Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

বুনিয়াদি শিক্ষার আশ্চর্য মডেল

শিগগিরই হয়তো কাশীতে স্টেম সেল রিসার্চ ল্যাব আবিষ্কৃত হবে। ‘তেজোময় ভারত’ দর্শনে আতঙ্কিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের শরণ নিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়গর্জন এবং বর্ষণ সচরাচর এক রকম হয় না। অতএব নির্বাচন মিটে যাওয়ার পরে ‘গুজরাত মডেল’-এর মহিমা কীর্তনে ভাটা পড়েছে। তবে সম্প্রতি অন্য এক গুজরাত মডেলের বিবরণ পড়ে দেশবাসী চমৎকৃত। অর্থনীতি নয়, শিক্ষার মডেল। ইতিহাস শিক্ষাও বলতে পারি, বিজ্ঞান শিক্ষাও বলতে পারি। ‘তেজোময় ভারত’ নামক একটি বই গুজরাতের সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের পড়তে বলা হয়েছে।

শিল্পী: সুমন চৌধুরী

শিল্পী: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:১৩
Share: Save:

গর্জন এবং বর্ষণ সচরাচর এক রকম হয় না। অতএব নির্বাচন মিটে যাওয়ার পরে ‘গুজরাত মডেল’-এর মহিমা কীর্তনে ভাটা পড়েছে। তবে সম্প্রতি অন্য এক গুজরাত মডেলের বিবরণ পড়ে দেশবাসী চমৎকৃত। অর্থনীতি নয়, শিক্ষার মডেল। ইতিহাস শিক্ষাও বলতে পারি, বিজ্ঞান শিক্ষাও বলতে পারি। ‘তেজোময় ভারত’ নামক একটি বই গুজরাতের সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের পড়তে বলা হয়েছে। বইটি রাজ্যের স্কুল টেক্সটবুক বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত এবং ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শংসাধন্য। এই আগমার্কা মহাগ্রন্থের লেখক শ্রীযুক্ত দীননাথ বাত্রা। তাঁর লেখা আরও বেশ কয়েকটি বই গুজরাতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হচ্ছে। শ্রীযুক্ত বাত্রা আরএসএস-এর শিক্ষা শাখা বিদ্যা ভারতীর অন্যতম কর্তা। সম্প্রতি তাঁর কোপে পড়েছে ওয়েন্ডি ডনিগার-এর ‘অন হিন্দুয়িজ্ম’ সহ একাধিক বই। অধুনা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের পথনির্দেশ দেওয়ার গুরুদায়িত্ব প্রবীণ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ‘অচ্ছে দিন’ আগত ওই।

তো, এই তেজোময় ভারতের ছত্রে ছত্রে বিস্তর মণিমাণিক্য ছড়ানো আছে। সেগুলির মধ্য দিয়ে শ্রীবাত্রার প্রতিপাদ্য: আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু জ্ঞান এবং উদ্ভাবনই প্রাচীন ভারতে— দুই সহস্রাব্দ বা তারও বেশি আগে— জানা ছিল। তিনটি নজির। এক, ঋগ্বেদে ‘অনশ্ব রথ’-এর উল্লেখ আছে, এতদ্দ্বারা প্রমাণিত হল যে, বৈদিক যুগে ভারতে মোটরগাড়ি ছিল। হক কথা; যে রথ অশ্বে টানে না, মোটরগাড়ি ছাড়া তা আর কী বা হতে পারে? সে গাড়ির কী ব্র্যান্ড, কোন মডেল, সে কথা অবশ্য ইতিহাসস্রষ্টা বলেননি, অ্যাম্বাসাডরই হবে মনে হয়। দুই, গান্ধারীর গর্ভজাত মাংসপিণ্ড থেকে দুর্যোধনাদি একশো সন্তানের জন্মের বৃত্তান্ত তো জানি, কিন্তু কখনও ভেবেছি কি যে, এই কাহিনি প্রমাণ করে, দু’হাজার বছর আগে ভারতে স্টেম সেল রিসার্চ কোন শিখরে পৌঁছেছিল? তিন, টেলিভিশন আবিষ্কৃত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে নয়, মহাভারতের যুগে, না হলে ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরীতে বসে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ধারাবিবরণী শুনলেন কী করে? ‘সঞ্জয় উবাচ’ মানেই হল গিয়ে লাইভ টেলিকাস্ট।

পুষ্পক রথ মানে এরোপ্লেন, ব্রহ্মাস্ত্র মানে অ্যাটম বোমা, অর্জুন থেকে বৃহন্নলা মানে শল্যচিকিৎসায় যৌনরূপান্তর— কত কিছুই যে ‘ব্যাদে আছে’ বলে নির্ভুল ভাবে প্রমাণ করা যায়, তার ইয়ত্তা নেই। সেই উনিশ শতকের মহাপণ্ডিতরা কেউ কেউ সনাতন ভারতের সর্বজ্ঞ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কত দাবিই না করেছেন! রাজশেখর বসু থেকে মেঘনাদ সাহা, যুক্তিপথের পথিকরা সে-সব উদ্ভট তত্ত্বের উদ্ভটত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন বটে, কিন্তু আত্মার যদি-বা বিনাশ হয়, অন্ধবিশ্বাস অবিনশ্বর। অতএব দীননাথ বাত্রারা আজও নিশ্চিত— আমাদের মুনিঋষিরা সব জানতেন। বস্তুত, তাঁরা উনিশ শতকের পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক দূর ‘এগিয়ে গেছেন’, তাঁরা এখন আর প্রাচীন সংস্কারের ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’য় সন্তুষ্ট নন, আধুনিক প্রযুক্তিকে একেবারে প্রাচীন ভারতে নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন, শিগগিরই হয়তো কাশীতে স্টেম সেল রিসার্চ ল্যাব আবিষ্কৃত হবে, অযোধ্যায় রামলালার জন্মস্থানের মতো। ইতিমধ্যে তাঁদের নিশ্চিত জ্ঞান তাঁরা বই লিখে ছোট ছোট মগজে চারিয়ে দিতে তৎপর। জাতীয়তাবাদী শিক্ষার গুজরাত মডেলটি মোদী জমানায় আসমুদ্রহিমাচল চালু হতে পারে, সে কথা ভেবে হৃৎকম্প হল।

এবং, ছাপোষা বাঙালির সর্বরোগহর ওষুধের শরণাপন্ন হলাম। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন: প্রত্নতত্ত্ব। সেটি পরে ‘ব্যঙ্গকৌতুক’-এ সংকলিত হয়। দুটি প্রশ্ন দিয়ে লেখার শুরু: ‘প্রাচীন ভারতে গ্যাল্ভ্যানিক ব্যাটারি ছিল কি না ও অক্সিজেন বাষ্পের নাম কী ছিল’? যে কোনও কারণে মন খারাপ লাগলে লেখাটি পড়ে ফেলা বিধেয়, চিত্ত চুলবুল করে উঠবে। উঠবেই। আপাতত এইটুকু বলা যাক যে, তাঁর প্রবন্ধে এক ছদ্ম-বিতর্কের আয়োজন করেছিলেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ। সেখানে হাজির হয়েছিলেন ‘মধুসূদন শাস্ত্রীমহাশয়’। শাস্ত্রীমহাশয়ের দৃঢ় বিশ্বাস: প্রাচীন ভারতে গ্যালভানিক ব্যাটারি ছিল। প্রমাণ: গল্বন ঋষি। গ্যালভানিক ব্যাটারি না থাকলে ‘গল্বন’ নামটি এল কোথা থেকে? ঠিকই, তবে একটা ছোট্ট মুশকিল আছে। পুরনো পুঁথিপত্রে গল্বন ঋষির নাম কোথাও পাওয়া যায় না। তা হলে? মধুসূদন শাস্ত্রী অনায়াসে মুশকিল আসান করে দেন: নাম ছিল, পরিচয় ছিল, আবিষ্কারের কথা-টথা সব ছিল, কিন্তু নষ্ট হয়ে গেছে। কী করে? কী করে আবার? কিছুটা পোকায় কেটেছে, আর বাকিটা যবনেরা ধ্বংস করেছে। প্রমাণ? শাস্ত্রীমহাশয়ের সপাট জবাব: ‘যদি যবনগণের দ্বারাই গ্যাল্ভ্যানিক ব্যাটারি ও অক্সিজেনের প্রাচীন নাম লোপ না হইবে, তবে তাহা গেল কোথায়— তবে কোথাও তাহার কোনও চিহ্ন দেখা যায় না কেন? প্রাচীন শাস্ত্রে এত শত মুনি-ঋষির নাম আছে, তন্মধ্যে গল্বন ঋষির নাম বহু গবেষণাতেও পাওয়া যায় না কেন?’ এর সত্যিই কোনও জবাব নেই। আরও অনেক যুক্তি আছে লেখায়, কিন্তু সে সব অধিকন্তু।

দীননাথ বাত্রামহাশয় লেখাটি পড়ে ফেলতে পারেন। অবশ্য বলেই ভয় হল, আবার উল্টা বুঝলি রাম না হয়ে যায়, শেষ কালে মধুসূদন শাস্ত্রীর বিবৃতিটি হয়তো গুজরাত থেকে পশ্চিমবঙ্গ, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, স্কুলপাঠ্য হয়ে গেল! ব্যঙ্গকৌতুক বললে শুনছে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anirban chattopadhyay anirban
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE