Advertisement
E-Paper

মৌলবাদ, যে রঙেরই হোক, ভয়ানক

আইএসআইএস সশস্ত্র জঙ্গিরা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া/লেভান্ত পরিচয় থেকে এখন নিজেদের অধিকৃত ইরাক আর সিরিয়ার অংশকে নাম দিয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা খিলাফত। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে তারা মসুল-নিবাসী পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী ও তার চেয়েও প্রাচীন জরথুষ্ট্রপন্থী ইয়েজিদি সম্প্রদায়কে ফতোয়া দিয়েছে: হয় ইসলাম নয় মৃত্যু।

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
‘রক্ষা করো’। আইএস-এর নারীবিরোধী নীতি ও কুকীর্তির প্রতিবাদে। বসরা, ইরাক। ছবি: এএফপি

‘রক্ষা করো’। আইএস-এর নারীবিরোধী নীতি ও কুকীর্তির প্রতিবাদে। বসরা, ইরাক। ছবি: এএফপি

আইএসআইএস সশস্ত্র জঙ্গিরা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া/লেভান্ত পরিচয় থেকে এখন নিজেদের অধিকৃত ইরাক আর সিরিয়ার অংশকে নাম দিয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা খিলাফত। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে তারা মসুল-নিবাসী পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী ও তার চেয়েও প্রাচীন জরথুষ্ট্রপন্থী ইয়েজিদি সম্প্রদায়কে ফতোয়া দিয়েছে: হয় ইসলাম নয় মৃত্যু। এর পর পাহাড় মরুভূমি পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের পলায়ন, অভাবনীয় হত্যাকাণ্ড, জিয়ন্তে পুঁতে ফেলার খবরের পরে একের পর এক পশ্চিমী সাংবাদিক ও সমাজকর্মীর জবাইয়ের ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠলাম। যে কাহিনিগুলো বাইরে এল, তাতে মনে হল ইসলামকে বিশুদ্ধ করার দায়টা প্রাথমিক ভাবে মেয়েদেরই নিতে হবে। তিন বছর আগে ইরাকি জনগণ স্লোগান দিয়েছিল, ‘বাগদাদ কান্দাহার নয়’, এ বার মসুল শহরে দেওয়ালে দেওয়ালে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা ‘নিনেভ কান্দাহার নয়... আমাদের রক্ষা করো’। আফগানিস্তানে কান্দাহার ছিল তালিবানের সদর দফতর। হুকুম জারি হয়েছিল সেখানে: পুরো মুখ ঢাকা বোরখা না পরলে মেয়েদের মরতে হবে। ইয়েজিদি মেয়েরা যুদ্ধের লুঠ হিসেবে যথেচ্ছ ধর্ষিত, খ্রিস্টান মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া— এই তো বিধর্মীর উপযুক্ত শাস্তি। বেড়ে গেছে শিশু ‘বিবাহ’। সাত বছরের মেয়েকেও বিয়ে করে শয্যাসঙ্গী করা হচ্ছে।

আইএস অধিকৃত মসুলে মেয়ে ডাক্তারদের বলা হয়েছে, তাঁদের পুরো শরীর ঢাকা বোরখা, হাতে দস্তানা পরতেই হবে, যাতে শরীরের কোনও অংশ দেখা না যায়। মসুলের হাসপাতালে দুই ডাক্তারনি, সালওয়া মোহাজের আর আনসাম আল-হামদানি তাঁদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কে লিখেছেন, চিকিৎসকের ভীষণ অভাব। সবাই প্রায় পালিয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও এই সব ফতোয়া মেনে ডাক্তারি করছেন, নির্ধারিত পোশাকে রোগিণীদের দেখা এবং শল্যচিকিৎসা করা সম্ভব নয় বললে বলা হয়েছে, নির্ধারিত পোশাক পরা অনেক বেশি জরুরি। মেয়েদের বিভাগে পুরুষ জঙ্গিরা সব সময় ঢুকে আসছে নজরদারি করতে। এবং এমনকী ডাক্তার ও নার্সরাও ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচেননি। জুন মাসে মসুল দখলের পরে এক সপ্তাহেই আঠারোটি ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, যেখানে চার জন নিগৃহীতা ও এক জনের ভাই আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।

সবচেয়ে চিন্তার— মসুলে বিজ্ঞপ্তি পড়েছে, ১১ থেকে ৪৯ বছরের সব মেয়েকে ‘ছুন্নত’ করতে হবে। মেয়েদের ছুন্নত ব্যাপারটা আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে আর মুসলিম দেশে চালু রয়েছে। এতে মেয়েরা যাতে কখনও যৌন আনন্দ না পেতে পারেন, এবং শুধু মাত্র শৌচকার্য আর সন্তানজন্মের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াটি চালাতে পারেন, সে জন্য জন্ম থেকে সাধারণত পনেরো বছর বয়সের মধ্যে মেয়ের যৌনাঙ্গের প্রায় সবটুকু কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এটা সাধারণত করে নাপিত ধরনের মানুষেরা। ছুরি, কাঁচি, দাড়ি কামানোর রেজর প্রভৃতি দিয়ে। তাদের প্রায়শই কোনও প্রশিক্ষণ থাকে না। মেয়েটি রক্তক্ষরণে বা সংক্রমণে মারা যেতে পারে, বেঁচে গেলে সারা জীবন অস্বস্তি, বার বার সংক্রমণ, অসুস্থতা নিয়ে আধা জীবন যাপন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে সারা পৃথিবীতে প্রায় বারো কোটি মেয়ে এর শিকার। মিশর আর সোমালিয়ায় প্রায় সমস্ত মেয়েদের এই ছুন্নত হয়, অন্যত্র, এমনকী পশ্চিমেও কমবেশি ঘটে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে হলেও ইরাক বা সিরিয়া হত না। তা হলে এখন কেন? ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা বয়েছে, ‘এটি মেয়েদের বিপথে চালিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।’

এই খিলাফতের রাজধানী সিরিয়ার আল রাকা শহরে মেয়েদের ইসলামি অনুশাসন পালনের জন্য তৈরি হয়েছে আল খানসা ব্রিগেড। তারা শহরের নামি হামিদা তাহের গার্লস স্কুলে অভিযান চালিয়ে দশ ছাত্রী, দুই শিক্ষিকা ও এক সেক্রেটারিকে গ্রেফতার করে ছ’ঘন্টা আটকে রাখার পর কয়েক জনকে শাস্তি হিসেবে ৩০ ঘা করে বেত মেরে তার পর ছেড়েছে— কারণ তাদের অনেকের মুখের বোরখার সামনের কাপড়টুকু ছিল খুব পাতলা আর কয়েক জন এমন ভাবে ক্লিপ এঁটেছিল যাতে মুখের অনেকটা দেখা যায়। এই সব অনুশাসনের সঙ্গে বিয়ের জন্য অফিসও খোলা হয়েছে। বলা হয়েছে কুমারী মেয়েরা জিহাদিদের শয্যাসঙ্গী হয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে পারে। এক দিকে মেয়েরা যাতে পুরুষের চিত্তচাঞ্চল্য না ঘটাতে পারে, তার জন্য নানা নিষেধ, এমনকী পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড, অন্য দিকে মেয়েদের শরীরকে জেহাদিদের যথেচ্ছ ব্যবহার, মেয়েদের অধিকারে এই দ্বিবিধ হস্তক্ষেপ হয়েই চলেছে এই খিলাফতে।

দুই পশ্চিমি সাংবাদিককে যে জবাই করে, ভিডিয়োতে সেই জঙ্গি কথা বলছিল ব্রিটিশ উচ্চারণে। ব্যাপারটা তাৎপর্যপূর্ণ। শিশুকন্যাদের ক্ষমতায়নের জন্য এই জুলাইয়ের ‘গার্ল সামিট’-এ, যেখানে আমাদের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প ‘গুড প্র্যাকটিস’ হিসেবে বাহবা কুড়িয়েছে, সেখানে আয়োজক দেশ ব্রিটেনের মুখ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, ব্রিটেনে বছরে ১০,০০০ মেয়েকে ছুন্নত করা হয়, যদিও এটি ১৯৮৫ সালে সে দেশে নিষিদ্ধ হয়। সোমালি লেখিকা আয়ান হিরসি আলি আত্মজীবনী ‘ইনফিডেল’-এ নিজের, ছোট বোনের ছুন্নতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নেদারল্যান্ডস-এ সমাজতন্ত্রী দলকে সেই দেশে এই প্রথার ব্যাপকতা ও তা বন্ধ করতে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়াতে তাঁর ব্যর্থতার কথা কবুল করেছেন। কারণ সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, যা বলে সংখ্যালঘুর কোনও নিজস্ব প্রথা গোষ্ঠীর একাংশকে দমিয়ে রাখলেও তাতে হাত দেওয়া যাবে না।

আশির দশকে ফ্রান্স মুসলিম অভিবাসীদের একাধিক স্ত্রী আনতে চুপচাপ অনুমতি দিয়েছিল। ২০০০ সালের হিসেবে, শুধু প্যারিসেই দু’লক্ষ পরিবারে একাধিক স্ত্রী আছে। ১৯৯৫ সাল থেকে সরকার শুধুমাত্র একটি স্ত্রী ও তার সন্তানকেই বৈধ বলে স্বীকৃতি দেবে বলে ঘোষণা করে। কেন অভিবাসনের শর্ত হিসেবে প্রথমেই সেটা বলা হয়নি? বিভিন্ন পশ্চিমি দেশ, যেমন ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গোষ্ঠীর অধিকারের নামে বাল্যবিবাহ, জোর করে বিয়ে, একতরফা বিচ্ছেদ, মেয়েদের ছুন্নত, বোরখা, সম্মানের নামে হত্যা এ সবকে ‘অধিকার’-এর তকমা দিয়ে রেখেছে। মামলা হলে গোষ্ঠীর অধিকার ও সাংস্কৃতিক বহুত্বের নামে অভিযুক্তরা হালকা শাস্তি বা ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। এই বহুত্ববাদ প্রায়শ একটি গোষ্ঠীর গোঁড়া অংশটিকে লালিত ও পুষ্ট করে। এই ভাবে লালিত ও পুষ্ট হয়ে আজ বহু পশ্চিমিও আই এস-এ যোগ দিতে আকৃষ্ট হয়েছে। এদের কালো পতাকা দেখা গিয়েছে নিউ জার্সিতে, প্যারিসে।

আই এস-এর উত্থানকে শুধু শিয়া-সুন্নির বিরোধ ভাবলে চলবে না। ধর্মীয় মৌলবাদের ছড়ানো শিকড় এখনই কাটতে না শুরু করলে আমরা সবাই বিষবৃক্ষের ফল খেতে বাধ্য হব। মেয়েদের সর্বনাশ হবে সবচেয়ে বেশি, তা গেরুয়া বা সবুজ যে বৃক্ষই হোক না কেন। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ধর্মপ্রচারকদের এখনও এ সব নিয়ে টুঁ শব্দ করতে শুনিনি, এঁদের অনেকেই কিন্তু মুক্তচিন্তার শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতায় জেলায় ও কলকাতায় পথে নেমেছিলেন।

editorial fundamentalism saswati ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy