তিরিশ বছর আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারমশাই এক দিন ‘নষ্টনীড়’ পড়াতে পড়াতে বললেন, সত্যজিতের ‘চারুলতা’র শেষটা তাঁর ভাল লাগেনি। কারণ গল্পের শেষে চারুর ভূপতিকে মৈশুর যাওয়ার প্রস্তাবে ‘না, থাক্।’ বলাটা ছবিতে তেমন ভাবে ফোটেনি। বিশেষত নীড় নষ্ট হয়ে গেছে জেনেও চারু কেন ভূপতির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে ‘এসো’, এক বার নয় দু’বার!
গত তিরিশ বছরে অন্তত তিরিশ বার ‘চারুলতা’ দেখেছি, প্রতি বারই মনে হয়েছে, ভূপতির আশ্রয়ে টিকে থাকার জন্যে এ ছাড়া চারুর আর কিছু করার উপায় ছিল কি? সারা ছবিতে সে নিজের বাঁচার ‘স্পেস’টুকুই খুঁজে গিয়েছে অবিরত। অমলকে ঘিরে তার প্রেম, আসক্তি, ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস সব কিছুই কিন্তু ভূপতির ওই বিরাট খাঁ-খাঁ বাড়িটায় নিজের শ্বাসরোধের উপশম। চারু বরাবরই ওয়াকিবহাল যে, অমল তার প্রতি কিঞ্চিত্ অনুরক্ত হলেও তাকে সাক্ষর গৃহবধূর বেশি ভাবতে পারে না। অমলের তালে তাল না দিলেই সে তাকে ঠেস দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, সে তত দূর শিক্ষিত নয়, যতটা শিক্ষা থাকলে তার অমলের লেখালিখি নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা জন্মায়।
সত্যজিত্ তাঁর সারা ছবি জুড়ে অমল আর ভূপতির উনিশ শতকীয় জ্ঞানচর্চায় চোখে-পড়ার-মতো অনুপস্থিত রাখেন চারুকে। একমাত্র বিয়ের অনুষঙ্গটুকু ছাড়া সে সঙ্গী হয়ে ওঠে না অমল আর ভূপতির পারস্পরিক আলোচনায়। অ্যাডিসনদের লেখা অমলের প্রেরণা, শেক্সপিয়র-বায়রনের ইংল্যান্ড তার কাছে স্বপ্নের মতো, ‘মেডিটের্যানিয়ান’ শব্দটা তাকে তানপুরার ঝংকারের মতো সম্মোহিত করে। আর বঙ্গদেশের প্রথম আধুনিক মানুষ রাজা রামমোহন রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ ভূপতি পশ্চিমি অভিঘাতে আন্দোলিত। তার ইংল্যান্ড বার্ক-মেকলে-গ্ল্যাডস্টোনের ইংল্যান্ড, তার ইতালি মাতসিনি-গ্যারিবল্ডির ইতালি। নবলব্ধ চেতনায় সে দেশকে পুনরাবিষ্কার করছে। ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর প্রসাদধন্য দু’টি মানুষ ট্র্যাজেডি নিয়ে তর্ক করে ইংরেজ সরকার কর বসানোয় বঙ্গদেশের গরিবদের দুর্দশা বড় ট্র্যাজেডি, না শেক্সপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ বড় ট্র্যাজেডি। দু’জনের কারওরই খেয়াল থাকে না, ওই প্রাসাদোপম বাড়িটায় বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন-এর নবীনা-র মতো ‘শয্যায় গড়াইয়া, দর্পণসম্মুখে কেশরঞ্জন করিয়া, কার্পেট বুনিয়া, ‘সীতার বনবাস’ পড়িয়া’ সময় কাটায় যে চারু সে বঙ্গদেশের আরও বড় ট্র্যাজেডি কি না! শেষমেশ ভূপতির অবশ্য মনে পড়ে, অমলকে ডেকে বলে ‘ওহে, শোনো... চারুর লেখাপড়ার দিকে বেশ ঝোঁক আছে, বুঝেছ? এই সব পত্রিকা-টত্রিকা ও সব পড়ে বাংলায় যা কিছু আসে সব পড়ে।... ওকে গাইড কর, ওকে দিয়ে লেখাও।... তবে টের যেন না পায় যে শেখানো হচ্ছে।’ টের অবশ্য পেয়ে যায় চারু, সে কতটা ‘চাপা অথচ sensitive’, একটি লেখায় তা ব্যাখ্যাও করেছেন সত্যজিত্। স্বামীসঙ্গের সময়ই চারুর এ স্বভাবটা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছবিতে।
যে রাতে চারু এসে ভূপতিকে তার আদ্যক্ষর নকশা-করা রুমালটা দিয়েছিল, সে রাতে প্রথম শুধিয়েছিল ভূপতি: ‘এত সময় তুমি কখন পাও চারু?’ চারু বলেছিল ‘আমার কি সময়ের অভাব আছে?’ ভূপতি বলে ‘তোমার বড় একা লাগে, না চারু?’ চারুকে দেখতে পাওয়া যায় না, তবে দূর থেকে তার একটা নিস্পৃহ উত্তর ভেসে আসে: ‘ও আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।’ পরাধীন ভারতে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক পত্রিকার সম্পাদক ও সর্বার্থেই উদার সংস্কারমুক্ত প্রগতি-র সক্রিয় সমর্থক ভূপতির পৌরুষে কোথাও যেন একটা ঘা লাগে। প্রায় অভিভাবকের মতো বলে ওঠে, ‘নিঃসঙ্গতার অভ্যাস তো কোনও কাজের অভ্যাস নয়, চারু’। প্রায় পরামর্শের মতো শোনায় কথাগুলো চারুর কাছে। ‘তুমি স্বর্ণলতা পড়েছ?’ এমন একটা অবান্তর প্রশ্ন করে চারু প্রসঙ্গটা এড়ানোর চেষ্টা করে, বা বলা যেতে পারে ওই অবান্তর প্রশ্নের ভিতর দিয়ে সে পরখ করে নিতে চায় ভূপতি তার নিঃসঙ্গতা নিয়ে আদৌ ভাবিত, নাকি কেবল কর্তব্যের খাতিরেই কথাগুলো বলছে। উত্তরে ভূপতির অট্টহাস্য, এগিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন, তার কপাল চুম্বন, বা ‘আমার চারুলতা আছে। নাটক নভেল কাব্য কিচ্ছু চাই না আমার...’ ইত্যাদি কথাবার্তায় চারু নিশ্চিত হয়ে যায় যে ভূপতি তার নিঃসঙ্গতাকে ছুঁতে পারা দূরে থাক, বুঝেই উঠতে পারছে না। ফলে ফের শামুকের খোলে ঢুকে পড়ে সে।
গোটা ছবিটায় ভূপতির কাছে আত্মগোপনকারী থেকে যায় চারু। নিজের যাবতীয় অনুভূতি টের পেতে দেয় না স্বামীকে। নিছক অভিমান, স্বামীর অবহেলা বা মনোযোগের অভাব সম্পর্কে অনুযোগ, এ-সব নিয়ে অস্থির হয়ে-ওঠা স্ত্রী কিন্তু নয় সে, জানে তার আর ভূপতির বর্গ দু’টি আলাদা। সে উনিশ শতকের নবজাগরণের বঙ্গে পিছিয়ে-পড়া দেশগাঁ থেকে ভূপতিদের পরিবারে এসে-পড়া এক গৃহবধূ মাত্র, তাদের নাগরিক আভিজাত্যে নিতান্তই প্রান্তিক। কাক তাড়ায় সে অলস দ্বিপ্রহরে, গৃহভৃত্য ব্রজকে বিকেলে চা দিয়ে আসতে বলে ভূপতির অফিসে, রাতে যত্ন করে ভূপতিকে খাওয়ানোর সময় এমন ভাবে পিছন ফিরে বসে যে ভূপতি যখন তাকে বলে, ‘তোমাকে একদিন রাজনীতির ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেব’, আমরা তার প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই না। শেষ দৃশ্যে স্বামীর সঙ্গে ব্যবধান যখন দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে ওঠে, তখনও ঘোড়ার গাড়ি থামার আওয়াজ পেয়ে কপালে টিপ দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর টেনে স্বামীকে অভ্যর্থনা করতে এগোয়, জানে যে এটাই তার নিয়তি, তাকে ভূপতির সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে, স্বামী তাকে যতই প্রত্যাখ্যান করুক।
ভূপতি কিন্তু ভালমানুষ, তার ইচ্ছা-উদ্যোগে কোনও দ্বিচারিতা ছিল না, সে কিন্তু সত্যিই চারুর ‘ভাল’ চেয়েছিল। মুশকিল হল, ইংরেজের উপনিবেশে সামন্ত কাঠামোর মধ্যে যে ভাবে সে পড়াশুনো শিখেছিল, তাতে একটা দ্বিধাবিভাজন থেকেই গিয়েছিল, তাই তার লিবারালিজম শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না চারুর কাছে। দেশের গরিবদের কথা বলে ভূপতি, বলে ‘পলিটিক্স একটা জ্যান্ত জিনিস’, অথচ জীবন্ত চারুকেই খেয়াল করে না। চশমা-চোখে বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হেঁটে চলে যায়, সেখানে দাঁড়ানো চারুকে দেখতেই পায় না। চারু যে ছেলেবেলার গ্রাম, খেলাধুলো, মন্দির, গাজনের সঙ্, সংক্রান্তির মেলা নিয়ে লিখে সকলকে মাত করে দেয়, সে-খবরও বন্ধুর কাছ থেকে শুনতে হয় ভূপতির। চারু তাকে বলে, ‘তুমি কাগজ কর তা হলে লিখব।’... হো হো করে হেসে ওঠে ভূপতি, বলে ‘আমার কাগজে তুমি লিখবে? রাজনীতি?’ এই একটি বার চারু সরব হয়, বলে, ‘ইংরিজিতে রাজনীতি আর বাংলায় আর সব।’ আলোকপ্রাপ্ত ভূপতি ভুলে যায় যে চারুর মধ্যে দেশের শিকড়টা আবিষ্কার করতে পারে না বলেই তাদের দেশাত্মবোধের আন্দোলন তলানিতে এসে ঠেকে।
পঞ্চাশ বছর পরেও কি বাঙালি পরিবারে নারী-পুরুষের বিন্যাসে বদল ঘটেছে খুব একটা?
ছবি: সত্যজিত্ রায় সোসাইটির সৌজন্যে।