Advertisement
E-Paper

মাদ্রাসা সম্পর্কে আগে জেনে নেওয়া ভাল

বর্ধমানকাণ্ডে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক, গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক অপরাধী মাদ্রাসাগুলিকে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকেই কাঠগড়ায় তুললে ভুল হবে, সে ভুল বিপজ্জনকও বটে।রাজ্যের অনুমোদনহীন খারেজি মাদ্রাসাগুলি সন্ত্রাসবাদীদের আখড়া— প্রায় এক দশক আগে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বর্ধমান বিস্ফোরণের সূত্রে মন্তব্যটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই কাণ্ডকে ঘিরে তদন্তে যে-ভাবে জঙ্গি কার্যকলাপে মাদ্রাসার যোগসূত্র উঠে এসেছে, তা সত্যিই উদ্বেগের। মনে হতেই পারে যে মাদ্রাসাগুলিই যেন জঙ্গি তৎপরতার মূল কেন্দ্র। বিষয়টি গভীর উদ্বেগের, কারণ এই প্রশ্নে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য।

কাজি মাসুম আখতার

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
বৃক্ষরোপণ। রাজ্যের একটি মাদ্রাসায়। ২০০৮

বৃক্ষরোপণ। রাজ্যের একটি মাদ্রাসায়। ২০০৮

রাজ্যের অনুমোদনহীন খারেজি মাদ্রাসাগুলি সন্ত্রাসবাদীদের আখড়া— প্রায় এক দশক আগে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বর্ধমান বিস্ফোরণের সূত্রে মন্তব্যটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই কাণ্ডকে ঘিরে তদন্তে যে-ভাবে জঙ্গি কার্যকলাপে মাদ্রাসার যোগসূত্র উঠে এসেছে, তা সত্যিই উদ্বেগের। মনে হতেই পারে যে মাদ্রাসাগুলিই যেন জঙ্গি তৎপরতার মূল কেন্দ্র। বিষয়টি গভীর উদ্বেগের, কারণ এই প্রশ্নে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য।

মাদ্রাসা সম্পর্কে বিভ্রান্তির পিছনে রয়েছে মাদ্রাসা তথা ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অ-মুসলিমদের একাংশের অজ্ঞতা ও উপেক্ষা। বিভ্রান্তি শুরু হয় ‘মাদ্রাসা’ শব্দটি থেকেই। বিদ্যালয়কে যেমন ইংরাজিতে স্কুল বলা হয়, তেমনই আরবিতে বলা হয় ‘মাদ্রাসা’। পশ্চিমবঙ্গে মূলত তিন ধনের মাদ্রাসা রয়েছে। ১) অনুমোদন প্রাপ্ত ও সরকারি অনুদান প্রাপ্ত। ২) অনুমোদন প্রাপ্ত, কিন্তু সরকারি অনুদানে বঞ্চিত। ৩) অনুমোদনবিহীন ও অনুদানবিহীন। রাজ্যে প্রথম ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা ৬১৪টি। যার মধ্যে হাইমাদ্রাসা ৫১২টি এবং সিনিয়র মাদ্রাসা ১০২টি। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ-এর অধীনে থাকা হাই মাদ্রাসাগুলির পাঠ্যক্রম একেবারেই সাধারণ বিদ্যালয়গুলির অনুরূপ। বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়ারা সাতশো নম্বরের যে আধুনিক পরীক্ষা দেয়, মাদ্রাসার পড়ুয়াদের তার সঙ্গে অতিরিক্ত একশো নম্বরের ‘ইসলাম পরিচয়’ ও ‘কমপালসারি অ্যাডিশনাল’ হিসেবে তৃতীয় ভাষা আরবি-র পরীক্ষায় বসতে হয়, যার নম্বর রেজাল্টের মোট নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় না। পার্থক্য এইটুকুই। বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সংস্কৃত শিক্ষার বিকল্প বলা যায়। হাই মাদ্রাসার উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভাবে সাধারণ বিদ্যালয়ের মতো উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণাধীন। এখানে ধর্মীয় শিক্ষার কোনও বালাই নেই। সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিযুক্ত কিছু হাই মাদ্রাসায় শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই অ-মুসলিম। পড়ুয়াদের মধ্যেও অ-মুসলিম রয়েছে। সরকারি বেতন কাঠামোয় মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন বিদ্যালয় শিক্ষকদের সমান। তাই অনেক উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষককেও হাই মাদ্রাসায় দেখা যায়।

সিনিয়র মাদ্রাসার ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্তরে (আলিম) এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে (ফাজিল) পাঠক্রমে ধর্মীয় শিক্ষার ভাগ তুলনায় বেশি। তবে হাই ও সিনিয়র, দুই ধরনের মাদ্রাসাই সাধারণ স্কুলের মতো জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক দফতর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। মাদ্রাসাগুলিও সর্বশিক্ষা মিশন বা শিক্ষা দফতর প্রদেয় বিভিন্ন গ্রান্ট সমান ভাবে পায়। সঙ্গে বাড়তি হিসাবে পায় সংখ্যালঘু দফতর সূত্রে প্রাপ্ত আর্থিক অনুদান।

এ ছাড়া রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর অনুমোদিত প্রায় পাঁচশো শিশুশিক্ষা কেন্দ্র (চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত) এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত)। এখানে শিক্ষকরা সাম্মানিক বেতনস্বরূপ সামান্য অর্থ পান। পরিকাঠামোর উন্নয়নেও সরকারি অনুদান বরাদ্দ হয়। মাদ্রাসা পর্ষদের পাঠক্রম অনুযায়ী পঠনপাঠন হয়।

পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা ২৩৫টি। এগুলি মাদ্রাসা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত এবং মাদ্রাসা পর্ষদের পাঠক্রম অনুযায়ী পরিচালিত। তবে সরকারি অনুদান থেকে তারা বঞ্চিত। বিভিন্ন ধরনের দান এবং পড়ুয়াদের বেতন এই মাদ্রাসাগুলির আয়ের উৎস।

বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের প্রেক্ষিতে বিতর্ক উঠেছে তৃতীয় ধরনের মাদ্রাসাগুলি নিয়ে। যার নাম খারেজি মাদ্রাসা। খারেজি কথার অর্থ ‘বাহিরে’। এ কথার অর্থ অনুমোদনের বাহিরে অর্থাৎ অনুমোদনহীন। রাজ্যে এমন মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার, যদিও, সম্ভবত ভ্রান্তিবশত, মুখ্যমন্ত্রী দশ হাজার খারেজি মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু অনুমোদন দেবেন, অনুদান দেবেন না— তাই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় সাড়া দেয়নি খারেজি মাদ্রাসাগুলি। অনুমোদনের শর্তস্বরূপ নিজস্ব জমি, বাড়ি, পর্যাপ্ত শিক্ষক, পড়াশুনোর পরিবেশ ইত্যাদি না থাকায় মাদ্রাসাগুলি অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য আবেদনই করেনি। তাই ঘোষণার তিন বছর পরে মাত্র ২৩৫টি খারেজি মাদ্রাসা অনুমোদন পেয়ে মাদ্রাসা পর্ষদের পাঠক্রম অনুসরণ করছে।

অত্যন্ত গরিব মুসলিম পরিবারের সন্তানরাই সাধারণত খারেজি মাদ্রাসার পড়ুয়া হয়। সন্তানদের হাফেজ, ইমাম বা মোয়াজ্জেম তৈরি করাই এখানে অভিভাবকদের মূল লক্ষ্য। তা ছাড়া, অধিকাংশ খারেজি মাদ্রাসা আবাসিক হওয়ায় প্রায় বিনা ব্যয়ে অনাথ বা হতদরিদ্র পড়ুয়ারা দু’বেলা অন্ন গ্রহণের সুযোগ পায়। সাধারণত বাড়ি-বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা ‘দান’ বা ‘জাকত’ এই সব মাদ্রাসার অর্থ জোগানের উৎস। মূলত মসজিদ লাগোয়া ছোট কয়েকটি কক্ষ নিয়েই খারেজি মাদ্রাসাগুলি গড়ে ওঠে। কিছু খারেজি মাদ্রাসায় বাংলা-ইংরাজি পড়ানো হলেও আরবি-উর্দুসহ ধর্মশিক্ষা দেওয়াই এই সব মাদ্রাসার মূল লক্ষ্য।

এই খারেজি মাদ্রাসাগুলি একাধিক সমস্যায় জর্জরিত। প্রথমটি হল যোগ্য নজরদারির সমস্যা। আর্থিক সাহায্য তো দূরের কথা, সরকার তথা মুসলিম সমাজের অগ্রসর সচেতন অংশের বিন্দুমাত্র নজরদারি থেকে বঞ্চিত এগুলি। বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসা-সহ আরও কয়েকটি খারেজি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে যে-ভাবে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে, তা সম্ভব হয়েছে যোগ্য নজরদারির অভাবেই।

দ্বিতীয়ত, ফুরফুরা, দেহবন্দ, আহলে হাদিস বা বেরেলি গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত খারেজি মাদ্রাসাগুলির পরিকাঠামো বা শিক্ষার পরিবেশ মন্দের ভাল হলেও অধিকাংশ খারেজি মাদ্রাসার পরিকাঠামোগত দৈন্য দশা বড়ই প্রকট। ফলস্বরূপ প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত অসচেতন এই সব মাদ্রাসার পড়ুয়াদের বিভ্রান্ত করা বেশ সহজ। ধর্মীয় আবেগে ইন্ধন দিয়ে এই পড়ুয়াদের উগ্রবাদী কর্মে লিপ্ত করাও অনেক সময় কঠিন নয়।

তৃতীয়ত, মাত্র দুই-আড়াই হাজার টাকা বেতনের অদক্ষ শিক্ষক দ্বারা পরিকাঠামোহীন মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা না পায় উন্নত অর্থকরী আধুনিক শিক্ষা, না পায় উন্নত জ্ঞানভিত্তিক ধর্মশিক্ষা বা আরবি-উর্দু শিক্ষা। অর্থ না বুঝে আরবি ভাষা শিক্ষায় ভাষাজ্ঞান বা ধর্মজ্ঞান কোনওটাই সম্পূর্ণ হয় না। বস্তুত, শুধু খারেজি মাদ্রাসায় কেন, দেহবন্দ, মোরাদাবাদ, সাহারনপুর ইত্যাদি ইসলাম ধর্ম ও ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের মতো পশ্চিমবঙ্গের কোথাও উন্নত আরবি ভাষা বা ধর্মচর্চার কেন্দ্র নেই। এ রাজ্যে শিক্ষা নেওয়া মাদ্রাসা শিক্ষক, এমনকী কলেজের আরবি ভাষার শিক্ষকদের মধ্যেও খুব কমই আরবিতে দু’পাতা রচনা লেখার ক্ষমতা রাখেন। আরবি শিখতে কলকাতার গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনে দৌড়তে হয় হিন্দু-মুসলমান সকলকেই। প্রসঙ্গত, কোনও ভাষাই কোনও একটি ধর্মের একচেটিয়া হতে পারে না। আরবি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ভাষা। মিশরে এই আরবি ভাষাতেই ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। পশ্চিম এশিয়ায় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নিযুক্তদের একটা বড় অংশ ভারতীয় হিন্দু। পেশাগত কারণেই তাঁদের আরবি শিখতে হয়।

বর্ধমানকাণ্ডে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক, গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক অপরাধী মাদ্রাসাগুলিকে। শুধু স্বাগত জানানো নয়, মুসলিম সমাজকে এই প্রচেষ্টায় পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে। এবং, শুধু সরকারের নয়, মুসলিম সমাজপতি বা অগ্রসর অংশকে এগিয়ে আসতে হবে খারেজি মাদ্রাসাগুলির প্রকৃত উন্নয়নে বা নজরদারিতে। চেষ্টা করতে হবে খারেজি মাদ্রাসাগুলিকে সরকারি অনুমোদনের আওতায় আনার।

তবে মনে রাখতে হবে, অনুমোদন না পেলেও সংবিধানের ৩০ নং ধারা অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের ‘ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র’ খোলার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। সুতরাং, অনুমোদনহীন মাদ্রাসাকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে, তাও ভ্রান্তিকর ও বিদ্বেষমূলক। রাজ্য বা দেশ জুড়ে চলছে বহু টোল বা চতুষ্পাঠী, যেখানে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রই পড়ানো হয়। সুতরাং, ধর্মশিক্ষাকে অবৈধ ও সন্ত্রাসী বলে বৈষম্য সৃষ্টি অশুভ প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।

তালপুকুর আড়া হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক

kaji masoom akhtar madrasah
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy