চোখের পলকে সাঁওতালি ভাষার কোনও শব্দ বা পংক্তি ইংরেজি বা হিন্দিতে অনুবাদ করে দেবে কৃত্রিম মেধা। আবার চাইলে সাঁওতালি জানেন না এমন কোনও মানুষ ইংরেজি বা হিন্দি থেকে কোনও শব্দ বা পংক্তি অনুবাদ করিয়ে নিতে পারবেন ওই ভাষায়। অলচিকি লিপি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও শিখে ফেলা যাবে সাঁওতালি শব্দ। সাহায্য করবে অডিয়ো।
সম্প্রতি এমনই এক কৃত্রিম মেধা ভিত্তিক টুল ‘আদি বাণী’-র উদ্বোধন করেছে কেন্দ্রের আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রক। গত দু’দশকে এই কৃত্রিম মেধার কল্যাণেই অনুবাদ কাজ হয়েছে সহজতর। পৃথিবীর প্রায় আড়াইশো ভাষা নিমিষে অনুবাদ করে দিতে পারে গুগল। কিন্তু সাঁওতালি বা ভিলি, মুন্ডারি, গোন্দি-র মতো ভাষা অনুবাদের কাজ এর আগে কখনও হয়নি। তাই এই ভাষাগুলি নিয়েই কাজ করছে ‘আদি বাণী’। পরবর্তী পর্যায়ে দেশের আরও কিছু আদিবাসী জনজাতির ভাষাকেও এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে চায় কেন্দ্র। কিন্তু সত্যিই কি সে কাজ এত সহজ? এতে কি আদৌ কোনও উন্নতি হবে সাঁওতালি গোষ্ঠীর মানুষের?
‘আদি বাণী’-র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বলেছিলেন, “ভারতীয় ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসাবে আদিবাসী ভাষা এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।”
‘আদি বাণী’-র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কৃত্রিম মেধার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ছবি: পিআইবি।
আদিবাসী আবেগ ছুঁতে কৃত্রিম মেধার সাহায্যে ভাষা সংরক্ষণের চেষ্টায় একাধিক প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তারই একটি হল এই বিশেষ অনুবাদক। এটি পড়ুয়াদের ভাষাশিক্ষায় সহায়ক হয়ে উঠবে বলেই আশাবাদী কেন্দ্র। তবে, যেখানে বাংলার মতো ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে সমাজমাধ্যমে হাসির খোরাক হতে হয় কৃত্রিম মেধাকে, সেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধার, তার সংরক্ষণ কি যথাযথ উপায়ে সম্ভব? তা নিয়ে সন্দিহান খোদ শিক্ষকেরাই।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মেরুনা মুর্মুর কথায়, “স্পর্শকাতর আদিবাসী ভাষাকে প্রযুক্তির সাহায্যে অনুবাদের কাজ খুবই সমস্যার হতে পারে। নিঃসন্দেহে এই প্রয়াস অবশ্যিক এবং প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু যে প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে কাজটি করা হচ্ছে, তাতেই নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এতে বিভ্রান্তির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে।”
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে ৪৬১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে। এর মধ্যে ৮১টি স্পর্শকাতর এবং ৪২টি বিলুপ্তপ্রায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বহু ভাষার লিপি নেই। সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা কতখানি মূলানুগ অনুবাদ করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওশিয়ানোগ্রাফিক স্টাডিজ়-এর অধ্যাপক রাহি সোরেন বলেন, “বিরল এবং বিপন্ন হয়ে যাওয়া ভাষা সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তির প্রয়োগ অবশ্যই দরকার। কিন্তু এর জন্য কৃত্রিম মেধাকেও সাবালক হতে হবে। তবেই অনুবাদের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব।”
‘আদি বাণী’ অ্যাপের বেটা ভার্সন মোবাইলে ডাউনলোড করার সুযোগ রয়েছে। ছবি: পিআইবি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা বিশেষজ্ঞদের নিয়েই অনুবাদকের পরীক্ষামূলক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। শুধু অনুবাদ-ই নয়, এর পাশাপাশি গঠনমূলক ডিজ়িটাইজেশন, সংরক্ষণ এবং ভাষা পুনরুজ্জীবিত করার কাজও করবে ‘আদিবাণী’।
আইআইটি দিল্লি, আইআইটি হায়দরাবাদ, বিআইটিএস পিলানি, আইআইআইটি নয়া রায়পুরের সঙ্গে ট্রাইবাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা এই পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে যুক্ত।
এই বিশেষ ‘টুল’-এর মাধ্যমে টেক্সট-টু-স্পিচ পদ্ধতিতে হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা যাবে। সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঁওতালি বিভাগের প্রধান পল্টন মুর্মু বলেন, “এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে কথোপকথনের মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষিত হয়। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার হলে তা যথাযথ হওয়া প্রয়োজন। নইলে তার প্রভাব খারাপ পড়তে পারে ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে।”
তবে, ভাষা নিয়ে জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঁওতালি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান ক্ষুদিরাম মুর্মুর মতে, কৃত্রিম মেধাকে অস্বীকার করার জায়গা নেই। তাকে ব্যবহার করে যদি সাঁওতালি ভাষায় লেখা নথি ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ হয়, তা হলে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট উৎসাহিত হবেন।