শীতকালীন অধিবেশনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, এক দশকে দেশে মেডিক্যাল কলেজ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। প্রায় একই হারে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাতে মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এ রাজ্যের চিকিৎসকদের একাংশ।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের (এনএমসি) তথ্য অনুযায়ী, ৮১৮টি মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৭৪টি। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই নির্দিষ্ট কিছু সরকারি হাসপাতালের অধীনে অনুমোদন অর্জন করেছে। রাজ্যে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১টি। সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে রাজ্যে মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৮টি।
বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক-অধ্যাপক রঞ্জন ভট্টাচার্যের অভিযোগ, মেডিক্যাল শিক্ষার পঠনপাঠনে আগের মতো কাজ শেখার পরিবেশ নেই। তাঁর কথায়, “নবীন স্নাতকদের ক্লাসে উপস্থিতির হার কম। হাউজস্টাফশিপের জন্য ওয়ার্ডে রাউন্ডের কথা বার বার বলা হলেও তা করার আগ্রহ নেই বললেই চলে।”
অথচ, এনএমসি-র নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি বা বেসরকারি, সব প্রতিষ্ঠান থেকেই ব্যাচেলর অফ মেডিসিন, ব্যাচেলর অফ সার্জারি (এমবিবিএস) ডিগ্রি কোর্স-এর সঙ্গে এক বছরের ইন্টার্নশিপ এবং হাউজস্টাফশিপ করা বাধ্যতামূলক। এর পর তাঁরা ডক্টর অফ মেডিসিন (এমডি), মাস্টার অফ ডেন্টাল সার্জারি (এমডিএস), মাস্টার অফ সার্জারি (এমএস)-এর মতো স্থাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করার সুযোগ পান।
চিকিৎসকদের একাংশের তরফে অভিযোগ উঠছে এই পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই মানছেন না নবীন স্নাতকেরা। কিন্তু কেন?
চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্যের ব্যাখা, এখন এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পরই প্র্যাকটিশনার হিসাবে নাম নথিভুক্তিকরণ করা যায়। এ জন্য এক বছরের ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা থাকলেই হয়। তাই সার্জারি কিংবা জেনারেল মেডিসিনের মতো বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষার পথেই হাঁটছেন না বহু স্নাতক। রোগী দেখে রোজগারের পথেই হাঁটছেন তাঁরা।
বর্তমান মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে মর্ডান মেডিসিন (অ্যালোপ্যাথি) বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আয়ুষ, ইউনানি, হেল্থকেয়ার অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস-এর মতো বিষয়ও। তার ফলে শিক্ষণ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। সরকারি হিসাব বলছে, ১৩,৮৬,১৫০ জন অ্যালোপ্যাথি এবং ৭,৫১,৭৬৮ জন আয়ুষ বিভাগের প্র্যাকটিশনার হিসাবে নাম নথিভুক্ত করেছেন।
কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যায় বিভিন্ন বিষয়ের সংযোজিত হলেও, তা শেখানোর মতো বিশেষজ্ঞ শিক্ষক কি রয়েছেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? এ বিষয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার তাপস প্রামাণিকের অভিযোগ, “একের পর এক কলেজ তৈরি হলে আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক কোথায়? ক্লাস করানোর মতো বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে এই রাজ্যে।”
মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন্স (কোয়িলিফিকেশনস অফ ফ্যাকাল্টি) রেগুলেশন্স, ২০২৫ অনুযায়ী, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, স্পেশ্যালিস্ট, মেডিক্যাল অফিসারদের তিন থেকে ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলে অধ্যাপক এবং শিক্ষক হতে পারবেন। এ ছাড়াও ইন্টিগ্রেটেড এমএসসি-পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্তেরা অ্যানাটমি, ফিজ়িয়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলজি বিভাগের ফ্যাকাল্টি হিসাবে কাজের সুযোগ পাবেন। নিয়মের শিথিলতার কারণে চিকিৎসকদের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে বলেই দাবি করছেন চিকিৎসক মহলের একাংশ। ফলে ক্রমশ কমছে চিকিৎসক-শিক্ষকের সংখ্যা। অভিযোগ, অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে, কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকদেরই তুলে নিতে হচ্ছে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ।
এতে কি সমস্যা হচ্ছে?
জেনারেল সার্জেন তাপস ফ্রান্সিস বিশ্বাসের কথায়, “১৫-২০ বছর চিকিৎসক হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে শিক্ষকতা করা যায় না বলেই এত দিন জানতাম। কিন্তু এনএমসি-র নতুন নিয়ম বলছে, এমডি হলেই পড়াতে পারবেন যে কোনও চিকিৎসক। বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাঁরা পড়াচ্ছেন এবং যাঁরা শিখছেন, তাঁরা কতটা ভাল পরিষেবা দিচ্ছেন বা দিতে পারবেন, তাতে সন্দেহ রয়েছে।” শুধু তা-ই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এমবিবিএস ডিগ্রিপ্রাপ্তেরাও শিক্ষকতা করছেন বলে অভিযোগ।
রাজ্য মেডিক্যাল নিয়ে অভিযোগ রয়েছে অজস্র। এমবিবিএসের আসন বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বহু বার। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক মানস গুমটার অভিযোগ, “র্যাঙ্ক না থাকলেও টাকার বিনিময়ে যে এই রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া যায়, সেই ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। এখনও সেই পরম্পরা বজায় রেখেছেন বহু চিকিৎসক। এতে মেডিক্যাল পড়ুয়াদের পড়াশোনা এবং কাজ শেখার প্রতি আগ্রহ কমছে।” তাঁর দাবি, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অর্থের বিনিময়ে ডিগ্রি পাওয়া যায়। অনেকে এক বছর ইন্টার্নশিপের পরই প্রাইভেট চেম্বার খুলে বসেন। এতে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে রোগীর।
চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, একের পর এক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে স্বীকৃতি দিয়ে, বড় বড় ভবন বানিয়ে আদতে কোনও লাভ নেই। বরং, পড়ুয়াদের জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক প্রয়োজন। পাশাপাশি, প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর বৃদ্ধিতেও নজর দিতে হবে।