Advertisement
E-Paper

শুধু রাজনীতি দিয়ে সঙ্ঘকে বোঝা যায় না

এই প্রতিষ্ঠানটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। হিন্দুত্বের সংগঠনের যে অংশটি দেখা যায় না, সেটা তার চূড়ার থেকে অনেক গুণ বড়। এই প্রচ্ছন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কের দিকটা বুঝতে গিয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।এই প্রতিষ্ঠানটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। হিন্দুত্বের সংগঠনের যে অংশটি দেখা যায় না, সেটা তার চূড়ার থেকে অনেক গুণ বড়। এই প্রচ্ছন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কের দিকটা বুঝতে গিয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।

বদ্রী নারায়ণ

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জনসভা। ইলাহাবাদ, জানুয়ারি ২০১০

নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জনসভা। ইলাহাবাদ, জানুয়ারি ২০১০

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে অনায়াসে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম বলা চলে। আশ্চর্য, বাইরে থেকে কিন্তু এর বিষয়ে বেশি কিছু জানার উপায় নেই। মোটের উপর যেটুকু জানা আছে, গোঁড়া হিন্দু রক্ষণশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আরএসএস হল সঙ্ঘ পরিবারের অংশ। আবার বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটিও সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য। এই সদস্যদের প্রাথমিক মতামতে কিছু মিল আছে, যেমন, ভারত একটি পুরোদস্তুর হিন্দু রাষ্ট্র। স্পষ্টত মুসলমান-বিরোধী ও হিন্দুত্ব-প্রসারে বিশ্বাসী আরএসএস-কে তাই সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান বলা সম্ভব এবং সঙ্গত। বিপুলাকার স্বয়ংসেবক অর্থাৎ স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এরা বিজেপি-র সমর্থন-ভিত্তি তৈরিতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, এরা হল বিজেপি রাজনীতির সাংগঠনিক মেরুদণ্ড। নরেন্দ্র মোদী ও আরএসএস-এর সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ ঢাকঢাক গুড়গুড় না থাকলেও এই বিষয়ে একটা বিরাট মতভেদ আছে। দুই পক্ষের সম্পর্কটা ঠিক কী রকম, তা নিয়ে পরিষ্কার দুটি মত। এক দল মনে করেন, সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর ঐতিহাসিক জয়ের পিছনে যদিও আরএসএস-এ বড় ভূমিকা, মোদী নিজে কিন্তু আরএসএস-এর ঘনিষ্ঠ নন, তাদের চাপেও থাকেন না। এঁরা বলেন, গুজরাতে আরএসএস প্রভাব কমিয়ে দিতে পেরেছেন মোদী, বুঝিয়ে দিয়েছেন সে রাজ্যে বিজেপির সর্বেসর্বা তিনিই।

অন্য আর এক দল রাজনীতিবিদ আছেন (যাঁদের মধ্যে আমিও পড়ি), যাঁরা মনে করেন, নরেন্দ্র মোদীর এই মহা-ক্যারিশমার পিছনে প্রাতিষ্ঠানিক পরিশ্রমটি আরএসএস-এরই। একেবারে তৃণমূল স্তর অবধি ছড়িয়ে পড়ার প্রচেষ্টা চালান এঁরা। লোকসভা ভোটের সময়ে বুথ স্তর থেকে নির্বাচন-পরবর্তী পর্ব পর্যন্ত আরএসএস সমর্থকরা মোদীর নিজস্ব প্রচার টিম-এর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেটেছেন, মানুষের মন বোঝার চেষ্টা চালিয়েছেন। মোদী নিজেও অতীতে সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। তাঁর মানসিকতাও আরএসএস-এর দর্শনেই সৃষ্ট ও পুষ্ট। পরে যদি সেই মানসজগতে বাজার কিংবা প্রযুক্তি কিংবা শাসনকার্যের বিবিধ আধুনিক প্রকরণ জায়গা নিয়ে থাকে, সেটা কেবল তাঁর ভিতরের চরিত্রের বাহ্যিক বেশভূষামাত্র।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরএসএস একই সঙ্গে বাস্তব এবং মিথ! কোনটা যে ঠিক, কোনটা নয়, বলা অত্যন্ত কঠিন। দেশবিদেশের অনেক পণ্ডিত আরএসএস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু আরএসএস সততই পরিবর্তনশীল বলে তার কোনও বিশেষ ইমেজ এখনও সফল ভাবে ধরা সম্ভব হয়নি। যেমন, যে আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক ইমেজ এত জোরদার, তারাই কিন্তু আবার যে কোনও জাতীয় সংকটের সময় জাত-ধর্ম খেয়াল না করেই ত্রাণ ও নানা রকম সামাজিক কাজে নিয়মিত হাত লাগায়।

সঙ্ঘের পাশাপাশি সঙ্ঘ পরিবারে ভারতীয় জনতা পার্টি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ইত্যাদিরা রয়েছে, সেটা আমাদের জানা। যেটা তুলনায় অজানা, তা হল কত ধরনের ছোট ছোট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এই পরিবারের অংশ। সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ সদস্য না হলেও এদের ব্যবহার করেই সঙ্ঘের আদর্শ ও বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা ঘটে। সেবা ভারতী, বিদ্যা ভারতী, বন্দে মাতরম, কথামণ্ডল, বনবাসী কল্যাণ মণ্ডল, দেশ জুড়ে এই সব নানা ছোটখাটো পরিবার-বন্ধুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অধিকাংশেরই নাম হিন্দু দেবদেবীর অনুসরণে, যাতে হিন্দুত্বের সংযোগটা স্পষ্ট হয়। তবে, মনে রাখতে হবে, সঙ্ঘ কিন্তু এদের প্রাত্যহিক ভাবে চালনা করে না। যেমন, সরস্বতী শিশু মন্দির-এর স্কুল উত্তরপ্রদেশের বহু জায়গায় ছড়িয়ে আছে। আরএসএস তাদের পরিচালনা করে না, কিন্তু তাদের মাধ্যমেই নিজেদের বার্তা প্রচার করে, শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। উত্তরপ্রদেশের বড় বড় শহর, যেমন ইলাহাবাদ, লখ্নউ, বারাণসীতে প্রচুর স্কুল ও কলেজকে আরএসএস এ ভাবে পরোক্ষে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে থাকে।

এই সব প্রতিষ্ঠান যাঁরা চালান, যে শিক্ষকরা এখানে পড়ান, তাঁদের অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত, অনেকেই আবার স্বেচ্ছাসেবক। এঁরাই নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী বা বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের মানুষদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেন। শিশুদের জন্য ওয়ার্কশপ হয়। মহিলাদের জন্য, বয়স্কদের জন্য নিয়ম করে কথামণ্ডল ও কীর্তনমণ্ডলের আয়োজন হয়। এগুলোর মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্বের মহিমা প্রচার চলে। কিছু কিছু আয়োজন এত বড় মাপের হয় যে সেখানে মোহন ভাগবতের মতো আরএসএস-এর শীর্ষনেতারাও আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। আরএসএস-এর উপর ফিল্ডওয়ার্ক করতে গিয়ে আমরা তার এই প্রচ্ছন্ন, অনালোচিত নেটওয়ার্কের বহরটা বুঝেছিলাম, বিস্ময়ে স্তব্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল! বুঝেছিলাম, আরএসএস কেবল হিমশৈলের চূড়ামাত্র। হিন্দুত্বের সংগঠনের যে অংশটি দেখা যায় না, সেটা তার চূড়ার চেয়ে অনেক, অনেক গুণ বড়। ফলে রাজনীতি দিয়ে আরএসএস-কে যতই বোঝার চেষ্টা হোক, সেটা আসলে অধরা থেকে যায়। টিভির বিতর্কে যে রাজনীতি-বিশারদদের দেখা যায়, তাঁরা সঙ্ঘের মূল ক্ষমতার উৎসটি ধরতেই পারেন না মোটে, কেবল নির্বাচনী রাজনীতিতে তার যে ‘টিকি’র অংশটা দেখা যায়, সেটুকু নিয়েই আগডুম বাগডুম বকেন। ভাবেন যে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিই আসলে এর মহিমার একমাত্র প্রকাশ।

আরএসএস-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট: উত্তর ভারতের বিরাট দলিত সম্প্রদায়। শেষ লোকসভা নির্বাচনে যে এত পরিমাণ দলিত গোষ্ঠী বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, সেটা এমনি এমনি নয়। এর পিছনে আরএসএস-এর একটা সুচিন্তিত, সুপরিচালিত দীর্ঘ দলিত সংগঠনের প্রক্রিয়া আছে। তার মধ্যে পড়ে সংরাষ্ট্র (ঐক্য) ক্যাম্পেন, যাতে দলিত পরিচিতিকে আক্ষরিক অর্থে উদ্যাপন করা হয়। গ্রামে গ্রামে এদের শাখা, স্কুলে স্কুলে এদের প্রাত্যহিক উপস্থিতি। আরএসএস স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিত দলিত বস্তি বা দলিত পল্লিগুলিতে যান, তাদের বোঝান যে তারা হিন্দু সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার ‘ফ্যাসিনেটিং হিন্দুত্ব: স্যাফরন পলিটিকস অ্যান্ড দলিত মোবিলাইজেশন’ বইতে লিখেছিলাম যে, আরএসএস-এর লক্ষ্য, দলিতদের দিয়ে হিন্দুসমাজের একটা পদাতিক বাহিনী তৈরি করা, যারা হিন্দু ধর্মকে মুসলিম আগ্রাসন থেকে রক্ষার লড়াই-এর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। লক্ষণীয়, বিজেপি এবং আরএসএস উভয়ই জাতভিত্তিক সংরক্ষণের বিরোধী, অথচ তারাই আবার নিচু জাতের মানুষকে রাজনীতিতে কাছে টানতে তৎপর।

সঙ্ঘ বিষয়ে একটা ধারণা প্রচলিত যে এদের স্বেচ্ছাসেবকরা সকলেই গোঁড়া, রক্ষণশীল, ঐতিহ্যপরায়ণ, এদের সঙ্গে আধুনিক পৃথিবীর বিশেষ যোগাযোগ নেই। ধারণাটা একেবারে ভুল। বরং এখনকার স্বেচ্ছাসেবকরা প্রযুক্তিতেও দক্ষ, ইন্টারনেটেও বিশারদ। আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত আবিষ্কার সম্পর্কে এঁরা বেশ ওয়াকিবহাল। মোবাইল ফোন, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ এঁদের নিত্যব্যবহার্য। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে প্রতি মুহূর্তের আনাগোনা। আরএসএস-এ ঢুকতে গেলে প্রতিটি সদস্যের কাছে একটি ডায়রি রাখতে হয়, যাতে অন্যান্য সদস্যদের মোবাইল, ইমেল ইত্যাদির তালিকা থাকে।

নব্বইয়ের দশকের পর ‘রাম’-এর সঙ্গি ‘রুপি’র গুরুত্বও আরএসএস-এর কাছে বেড়েছে। টাকা জোগাড় করার জন্য নানা রকম দানসংগ্রহ চলে গুরুদক্ষিণার মাধ্যমে, কিংবা অন্যান্য পথে। আগে সঙ্ঘের নেতারা সাইকেল চড়ে ঘুরতেন, এখন প্রায় সকলেরই ঝাঁ-চকচকে এসইউভি গাড়ি কিংবা লাক্সারি গাড়ি। এক জন বড় মাপের নেতা আমায় বলেছিলেন, নতুন প্রযুক্তি, নতুন পরিবহণ সমাজে তাঁদের জায়গাটা আরও প্রসারিত, আরও শক্তপোক্ত করেছে।

সুতরাং আরএসএস-কে বুঝতে হলে নতুন মানসিকতা আর নতুন প্রযুক্তির কথাটাও মাথায় রাখতে হবে বইকী। এই প্রতিষ্ঠান নিজের আধুনিকীকরণে বিশ্বাস করে। বাইরে থেকে যদিও মনে হয় এঁরা ঐতিহ্যবাহী আদর্শেই আটকে আছেন, গঙ্গাশোধনের মতো বিষয় নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন, আসলে কিন্তু এই সব অ্যাজেন্ডাকে সমাজের নানা স্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের রাজনৈতিক পথ হিসেবে দেখাই ঠিক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাজকর্মে ভাবনাচিন্তার সঙ্গে কখনও আরএসএস-এর পথ কিছুটা মিলে যায়, আবার কখনও ভিন্ন হয়ে হিন্দুত্বের আলাদা রাজনীতির পথ তৈরি করে। আরএসএস ঠিক নরেন্দ্র মোদীর সাবস্টিটিউট বা পরিবর্ত নয়। বরং বলা যেতে পারে, আরএসএস হল মোদীর রাজনীতির কমপ্লিমেন্টারি বা পরিপূরক।

এ বছরের জাতীয় নির্বাচনে মোদী ও বিজেপি’কে আরএসএস সাংগঠনিক ভাবে যে সাহায্য করেছিল সেটা কতটা গুরুতর তা বোঝা যায় ঠিক পর-পরই উপনির্বাচনগুলির ফলাফল দেখে। উপনির্বাচনের সময় আরএসএস তাদের সহায়তার দরাজ হাতখানি বাড়িয়ে দেয়নি, তাই বিজেপির প্রায় ভরাডুবি হল। উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনগুলিতে তো দেখা গেল প্রায় সব ক’টি আসনেই বিজেপি প্রায় মুছে যাওয়ার হাল। লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস তার সাংগঠনিক শক্তির পুরোটা কাজে লাগানোয় ছবিটা ছিল একেবারেই উল্টো মোদীর বারাণসী আসনে তো বটেই, গোটা রাজ্যেই। এই একটা দৃষ্টান্তই সংশয়াতীত ভাবে প্রমাণ করতে পারে, আরএসএস বিজেপির কী এবং কতটা।

ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে ইতিহাসের শিক্ষক

editorial badri narayan rss
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy