স্কুল-শিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় প্রার্থীদের সাফল্যের হার দুই শতাংশেরও কম। পরিসংখ্যানটি যে লজ্জার, তাহা উপলব্ধি করার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নাই। এই রাজ্যেও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক প্রার্থীদের সাফল্যের হার এমনই চমকপ্রদ। কিছু কাল আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতামান যাচাইয়ের পরীক্ষায় ৩৫ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্রই এক শতাংশ পাশ করিয়াছিলেন। বর্তমানে আলোচ্য পরীক্ষাটিতে সেই সব প্রার্থীই বসার সুযোগ পান, যাঁহারা উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ এবং কোনও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হইতে প্রাথমিক শিক্ষকের ডিপ্লোমা সংগ্রহ করিয়াছেন। উচ্চ-মাধ্যমিকের বিদ্যা কিংবা শিক্ষক-ডিপ্লোমা, কোনওটিই যে তাঁহাদের যোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয় নাই, তাহা স্পষ্ট।
প্রথম হইতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ক্লাস লওয়ার জন্যই এই প্রবেশিকা পরীক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার ওই পর্বটি শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বেই পড়ুয়ারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করিতে, প্রশ্ন করিতে, বিশ্লেষণ করিতে শেখে। মুখস্থবিদ্যা উৎসাহিত করার পরিবর্তে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা জাগাইয়া তোলাই এই পর্বের শিক্ষকদের কাজ। এ জন্যই যোগ্যতাসম্পন্ন, ছাত্রদরদি শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, যাঁহারা পড়ুয়াদের কেবল মুখস্থ করিতে নয়, চিন্তা করিতে, বিচার-বিবেচনা করিতে এবং সিদ্ধান্ত লইতে সাহায্য করিবেন। সে জন্য শিক্ষকদের নিজেদের উপযুক্ত হইতে হইবে। প্রবেশিকা পরীক্ষাটি আয়োজনের গুরুত্ব এখানেই। কিন্তু সেই পরীক্ষায় যদি মাত্র দুই শতাংশ পরীক্ষার্থী কৃতকার্য হন, তবে প্রাথমিক শিক্ষার অপরিহার্য পরিকাঠামোটির কী গতি হইবে? একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, শিক্ষক হইতে উৎসুক পরীক্ষার্থীরা নিজেরাও মুখস্থবিদ্যানির্ভর প্রশ্নগুলির উত্তর দিতেই অপেক্ষাকৃত সফল। কিন্তু যেখানেই ভাবিয়া-চিন্তিয়া উত্তর করিতে হইবে, বাঁধা গতের বাহিরে কিংবা চেনা ছকের বাহিরে গিয়া উত্তর লিখিতে হইবে, সেখানেই বসিয়া-বসিয়া পেন্সিল কামড়াইয়াছেন।
যাঁহাদের নিজেদের শিক্ষা বহুলাংশে অসম্পূর্ণ থাকিয়া গিয়াছে, তাঁহাদের উপরেই যদি ন্যস্ত হয় দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তোলার ভার, তাহার পরিণাম উদ্বেগজনক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার বনিয়াদটি নড়বড়ে থাকিয়া গেলে কেবল উচ্চশিক্ষা নয়, রাজনীতি, প্রশাসন সহ সমাজ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রই অপরিণত, অনুন্নত থাকিয়া যাইবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকে তাকাইলে এই সার্বিক অবনমনের চিত্রটি স্পষ্ট হইয়া ওঠে। প্রাথমিক শিক্ষার দুর্বল বনিয়াদ যে সেই অধঃপাতের অন্যতম কারণ, তাহা অস্বীকার করার উপায় নাই। দুর্নীতিপরায়ণ ও অপরাধপ্রবণ রাজনীতিক, ফাঁকিবাজ আমলা, দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনিক অফিসার, পীড়নকারী পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের উচ্ছন্নে যাওয়া কর্মসংস্কৃতি— এ সব কিছুর পিছনেই শৈশব-কৈশোরের অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত প্রাথমিক শিক্ষার অবদান থাকে। যাঁহাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা মিলিতে পারিত, তাঁহারাই প্রয়োজনীয় যোগ্যতামান অর্জনে এই হারে অকৃতকার্য হইলে ভরসা করার মতো বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। পরীক্ষার প্রাসঙ্গিকতা লইয়া কূটপ্রশ্ন না তুলিয়া বা পরীক্ষাকে অগ্রাহ্য না করিয়া কী ভাবে শিক্ষকদের যোগ্যতা বাড়ানো যায়, নীতিকাররা সে দিকে নজর দিন।