ফুলকপি খাচ্ছেন?
চাষিদের গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি চাষে বাড়তি উপার্জনের কথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও অন্য অনেক সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। (‘গ্রীষ্মের ফুলকপি চাষে...’, ৬-৮) বায়োটেকনোলজির দৌলতে এখন শীত-গ্রীষ্মের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে। বাজার দেখে অন্তত বুঝবার উপায় নেই যে কোনটা শীত আর কোনটা গ্রীষ্মের সব্জি। গ্রীষ্মে বা ভরা বর্ষায় শীতকালীন সব্জি চাষ এবং তার ফলে বাঙালিদের পাতে বৈচিত্র আনা সম্ভব হলেও ফুলকপি মুলো বেগুন প্রভৃতি সব্জিকে একটা যাচ্ছেতাই পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
ফুলকপি, ওলকপি, বাঁধাকপি, শালগম (যেটা প্রায় দুর্লভ হতে বসেছে), বেগুন, ধনেপাতা, পালং শাক ইত্যাদি গরমকালে ফলালে তার প্রাকৃতিক স্বাদ হারায়, ক্রেতারাও একঘেয়েমিতে ভুগতে থাকেন। ভাবুন তো, শীতকালীন বাঁধাকপিতে কড়াইশুঁটি অথবা ছোট ছোট আলু সহযোগে যে ঘন্ট রান্না হয়, গরমকালেও যদি সেই একই রান্নার চেষ্টা হয়, বাঙালি খাদ্যরসিকদের ভাল লাগবে? শীতকালে মুলোর ছেঁচকি বা ঘন্ট কিংবা মুগডালে মুলো সহযোগে রান্নার সময় যে শীতকালীন সব্জির গন্ধ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত, গরমকালে সেই একই রান্না করা হলে সে গন্ধ পাওয়া সম্ভব?
হাইব্রিড মুলোর চাষ দেশি মুলোর দফরফা করেছে। লম্বা লম্বা সাদা মুলোর উপরিভাগে গাঢ় বেগুনি দাগের মুলো কিংবা খানিকটা লাল লম্বা মুলো এখন বাজারে দেখা যায় না। গরমকালের ছোট ছোট সাদা মুলোতে বাজারে ভরে থাকছে। সেই মুলোর না আছে স্বাদ, না আছে গন্ধ। মুগডালে শীতকালের ধনেপাতার স্বাদ আর নেই। গরমকালের ধনেপাতা মানে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। শীতকালের ধনেপাতার আকারই গরমকালে মিলবে না, গন্ধ তো দূরের কথা। গরমকালের বেগুনের স্বাদ নিয়ে যত কম লেখা যায়, ততই ভাল। এটাকে কি আদৌ বেগুন বলা যাবে? শীতকালে নরম ধোঁয়া-ওঠা সাদা ভাতে সামান্য ঘি, দেশি কাঁচালঙ্কা ও বেগুন ভাজা যে অপূর্ব স্বাদ তৈরি করে, গরমকালে সেই স্বাদ, সেই গন্ধ কি মেলা সম্ভব?
তথাকথিত সাদা ফুটফুটে ফুলকপি বৈচিত্র আনবার জন্য গরমকালে খেতেই হবে, এর কোনও ভিত্তি নেই। গরমকালে ফুলকপি চাষে, মুর্শিদাবাদের চাষিরা যতই বাহাদুরি কুড়োন, ফুল ফোটাবার জন্য যে নির্বিচার সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সেটা স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসছে। এক রাত্রের রাসায়নিক স্প্রে-তে ফুলকপির ওজন বেড়ে যাচ্ছে একশো থেকে দেড়শো গ্রাম পর্যন্ত। ফুলকপির পরতে পরতে থাকে বিষ। মানুষ সারা বছর গলাধঃকরণ করে। চা-পাতায় বিষের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হওয়ায় চা বোর্ডের কর্তাদের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, চালকুমড়ো, মুলো, ওলকপির নমুনা নিয়ে গবেষণা করলে কার্যত ভূকম্পন দেখা দেবে। শুধু ফুলকপি এবং বেগুনের পরতে পরতে যে বিষ থাকে, তা-ই নয়, গ্রামবাংলাতে কাতলা এবং রুই এমনকী পুকুরের চিতলকেও খাদ্য হিসেবে প্রচুর পরিমাণে ইউরিয়া দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদনে গরমকালের ঢেঁড়শ, পটল একঘেয়ে লাগবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত নয়। এক সজনে দিয়েই তো সজনের শুকতো, সজনে পোস্ত, সজনের পাতলা ঝোল, সর্ষেবাটা সজনে রান্না সম্ভব। পটল দিয়ে তিন-চার রকম আইটেম সম্ভব। ঢেঁড়শ দিয়ে দুই-তিন রকম। গরমকালেও থাকে সব্জির সমারোহ। পিঁয়াজ, কুমড়ো, কালো জিরের ছেঁচকিও তো স্বাদপূর্ণ হয়।
গরমে আরও একটি আইটেম দিয়ে মুখের পরিবর্তন আনা যেতে পারে। পান্তা ভাত। একটু কাসুন্দি, কাঁচা লঙ্কা ও সরষের তেল এবং লেবুপাতা দিয়ে পান্তাভাতটা মেখে নিন। আলুভাজা এখন দুর্মূল্য মনে হলে সামান্য কুমড়ো ভাজা অথবা ছেঁচকি নিন। খেয়ে দেখুন। কৃত্রিম ফুলকপির চেয়ে ভাল লাগবে। তবে অফিসে ঢুকবার আগে পান্তাভাত না খাওয়াই ভাল। সে ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়া যাবে না। ঘুমে ঢুলে পড়বার সম্ভাবনা।
শান্তনু বসু। চাঁচল, মালদহ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy