Advertisement
E-Paper

মাফলার উড়ছে

আমি ভুল হয়ে গেলে ঘাড় শক্ত করে সেটাকেই ঠিক বলে চালাবার চেষ্টা করি না, মাথা নিচু করে ‘সরি’ বলতে পারি, এটাই আমার শক্তি।ফিনিক্স পাখির গপ্পোটা বহুত পুরনো। এ বার নতুন হোক। কেউ তার নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে গলার মাফলারটা একটু সেট করে নিলে, তাকে আমার নামে ডাকা হতে পারে। কামব্যাক অবশ্য বহুত হয়েছে, মহিন্দর অমরনাথ বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তো ফট করে মাথায় আসেনই, রাজনীতিতেও ও-জিনিস জলভাত। কিন্তু সেটা প্রফেশনালদের ফিরে আসা।

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০

ফিনিক্স পাখির গপ্পোটা বহুত পুরনো। এ বার নতুন হোক। কেউ তার নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে গলার মাফলারটা একটু সেট করে নিলে, তাকে আমার নামে ডাকা হতে পারে। কামব্যাক অবশ্য বহুত হয়েছে, মহিন্দর অমরনাথ বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তো ফট করে মাথায় আসেনই, রাজনীতিতেও ও-জিনিস জলভাত। কিন্তু সেটা প্রফেশনালদের ফিরে আসা। সাধারণ মানুষ, বা অ্যামেচার, মানে জাস্ট সদিচ্ছাময় এক জন লবি-হীন লোক, কখনও ফিরতে পারে না। সে কোথাও যেতেই পারে না, তো আবার ফিরে আসাআাসি। সে যে এক বার একটা সিংহাসনে ক’দিন গা-গরম করে, ৪৯ দিন পর সব ছেড়ে দিয়ে ‘ছো ছো পলায়ন-ম্যান’ আওয়াজ খেয়ে, আবার বীর বীক্রমে ফেরত আসতে পারে, এ শুধু আমি দেখাতে পারলাম। তার কারণই হল, আমি সাধারণ।

আমার সোয়েটার ঢলঢলে, মাফলার সাদামাটা। আমার প্রায়ই কাশি, জ্বর, গলাব্যথা। রটনা আছে, একটা টিভি শো-য়ে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কফি খাবেন, না কাফ সিরাপ? ঠিকই তো। রোগাভোগা, বেচারা-কাটিং লোক আমি। ডায়াবিটিস আছে। মুখটা দেখলেই মনে হয়, এ ইতিহাসের ঘোড়সওয়ার হওয়ার জন্যে আসেনি। আবার একই সঙ্গে এ-ও মনে হয়, এ গরিবের টাকা মেরে নিজের সাতমহলা বানাবে না। আমার ক্যারিশমা নেই, আবার ধুরন্ধরপনাও নেই। আমার ঢাল হচ্ছে সেরেফ সততা। আমার নামে জোক ছড়িয়ে পড়েছে, আমি এত সত্‌ যে ম্যাকডোনাল্ডসে বার্গার খেলে একটার বেশি সসের প্যাকেট নিই না। এত সত্‌ যে বাড়িতে পার্টি দিলে নিজেই রাত দশটায় পুলিশ ডাকি। এত সত্‌ যে থার্ড আম্পায়ার আউট দেওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেয়। আমি এগুলো বেশ উপভোগ করি। যার নাক খুব বড়, তার নাক নিয়ে চুটকি হয়। যার সততা খুব বড়, তার সততা নিয়ে। এ বোধহয় আমিই দেখালাম, অন্তত ভারতে, যে, ক্যারিশমা-হীনতাও একটা যুগে গিয়ে ক্যারিশমা হয়ে উঠতে পারে। রাজার মতো হাবভাব হলে লোকে মুগ্ধ হয়, আবার প্রজার মতো হাবভাব হলে প্রজারা তাকে বিশ্বাস করে। এটা প্রজাতন্ত্রে খুব বড় সুবিধে। এই যে চুটকি গজিয়েছে, আমি কম্পিউটারে অ্যান্টি-ভাইরাস লাগাই না কারণ নিজের সিকিয়োরিটির বন্দোবস্ত প্রত্যাখ্যান করেছি, এটা আমার কাছে খুব গর্বের। লোকে তার মানে মনে করছে, মেট্রোয় চড়ে প্রথম শপথ নিতে যাওয়াটা গিমিক ছিল না, একটা বার্তা ছিল। আমি তোমাদেরই লোক, তোমার বডিগার্ড নেই, আমারও না-হোক।

আসলে, যে শিক্ষাদীক্ষার এক-আধটু ভাগ লোককে দিতে চাই, তার আবশ্যিক উপাদান হল বিনয়। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও যে ধরনায় শামিল হয়েছিলাম, ওই যে ছবিটা আপনারা দেখেছেন, রাস্তায় পাশ ফিরে শুয়ে আছি, ফুল-ফুল লেপ গায়ে দিয়ে, তাতে কোনও শয়তানি নেই। অনেকের মতে, নির্বুদ্ধিতা আছে। অ-দূরদর্শিতা আছে। হতে পারে। সামান্য কারণে শহরের রাস্তায় যান-চলাচল বিঘ্নিত করছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী— এ ভাবেই ব্যাপারটা দেখানো হয়েছিল। ‘সামান্য’ অবশ্য আমার মনে হয়নি, দুর্নীতি দূর করতে এ দেশে অ্যানার্কি বা নৈরাজ্যও কখনও-সখনও দরকার বলে মনে করি, রাস্তা ক’দিন বন্ধ হোক যদি তাতে অনেক রাস্তা ভবিষ্যতে খোলে। কিন্তু সেই মনে-করাকরির মধ্যেও কোনও ঔদ্ধত্য নেই, একটা চেষ্টা আছে, বিনয়ী চেষ্টা, এইটুকু বারবার বোঝাতে চাইছি। হতেই পারে, ভুল করেছিলাম। যেমন ৪৯ দিন পর প্রতিবাদ করে গদি ছেড়ে ভুল করেছিলাম, তখন যেটা বিদ্রোহ ভেবেছিলাম সেটা আমার হাজার হাজার সমর্থক মানুষের বিশ্বাস ভাঙছে সেটা বুঝতে পারিনি। মাসদুয়েক বাদে তাই ক্ষমা চেয়েছিলাম। ‘সরি’ বলেছিলাম। আমার কথা এটাই। আমি ইন্দ্রজাল কমিক্সের সুপারহিরো নই। আমি সব পারি, সবার চেয়ে বেশি বুঝি, জানি, সবচেয়ে দূরে দেখতে পাই— এ আমার দাবি নয়। আমার হাতে একটা ম্যাজিক-লাঠি আছে, তাই দিয়ে রাতারাতি স্বর্গটাকে দিল্লির ওপর সুপার-ইমপোজ করে দেব— এও বলার স্পর্ধা আমার নেই। এটা বলার বোকামিও আমার নেই। আমি চাই, সাধারণ মানুষ শহরের, রাজ্যের, দেশের মূল সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অংশী হবেন, মানুষই সরকার হবেন। ওপর থেকে সবাই সব চাপিয়ে দেবে আর মুখে বলবে তুমিই দেবতা হে ভোটার, এ ভড়ং চলবে না। আমি ভুল হয়ে গেলে ঘাড় শক্ত করে সেটাকেই ঠিক বলে চালাবার চেষ্টা করি না, মাথা নিচু করে ‘সরি’ বলতে পারি, এটাই আমার শক্তি। সাধারণ মানুষকে আমি সত্যিই নিয়ন্তা মনে করি, এই সরি-ই তার প্রমাণ।

ভারতে, রাজনীতি করব আর হামবড়াই করব না, কেউ দেখেনি শোনেনি। রাজনীতিকরা নিজেদের বেঁটে বেঁটে ভগবান হিসেবে প্রোজেক্ট করেন। মঞ্চেও, বোধহয় আয়নাতেও। তিনি যা বলেন তা-ই বেদবাক্য, যা লেখেন তা-ই মহাকাব্য, তাঁর ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। আমি তো ভাবতেই পারি না, নিজের শরীর নিয়ে গর্ব একটা পলিটিকাল ক্যাম্পেনের অঙ্গ হতে পারে। এ তো আইটেম নাম্বার! এও ভাবতে পারি না, নিজের কোট ভর্তি করে নিজের নাম লিখে রাখা যায়। অহং-এর এর চেয়ে কদর্য প্রদর্শনী হয়! আমি এই ‘এইট প্যাক’বাজি-র উলটো দিকে, মলিন আর্ট ফিলিম হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাজেট বেশি নয়, এক এক জায়গায় ক্যামেরা নড়ে গেছে, কিন্তু ছবিটা মানুষ নিয়ে। থ্রিলার নয়, মারদাঙ্গা নয়, পৌরাণিক প্লাস্টিক সার্জারি নয়। মানুষ। তার জলকষ্ট। তার ইলেকট্রিক বিল অন্যায় বেশি এলে, অসহায় রাগ। সিনেমা হিট হবে কি না, জানি না। কিন্তু কিছু শিক্ষিত লোকের হয়তো মনে হবে, সুপারম্যানের চেয়ে মাফলারম্যানের উষ্ণতা বেশি!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy