Advertisement
E-Paper

ভারতের মেয়ে?

না, জ্যোতিকে ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’ বলে ইন্ডিয়াকে মহিমান্বিত করার দরকার নেই। যে মেয়েরা ‘জ্যোতি’ হয়, তারা ইন্ডিয়ার ‘জন্য’ হয় না, ইন্ডিয়া ‘সত্ত্বেও’ হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের বানায়।বড় ভাল জিনিস এই নিষেধাজ্ঞা। যাঁরা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন, এবং যার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হচ্ছে, দুই দিককেই একদম স্পষ্ট ঝকঝকে দেখা যায়। কে কী বলতে চায় বা চায় না, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধোঁয়াশা থাকে না। তাই যখন নিষিদ্ধ তথ্যচিত্র ইন্ডিয়া’জ ডটার দেখলাম, বেঙ্কাইয়া নাইডুদের জাতীয়তাবাদে কেন এবং কোথায় আঘাত লেগেছে সেটা জ্বলজ্বল করে উঠল। আহা! বিকার যখন এত ব্যাপ্ত, বিস্তৃত, এত সুগভীরপ্রোথিত, নিরাময়ের অতীত, তখন সেটাকে লুকিয়ে রাখাই তো ভাল! আর লুকিয়ে রাখার জন্য জাতীয়তাবাদের মোড়কটাই তো সবচেয়ে কাজের।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৬

বড় ভাল জিনিস এই নিষেধাজ্ঞা। যাঁরা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন, এবং যার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হচ্ছে, দুই দিককেই একদম স্পষ্ট ঝকঝকে দেখা যায়। কে কী বলতে চায় বা চায় না, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধোঁয়াশা থাকে না। তাই যখন নিষিদ্ধ তথ্যচিত্র ইন্ডিয়া’জ ডটার দেখলাম, বেঙ্কাইয়া নাইডুদের জাতীয়তাবাদে কেন এবং কোথায় আঘাত লেগেছে সেটা জ্বলজ্বল করে উঠল। আহা! বিকার যখন এত ব্যাপ্ত, বিস্তৃত, এত সুগভীরপ্রোথিত, নিরাময়ের অতীত, তখন সেটাকে লুকিয়ে রাখাই তো ভাল! আর লুকিয়ে রাখার জন্য জাতীয়তাবাদের মোড়কটাই তো সবচেয়ে কাজের।

তবে, বলতেই হবে, সিদ্ধান্তটা একেবারে মানানসই। এমন একটা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্রে যদি এমন জম্পেশ নিষেধাজ্ঞা জারি না হত, পুরোপুরি ঐতিহাসিক হত কী? এখন কিন্তু জমজমাট। নেট-যুগে নিষেধাজ্ঞা বস্তুটাই যেহেতু বকচ্ছপ টাইপের অবাস্তব, এমনিতে যারা তথ্যচিত্রটার নামও জানত না, সক্কলে এখন হুড়মুড়িয়ে ছবি দেখতে ছুটছে। স্কুলে শিক্ষিকারা বেমালুম হোমওয়ার্ক দিচ্ছেন, যাও বাড়ি ফিরেই দেখে ফেলো!

কিন্তু মুশকিলও আছে একটা। বড় মুশকিল। নিষেধাজ্ঞার পচা নর্দমায় হারিয়ে যাওয়ার জোগাড় অন্য কিছু দরকারি আপত্তির। এ দিকে ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, চিত্র-নির্মাতা লেসলি উডউইন এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করেছেন, এমন মরমিতা দিয়ে ভারতীয় সমাজটাকে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর কাছে এই আপত্তিগুলো তোলা দরকার ছিল। আলোচনাটা জরুরি ছিল।

এই যেমন, ইন্ডিয়া’জ ডটার শুরুর দুই মিনিটের মধ্যে মনে ধকধক করে একটা প্রশ্ন: ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’? কী বলতে চান লেসলি? জ্যোতি সিংহ ঠিক কী অর্থে ইন্ডিয়া’জ ডটার, ভারতের কন্যা? কেন তাকে সে ভাবে দেখতে হবে, দেখাতে হবে? যে ভারতে পুরুষতান্ত্রিকতার জাল ধর্ম-বর্ণ-জাত এমনকী লিঙ্গভেদেও এমন বহুধাপ্রসারিত, যেখানে মেয়েদেরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতন্ত্র প্রবিষ্ট, সেই বিশ্বাসে তাদের পুত্রকন্যারা প্রতি দিন জারিত, জ্যোতি কি সেই দেশের দৃষ্টান্তস্বরূপ মেয়ে হতে পারে? যে জ্যোতি বিশ্বাস করে, মেয়েরা পারে না এমন কিছু নেই, সে ডাক্তার হয়ে দেখিয়ে দেবে গ্রামের মানুষের জীবন কতখানি পাল্টানো যায়, দুঃস্থ কিশোর তার টাকা চুরি করায় পুলিশ কিশোরটিকে প্রবল মারতে উঠলে যে মেয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ায়, সেই মেয়ে কি সাধারণ, না অসাধারণ? নিয়ম, না ব্যতিক্রম? না লেসলি, জ্যোতিকে ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’ বলে ইন্ডিয়াকে মহিমান্বিত করার দরকার নেই। যে মেয়েরা ‘জ্যোতি’ হয়, তারা ইন্ডিয়ার ‘জন্য’ হয় না, ইন্ডিয়া ‘সত্ত্বেও’ হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের বানায়। এই স্ব-প্রণোদিত শক্তিকে কুর্নিশ করার একটা সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল এখানে। সুযোগটা নষ্ট হল জ্যোতির গায়ে ভ্যাদভেদে ইন্ডিয়া-তকমাটা লাগিয়ে দেওয়ায়। বেঙ্কাইয়া নাইডুদের তো কৃতজ্ঞ বোধ করা উচিত: ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র এমন বিজ্ঞাপন সহজে পেতেন কি তাঁরা?

ভারতের মেয়ে। তবু আশ্চর্য, জ্যোতি ভেড়াদলে মিশে যায়নি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে। দিন জেগে ডাক্তারি পড়বে বলে রাত জেগে চাকরি করেছে। বন্ধু যখন জিজ্ঞেস করেছে ‘কী করে এত পারিস’, উত্তর দিয়েছে, ‘করতে হবে, তাই করছি, না করে উপায় নেই।’ মা-বাবাকে আশ্বস্ত করেছে, আর ক’দিন মাত্র, এই তো এ বার সে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। ভারতের মা, তবু আশ্চর্য, জ্যোতির মা তাকে কোনও কাজে বাধা দেননি, কোনও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। এই তথ্যচিত্রে তাঁর কথা শুনলে, তাঁকে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে যায়। গ্লানি-বোধও হয়, কেননা এমন মা তো আমরা সচরাচর দেখতে পাই না। ওঁকে ‘ইন্ডিয়া’জ মাদার’ বললে শুনতে দিব্যি লাগত, হয়তো মিথ্যাচারণও হত না। কিন্তু সেই অকারণ সাধারণীকরণ করাটা যথার্থ হত কি?

প্রশ্ন কেবল ইন্ডিয়া নিয়ে নয়। প্রশ্ন ‘ডটার’ নিয়েও। কেন হঠাৎ ‘ডটার’ পরিচয়টাই বড় হল জ্যোতির জন্য? সে তার বাবা-মার প্রিয় মেয়ে, বাবা-মাও তার খুব কাছের। কিন্তু যদি এমন সুষমা না-ই থাকত তার জীবনে? যদি অত সুছন্দে না-ই বাজত তার পরিবারের তারটি? তা হলে কি এই ধর্ষণ-হত্যার বীভৎসতা কিছু কম শিউরাত আমাদের? যদি জ্যোতি হত অনাথ কিংবা পরিবারবিচ্যুত কিংবা বিবাহবিচ্ছিন্ন কিংবা সমাজছিন্ন কিংবা যৌনকর্মী? মুকেশ সিংহ রাম সিংহদের অকল্পনীয় অত্যাচার কি কিছু মাত্রায় সমর্থনীয় হয়ে উঠত? বার বার এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে, জ্যোতি কত ভাল, কত দায়িত্বশীল মেয়ে, সেই ডিসেম্বরের শীতসন্ধেয় ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সিনেমা যাওয়ার আগেও কী ভাবে সে মাকে ফোন করে জানিয়েছে, মা-র ‘অনুমতি’ নিয়েই গেছে! দেখতে দেখতে অবাক মানতে হয়, কেন লেসলি, কেন এ সব গুরুত্বপূর্ণ হতে যাবে? যদি সে দিন কুড়ি-পেরোনো বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়ে জ্যোতি বাড়ির অনুমতি না-ই নিত, না-ই পেত? মন্দ মেয়ে হয়ে যেত সে? আর তাতেই তার দুঃসহ ভবিতব্য ইন্ডিয়ার কাছে একটু সহনীয় হয়ে উঠত?

আসলে এই ইন্ডিয়া-য় মেয়েরা এখনও ‘ব্যক্তি’ হয়ে উঠতে পারেনি, পারবেও না, তাই তাদের সমানে ভাল মেয়ে ভাল বউ ভাল মা হতে হয়। না হলেও সেটা অন্তত দেখাতে হয়। নয়তো সমাজের যে সাধারণ নৈতিক বোধ, সেটুকুও তার জন্য প্রযুক্ত হয় না। এ দেশের মেয়েরা চিরকালই ‘মেয়ে’ থেকে যায়, জ্যোতির ধর্ষক-ঘাতকদের উকিল যেমন এই ছবিতে বলেন, ‘ভারতে তাদের কোনও জায়গা নেই’। কোনও দিন আমরা মেয়েরা ‘ইনডিভিজুয়াল’ বা ব্যক্তি হয়ে উঠি না, বলতে পারি না, নহি মাতা নহি কন্যা, আমি মানুষ, এ দেশের নাগরিক। নাগরিক বলে প্রতিটি নাগরিক অধিকার এমনি-এমনিই আমার চাই, আমার ব্যক্তিগত জীবন মন ধরন ধারণ পোশাক-আশাক কন্যাত্ব পত্নীত্ব মাতৃত্ব যেমনই হোক না কেন! সুযোগ ছিল এই ছবিতে, তবু লেসলিও সেটা বললেন না!

প্রশ্ন আরও। দিল্লির এই ঘটনাটায় ছয় জন অভিযুক্তই সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণি থেকে এসেছে। শহরের বস্তিবাসী অভাবী কর্মিক এরা। কিন্তু তাদের ও তাদের প্রেক্ষাপটটা দেখাতে গিয়ে, আরও একই সামাজিক গোষ্ঠীর একই ধরনের অপরাধপ্রবণতা দেখাতে গিয়ে বড্ড শ্রেণিপ্রবণ হয়ে গেল না ছবির বক্তব্য? ধর্ষণ তো কেবল ধর্ষণ নয়, ধর্ষণ একটা ব্যাপকতর অসুস্থতার প্রকাশ। সেই যে অসুস্থতা, যার নাম নারী নির্যাতন, যার নাম যৌন হিংসা, যার নাম পুরুষতান্ত্রিক বিকার, সেটা তো শ্রেণিধর্মজাতগোষ্ঠী সব ছাপিয়ে রমরমিয়ে বিরাজমান, সদরে অন্দরে বাজারে বাড়িতে। একটি বিশেষ ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র বানানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে যে বার্তাটা যাচ্ছে, সেটা তো আরও বড়। একটা বড় কিছু বলতে চেয়েছে এই ছবি, না হলে নামটাই বা কেন ইন্ডিয়া’জ ডটার? এমন একটা ছবির কিন্তু এতটা একপেশে না হওয়াই উচিত ছিল। তিহাড়ের যে বন্দিরা এক-এক জন স্বকৃতকর্ম দুশোটা ‘রেপ’ অবধি মনে করতে পারে, আরও কত তাদের হিসেবের বাইরে চলে যায় কে জানে, তার সঙ্গে উচ্চশ্রেণির উচ্চসমাজের কিছু যৌনবিকারও জায়গা পেতে পারত এই ছবিতে, অন্তত উল্লেখের মাধ্যমে! সেটা না করে লেসলি বড় একটা গোল পাকিয়ে ফেললেন। অভাব ও দুঃস্থতার মধ্যে নারীহিংসার একটা জাস্টিফেকেশন বা ব্যাখ্যা তৈরি করে ফেললেন। ভাল হল না সেটা।

ইন্ডিয়া-র ছাপটা যদি ছবির টাইট্ল-এ রাখতেই হয়, লেসলি, ছবির নাম বরং ‘আ গার্ল অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ মেন’ ধরনের রাখলে পারতেন। হ্যা।ঁ জ্যোতি নয়, এই ছবিতে যদি কাউকে ‘টাইপ’ বা সাধারণ ছাঁচ হিসেবে দেখানো যায়, সেটা এর পুরুষ কথকদের: আসমুদ্রহিমাচলে প্রবলপ্রতাপী পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহক রক্ষক ধর্ষক যারা। জ্যোতি, জ্যোতিরা তো বিশিষ্ট। দুর্লভ। নেহাতই ব্যতিক্রম।

post editorial semonti ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy