঞান-দর্শন নিয়েও এ দেশে চর্চা ছিল খুবই কম। আমাদের ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে, যখন সিলেবাসে নারীবাদের ছায়া ছিল না বললেই চলে, যশোধরাদি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে উদ্যোগ নিয়ে সিমোন দ্য বোভোয়া’কে উত্‌সর্গ করে যে জাতীয় স্তরের সেমিনারটি করিয়েছিলেন, তাতে অংশগ্রহণ করে মনের অনেকগুলো জানলা খুলে গিয়েছিল।

মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো তখন হত ক্যাম্পাসের নানা জায়গায়: কখনও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে আবার কখনও মেকানিক্যাল বা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বড় ক্লাসঘরে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা দল বেঁধে ওই সব অনুষ্ঠানে আসতেন সে কথা বলছি না। কিন্তু একটি ইন্টারডিসিপ্লিনারি কেন্দ্র হিসেবে বিচ্ছিন্নতা দূর করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রান্তের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে এর একটা বড় ভূমিকা ছিল। অন্য দিকে, কলা বিভাগের যে ঘরটি থেকে যশোধরাদি কয়েক জনকে নিয়ে কাজটি শুরু করেছিলেন, তার দরজা সব সময় সকলের জন্য খোলা থাকত। কাজে অকাজে যে যখন খুশি ঢুকে পড়ে অধ্যক্ষ ও কর্মীদের কাজে বেশ কিছু ব্যাঘাত ঘটাতাম নিশ্চয়। আবার এ কথাও ঠিক যে, প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অতিক্রম করে ওই খোলা দরজার মধ্য দিয়ে সকল আগ্রহী শিক্ষক-ছাত্র-গবেষক-নারী আন্দোলনকর্মীর প্রতি একটা আহ্বান ছিল— স্বাধীন ভাবে চিন্তা ও ভাবনা ভাগ করে মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের অংশীদার হওয়ার আহ্বান। নারীবাদী দর্শন নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে যশোধরাদি এ ভাবেই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন।

লাল ফিতের ফাঁস এড়িয়ে, কার থেকে কী ভাবে কোন কাজটা আদায় করে নিয়ে, গোড়ার দিকে অতি অল্প অর্থ-বরাদ্দের মধ্যে সুষ্ঠু ভাবে কেন্দ্র পরিচালনা করা যায়, তার পাঠ যশোধরাদি নেন পূর্বসূরিদের কাছ থেকে। নিজের একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন, কিছু দিন একটি সংস্থার সমাজকর্মী হিসেবে তাঁর মাকে তিনি যে ভাবে দৈনন্দিন কাজে ‘ব্যুরোক্র্যাটিক ইনারশিয়া’কে চ্যালেঞ্জ করতে দেখেছিলেন, তাঁর তরুণ মনে তা কত গভীর ছাপ রেখেছিল সেটা তিনি বোঝেন অনেক পরে, যখন যাদবপুরে মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করেন। সেই একই কারণে তাঁর মায়ের প্রজন্মের অন্য কয়েক জনের প্রতি যাঁরা যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগের সময় সৃষ্টিশীল সমাজকর্মী ছিলেন তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁদের সঙ্গে যশোধরাদির রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত ফারাক থাকলেও তিনি পূর্বসূরিদের কাজের ধরন থেকে পাঠ নিয়ে নতুন ভাবে তা প্রয়োগ করায় সচেষ্ট ছিলেন। এখানেই ছিল তাঁর অনন্যতা। পুরনো কাসুন্দি তিনি এমনি ঘাঁটতেন না। পুরনো আখ্যানগুলো থেকে নতুন পাঠ-সম্ভাবনা, নতুন মানে তৈরি করাটা তাঁর ক্ষেত্রে সাহিত্যপাঠকে ছাপিয়ে পূর্বজদের জীবন-পাঠে ব্যাপ্ত হয়েছিল। এঁদেরই এক জনের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তাঁকে ভাষণ শেষে গাইতে শুনেছিলাম: কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো। যদি পারতাম, সেই গানটা আজ যশোধরাদির জন্য গাইতাম।

post editorial jasodhara bagchi sharmistha dutta gupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy