Advertisement
E-Paper

শিখেছিলাম, ‘মা বিদ্বিষাবহৈ’

শাস্ত্রজ্ঞরা বুঝেছিলেন, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ অপ্রীতি নিন্দা ঢুকে পড়লে শিক্ষার খুব বড় ক্ষতি হবে। কত বড় ক্ষতি, আমরা রোজ তা দেখছি। লিখছেন বিশ্বজিত্‌ রায়।সত্যজিত্‌ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে খবরের কাগজ পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি আমাদের মনে আছে। কিন্তু আমাদের শহরের দিনরাত্রিতে তো কাগজ পোড়াতে পারি না। প্রায় প্রতিদিন কাগজের নানা খবর আমাদের পোড়ায়। বিশেষ করে শিক্ষাজগতের অজস্র মন খারাপ করা খবর।

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০

সত্যজিত্‌ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে খবরের কাগজ পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি আমাদের মনে আছে। কিন্তু আমাদের শহরের দিনরাত্রিতে তো কাগজ পোড়াতে পারি না। প্রায় প্রতিদিন কাগজের নানা খবর আমাদের পোড়ায়। বিশেষ করে শিক্ষাজগতের অজস্র মন খারাপ করা খবর। পড়ি, দেখি, শুনি, আর মনে হয়, এক ‘অসহযোগ’ আর ‘অবিশ্বাস’-এর জগতে বাস করছি আমরা। সহপাঠীরা সহপাঠীদের, পড়ুয়ারা শিক্ষকদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ অবস্থা নিশ্চয়ই রাতারাতি গড়ে ওঠেনি, রাতারাতি এর হাত থেকে রেহাইও পাওয়া যাবে না।

কিছু পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠল। জানি, স্মৃতিকাতরতা এক রকম অসুখ হিসেবেই পরিগণিত। নস্টালজিয়া শব্দের ঠিকুজি-কুলুজি ঘাঁটলেও তা টের পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর ডাক্তারির ছাত্ররা চিহ্নিত করেছিলেন এই রোগের রকমসকম: অতীতচারণা, ঘরে ফেরার জন্য অবুঝ মন-খারাপ, তীব্র শারীরিক যন্ত্রণার কারণ। তা ছাড়া, ‘সে কালের সব ভাল আর এ কালের সবই খারাপ’ জাতীয় মনোভাবও অনেক সময় অতীতচারণে প্রশ্রয় পায়। তবু, এই সব তিরস্কারকে অমান্য করেই স্মৃতি দখল নিল মনের। মনে পড়ল একটি সংস্কৃত শ্লোক।

গত শতকের আশির দশক। প্রান্তিক জেলা পুরুলিয়ার একটি আবাসিক বিদ্যালয়। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ। আমাদের ছোটবেলার ইস্কুলে লেখা থাকত ‘শ্মশানের বুকে রোপণ করেছি আমরা পঞ্চবটী/ তাহারই তলায় মিলাব আমরা জগতের শতকোটী’। সত্যিই, পুরুলিয়ার এই বিদ্যালয়টিতে সারা ভারত থেকে পড়ুয়ারা আসতেন, এখন সারা পৃথিবীতে এই বিদ্যালয়ের সফল ছাত্ররা ছড়িয়ে আছেন। রোজ স্কুল বসার আগে যে প্রেয়ার হত তাতে একটি সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ ছিল আবশ্যিক। আমরা কেউই সংস্কৃতজ্ঞ ছিলাম না। কিন্তু স্তোত্রটি কানে ও মনে লেগে গিয়েছিল। কৃষ্ণযজুর্বেদীয় কঠোপনিষদের শান্তিমন্ত্র সেটি। প্রার্থনা করা হচ্ছে, ব্রহ্ম যেন গুরু-শিষ্যকে সমান ভাবে রক্ষা করেন, বিদ্যাফল যেন সমভাবে দান করেন, গুরু-শিষ্য যেন সমান সামর্থ্য অর্জন করেন, উভয় পক্ষের প্রাপ্ত বিদ্যা যেন সমান সফলতা পায়। এই অবধি শ্লোকটি বুঝতে কোনও অসুবিধে হত না। ব্রহ্ম-ট্রহ্ম বাদ দিয়ে এক রকম মানে করে নেওয়া যেত। সত্যিই, সাফল্য ও সামর্থ্য লাভের জন্যই তো বিদ্যাচর্চা, বিদ্যার্জন। গুরু-শিষ্য দুইয়ের জীবনেই সাফল্য-সামর্থ্য থাকে যদি, তবেই তো প্রতিষ্ঠান, সমাজ, দেশ খুশি হবে। প্রাচীন ঋষিরা যে বাস্তববোধরহিত ছিলেন না, এতে তা দিব্যি টের পাওয়া যেত। কিন্তু এই শান্তিমন্ত্রের শেষের দিকটি তখন কিছুতেই মাথায় ঢুকত না। সেখানে ছিল, ‘মা বিদ্বিষাবহৈ’, আমরা যেন পরস্পরকে বিদ্বেষ না করি। ভাবতাম, এ আবার কী! মাস্টারমশাইদের আমরা কেন বিদ্বেষ করব? আর তাঁরা আমাদের বিদ্বেষ করবেন, এমন কথার তো কোনও মানেই হয় না। আবাসিক বিদ্যালয়। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকি। অসুখবিসুখ করলে মাস্টারমশাইরা রাত জাগেন। কারও পরীক্ষার ফল খারাপ হলে তাঁদের চিন্তার শেষ থাকে না, নিজেরা আপ্রাণ পড়ান। খিদে পেলে বিস্কুট দেন। চটি ছিঁড়ে গেলে বাবা-মা যত দিন না আসছেন তত দিন চটির ব্যবস্থা করেন। মন কেমন করলে সঙ্গ দেন। এঁরা আমাদের বিদ্বেষ করবেন! আশ্চর্য!

এখন বুঝি, ভারতীয় ঋষিদের কাণ্ডজ্ঞান খুবই গভীর। ‘মা বিদ্বিষাবহৈ’, এটাই শ্লোকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পিতা-পুত্র, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মধ্যে নানা ভাবে ঢুকে পড়ে বিদ্বেষ। যে কঠোপনিষদের শ্লোক এটি, সেখানেই আছে নচিকেতার গল্প। নচিকেতার বাবা যজ্ঞশেষে ব্রাহ্মণদের গরু দান করছিলেন। ছেলে দেখল, বাবার দাতা হিসেবে নাম কেনার খুবই ইচ্ছে, অথচ যে গরুগুলি দিচ্ছেন সেগুলি দানের অযোগ্য। ঘাস খাবে না, দুধ দেবে না, এমন গরু দেওয়ার মানে কী? ছেলে বাবার ভণ্ডামি দেখে প্রশ্ন করল। বাবা বিরক্ত, ক্রুদ্ধ হলেন। তা, প্রতিপ্রশ্ন করলে নিজের বাবাই যদি বিরক্ত হন তা হলে শিক্ষকেরা তো বিরক্ত হতেই পারেন। বিরক্তি, ক্রোধ, এ-সব থেকেই তো বিদ্বেষের জন্ম। বিদ্বেষের অর্থ বিরোধ, বৈর, অপ্রীতি, নিন্দা। শাস্ত্রজ্ঞরা বুঝেছিলেন, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক ভাল হলে ভাল, কিন্তু তার মধ্যে বিরোধ অপ্রীতি নিন্দা ঢুকে পড়তেই পারে। ঢুকে পড়লে বিদ্যার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। দুই পক্ষ ক্রমাগত একে অপরের প্রতি বিষোদ্গার করবে।

এই শ্লোকে হয়তো স্পষ্ট ভাবে ছিল না, কিন্তু আর একটি আশঙ্কাও রয়েছে ছাত্রদের পরস্পরের মধ্যেও বিদ্বেষ দেখা দিতে পারে। সুতরাং সাবধান। ভেবে দেখলে, মহাভারতে কুরুপাণ্ডবের পারস্পরিক বিদ্বেষের সূত্রপাত তো ছাত্রজীবন থেকেই। এ কালে বন্ধুর হাতে বন্ধুর মৃত্যু, সহপাঠীর হাতে সহপাঠিনীর লাঞ্ছনা, এ-সবই বিদ্বেষের নানা রূপ।

‘মা বিদ্বিষাবহৈ’ প্রার্থনাটি অতীতের, কিন্তু এই প্রার্থনাবাক্যের মূল বার্তাটি সমকালীন। বিদ্বেষ করব না এ তো শুধু মুখের কথা, তাকে সত্য করে তুলতে হলে অনুশীলন চাই। যে কোনও জীবনদর্শনই অনুশীলনসাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব গুরুতর। তাঁরা বয়সে প্রবীণ, অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ। পড়ুয়াদের কথা বলার, প্রশ্ন করার অধিকার দিতে হবে তাঁদেরই। পারস্পরিক বার্তা বিনিময় হলে বিরোধ কমবে। শিক্ষকরা সচেতন হলে পড়ুয়াদের নিজেদের মধ্যের বিদ্বেষও ক্রমে মুছে যেতে পারে।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

post editorial biswajit roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy