Advertisement
E-Paper

মঞ্জুলবাবুর সিদ্ধান্ত বনাম মতুয়া স্বার্থ

মতুয়া সম্প্রদায় কি সংঘবদ্ধ ভোট-ব্যাংক হিসেবে আর কাজ করবে? যদি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের জেরে সমষ্টির ঐক্য বিঘ্নিত হয়, তবে তাঁদের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমবে, যেমনটি ঘটেছিল দেশভাগের পর।পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মতুয়া মহাসঙ্ঘের উত্থান ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই একটা বড় খবর। এই ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন পি আর ঠাকুর। সেই ১৯৮০-র দশক থেকেই তিনি নীরবে, খানিকটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই, একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
আছেন গৌতম দেব (বাঁ দিকে), মুকুল রায়ও (ডান দিকে)। মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভা। ডিসেম্বর ২০১০

আছেন গৌতম দেব (বাঁ দিকে), মুকুল রায়ও (ডান দিকে)। মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভা। ডিসেম্বর ২০১০

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মতুয়া মহাসঙ্ঘের উত্থান ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই একটা বড় খবর। এই ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন পি আর ঠাকুর। সেই ১৯৮০-র দশক থেকেই তিনি নীরবে, খানিকটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই, একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। চেহারায় সামাজিক হলেও এই সংগঠন ছিল মূলত রাজনৈতিক। সেই সংগঠন ও তার বিপুল সদস্য-সংখ্যাকে মূলধন করেই এই শতকের প্রথম দশকে মহাসঙ্ঘের নেতৃত্ব রাজনীতির আসরে নামলেন।

এর কারণটা আমরা অনেকেই ভেবে দেখিনি। আর তাই মূলত নিম্নবর্ণের/বর্গের এই রাজনীতি নিয়ে প্রায়ই নানা তির্যক মন্তব্য শোনা যায় ভদ্র লোকসমাজে। এই রাজনীতিকে আমরা অনেকেই প্রগতিশীল সেকুলার রাজনীতির চিরাচরিত ধারণার পরিপন্থী বলে মনে করি।

কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে ক্ষমতার অলিন্দে ঢোকার রাস্তাটা এত সংকীর্ণ যে নিম্নবর্ণের খুব কম মানুষই সেখানে প্রবেশ করতে পেরেছেন। আর ইতিহাস ঘাঁটলে এটাও দেখা যাবে যে, ক্ষমতার বৃত্তে না থাকার দরুন তাঁদের অনেক ন্যায্য দাবিই অপূর্ণ থেকে গেছে। তাই নিজেদের আত্মপরিচয়কে কেন্দ্রে রেখে এই মানুষগুলি যে সঙ্ঘবদ্ধ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁরা যতই সংগঠিত হোন না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ক্ষমতাগত চাপ এমনই যে, ক্ষমতার অলিন্দে ঢোকা বড় রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব নয়। এই চাপে পড়েই বার বার তফসিলি জাতি আন্দোলনের নেতারা বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন— তা ১৯৪৬-৪৭ সালে কংগ্রেস-মুসলিম লিগই হোক আর বর্তমানে সিপিএম-তৃণমূল কংগ্রেস অথবা বিজেপি-ই হোক। এর ফলে তাঁদের আন্দোলনের খুব সুবিধা হয়েছে তা নয়। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা ঘটেছে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির কাঠামোগত চাপের ফলেই।

মতুয়া মহাসঙ্ঘের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কার্যকলাপের পিছনে চাপটা কী ছিল? তাদের প্রধান দাবি ছিল, ২০০৩ সালের সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট পরিবর্তন করা। যাতে বলা হয়েছিল, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর যারা ভারতে এসেছেন, তাঁরা কোনও ভাবেই ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন না। এখন প্রশ্ন হল, এই আইনের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগটা ঠিক কী? এর উত্তরের জন্য আমাদের কিছুটা পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে হবে।

প্রকৃত অর্থেই তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ববাংলার নমঃশূদ্র কৃষক সম্প্রদায়ের সামাজিক উত্থানের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে। ফরিদপুরের ওরাকান্দি গ্রামে হরিচাঁদ ঠাকুর একটি মূলত ধর্মীয় আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ১৮৭০-এর দশকে। তার পর তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এই আন্দোলন সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত হয়। ক্রমশ এই আন্দোলন আর নমঃশূদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না, নিম্নবর্গের আরও অনেক মানুষই এতে যোগ দিলেন আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নতির আশায়। ১৯১৫ সাল নাগাদ মতুয়া মহাসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হল, ১৯৩০-এর দশকে যার নেতৃত্ব নিলেন গুরুচাঁদের পৌত্র বিলেতফেরত ব্যারিস্টার প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যিনি পি আর ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত।

১৯২০-র দশকে যখন গাঁধীবাদী গণ-আন্দোলনের জোয়ার এসেছে, গুরুচাঁদ ঠাকুর তখন নমঃশূদ্র আন্দোলকে মূলস্রোতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে রেখেছেন। কিন্তু স্বকীয় রাজনীতির এ পথে পরিবর্তন আনলেন পি আর ঠাকুর, দেশভাগের ঠিক আগে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে। তাঁর পথ পরিবর্তন সব তফসিলি নেতারা মেনে নেননি। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে তফসিলি জাতি ফেডারেশন অম্বেডকরপন্থী হয়েছেন এবং পরে মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। অর্থাত্‌ তফসিলি আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে আনুগত্যের প্রশ্নে।

এর ফল ভাল হয়নি। কোনও বড় রাজনৈতিক দলই তাদের স্বার্থ দেখেনি। যোগেনবাবুকে ১৯৫০ সালে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে পাকিস্তান থেকে চলে আসতে হয়েছে। পি আর ঠাকুর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯৬৪-তে কংগ্রেস ছাড়েন। ১৯৭০-এর দশক থেকে তিনি মতুয়া মহাসঙ্ঘকে পুনর্গঠিত করার কাজে হাত দেন মূলত ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠন হিসেবে, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বাইরে।

পূর্ববঙ্গের মতুয়াভক্ত নমঃশূদ্র কৃষক সম্প্রদায় ১৯৫০-এর পর থেকেই দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর পরেও স্রোত অব্যাহত থাকে। কাজেই ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন সরাসরি ভাবে মতুয়া সম্প্রদায়ের অনেকেরই স্বার্থের পরিপন্থী। তাঁরা এই আইন সংশোধনের অনেক চেষ্টা এর আগে করেছেন প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু কাজ হয়নি। এটাই সম্ভবত তাঁদের সরাসরি রাজনীতির আসরে নামার পিছনে একটা বড় কারণ।

এই সময়ে সিপিআইএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই তাঁদের সমর্থনপ্রার্থী হয়েছে, অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কারণ এটা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল যে, তাঁদের সাংগঠনিক সমর্থন ছাড়া উত্তর ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার কেন্দ্রগুলিতে নির্বাচন জেতা যাবে না। বেশ টানাপড়েনের পরে মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপাণি দেবী— যিনি প্রয়াত পি আর ঠাকুরের পত্নী, তৃণমূল কংগ্রেসের দিকেই ঝুঁকলেন। নির্বাচনে জিতে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মঞ্জুলকৃষ্ণ মন্ত্রী হলেন। পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কপিলকৃষ্ণও তৃণমূলের সমর্থনে লোকসভায় নির্বাচিত হলেন। কিন্তু নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কাজ খুব একটা এগোল বলে মনে হয় না, যদিও মঞ্জুলকৃষ্ণ ছিলেন উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের মন্ত্রী।

কপিলকৃষ্ণের অকালমৃত্যুর পর তাঁর বনগাঁ কেন্দ্রে কে প্রার্থী হবেন, এই নিয়ে বিরোধের জেরে মঞ্জুলবাবু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এই নিয়ে আবার রাজনৈতিক জগত্‌ উত্তাল হয়েছে। নীতির প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রশ্ন উঠছে। তবে বলা ভাল যে, ভারতীয় রাজনীতিতে তো এখন নীতির জায়গাটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া কোন নেতাই বা রাজনীতি করতে আসেন! সুতরাং, এই প্রশ্নগুলো যদি আমরা অন্য নেতাদের ক্ষেত্রে জোর দিয়ে না তুলি, শুধু মঞ্জুলবাবুর ক্ষেত্রে তা এত জোরালো হবে কেন?

আসল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা অন্য। মঞ্জুলবাবুর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তটা মতুয়া সমাজের সমষ্টিগত স্বার্থের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে? বিজেপি কি নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাবে? সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই আইনের ব্যাপারটা এতই জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয় যে, এর খুব দ্রুত কোনও সমাধান হওয়ার আশা কম।

কিন্তু নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে এই আন্দোলনের ঐক্য বিঘ্নিত হওয়ার বেশ সম্ভাবনা আছে। কয়েক জন মতুয়া-ভক্তের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে যে, তাঁরা যেন ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে একটা প্রভেদ করতে শুরু করেছেন। ঠাকুর হরি-গুরুচাঁদে তাঁদের অচলা ভক্তি, তাতে চিড় ধরার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু মতুয়া নেতৃত্বের রাজনৈতিক দলাদলি তাঁদের খুব একটা খুশি করেনি।

এই মতুয়া সম্প্রদায় কি সংঘবদ্ধ ভোট-ব্যাংক হিসেবে আর কাজ করবে? সেটা যদি না করে, যদি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের জেরে সমষ্টির ঐক্য বিঘ্নিত হয়, তবে এদের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমবে, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল ১৯৪৬-৪৭-এর বিভাজনের পর। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির চাপ এই ভাবেই প্রান্তিক আন্দোলনগুলিকে দুর্বল করে ও আত্মসাত্‌ করে। তাদের দাবিগুলো অপূর্ণই থেকে যায়।

নিউ জিল্যান্ড ইন্ডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর ডিরেক্টর

post editorial sekhar bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy