২০১৫ সালে সুজয় ঘোষ তৈরি করেছিলেন অতিস্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘অহল্যা’। কাহিনি অনুযায়ী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়- রাধিকা আপ্তে জ্যান্ত মানুষকে পুতুল বানিয়ে রেখে দিতেন নিজেদের ঘরে। তাঁদের সর্বশেষ শিকার হয়েছিলেন পুলিশ আধিকারিক টোটা রায়চৌধুরী। ঠিক তেমনই পুতুল মানুষ বানিয়ে রাখতে চাইছেন ২০২৫-এ এসে! সত্যি নয়, ভার্চুয়াল।
‘জেনারেটিভ এআই’-এর সাহায্যে মানুষের হুকুমে থ্রিডি পুতুল তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নিজের ছবি-সহ লিখে দিতে হবে, সেই পুতুলকে কেমন দেখতে হবে। অমনি হাজির হবে পুতুল। নতুন এই ট্রেন্ডে গা ভাসিয়েছেন খ্যাতনামী থেকে সাধারণ মানুষও। তাঁদের সে সব ছবি শোভা পাচ্ছে সমাজমাধ্যমে। কিন্তু ঠিক কোন প্রযুক্তিতে তৈরি হয়ে যাচ্ছে এমন পুতুল?
নেপথ্য কারিগর—
গুগলের নিজস্ব ইমেজ এডিটর ‘জেমিনি’-র সাহায্যে যে কেউ নিজের বা অন্য কারও ছবিকে থ্রি-ডি মডেলে পরিবর্তন করতে পারেন। এ জন্য তাঁদের ওই বিশেষ টুলটিতে মডেলের উচ্চতা, গায়ের রঙ, ভঙ্গিমা, মুখের গড়নের মতো সমস্ত তথ্য দিতে হচ্ছে। তারপরই কেল্লাফতে।
তবে এই প্রযুক্তি যে শুধু এমন বিনোদনমূলক কাজ করে তা-ই নয়। বলা ভাল, এই প্রযুক্তির ব্যবহার গবেষণার কাজেই বেশি হওয়া উচিত। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর মিলি ঘোষের কথায়, “জেমিনি ফ্ল্যাশ ইমেজ মডেলের মতো প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজে গতি আনা সম্ভব।”
কোন জাদুমন্ত্রে জ্যান্ত পুতুল?
কৃত্রিম মেধা শুরু থেকেই ছবির স্থান-কাল-পাত্র পরিবর্তনের কাজে নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করছে। এই কারণে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে নিজের ভান্ডারে মজুত রাখছে। তার পর সেই ভান্ডার থেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করছে। নতুন করে ছবি তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ এলে চাহিদা অনুযায়ী কাজ সম্পূর্ণ করে চলেছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইইএসটি), শিবপুরের ইনফরমেশন টেকনোলজির অধ্যাপক অরিন্দম বিশ্বাসের মতো, অতীতে পাওয়া নির্দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং চাহিদা অনুযায়ী ছবি বানিয়ে দেয় ‘জেনারেটিভ এআই’।
যে কোনও ব্যক্তি বা প্রাণী বা বস্তুর ছবি-কে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে তোলে এই বিশেষ টুলটি। ছবি: এআই
মানুষের হাতযশেই অসম্ভব-ই বাস্তব—
মেশিন লার্নিং, কম্পিউটার ভিশন, থ্রিডি রিকনস্ট্রাকশনকে এক করে কৃত্রিম মেধার সাহায্যে যে ছবি তৈরি হয়, তার বেশিরভাগই মনুষ্য মেধার দান। কম্পিউটারের এক প্রান্ত থেকে যেমন কোনও মানুষ নির্দেশ দিয়ে ছবি বানানোর অনুরোধ জানাচ্ছে, তেমনই অন্যপ্রান্তে যে কম্পিউটার বা সিস্টেমে ওই তথ্য পৌঁছে ছবি তৈরি হচ্ছে— তা-ও কোনও বিশেষ়জ্ঞের অঙ্গুলি হেলনেই চলছে।
অধ্যাপক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, “সঠিক এবং যথাযথ ছবি বা ভিডিয়ো কৃত্রিম ভাবে তৈরি করার জন্য মানুষের উপস্থিতি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞেরা যত সহজ ভাষায় সঠিক বিষয় নির্দেশ হিসাবে মেশিনকে বলতে পারবে, ততই সুন্দর ভাবে এআই কাঙ্খিত ফলাফল দিতে পারবে।”
কারা হতে পারবেন বিশেষজ্ঞ?
কৃত্রিম মেধা, মেশিন লার্নিং, কম্পিউটেশনাল ম্যাথমেটিক্সের মতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গেই এই ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ থাকে। কিন্তু কৃত্রিম মেধার সাহায্যে তৈরি এই সব ছবি যে শুধু বিনোদনমূলক, তা ভাবলে ভুল হবে। এর মাধ্যমে ভুয়ো ছবি বা ভিডিয়োও মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে।
এই ভুয়ো ছবি বা ভিডিয়ো চেনার জন্যও রয়েছেন বিশেষজ্ঞ। ফলে এই পেশার চাহিদার রয়েছে যথেষ্ট।
বিপদ কোথায়?
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর মিলি ঘোষের কথায়, “জেমিনি ফ্ল্যাশ ইমেজ মডেলের মতো প্রযুক্তির হাত ধরেই শেষ কয়েক বছরে ছবি সম্পাদনার ক্ষেত্রে কল্পনা এবং বাস্তবের মধ্যের সীমারেখা মুছে গিয়েছে। তা ছাড়া, এই কারণে সার্বিক ভাবে যে ভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাতে প্রযুক্তির অপব্যবহার বা ব্যক্তির পরিচয় নকল করার মত অপরাধ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে।”
আইআইইএসটি-র অধ্যাপক অরিন্দম বিশ্বাসের মতে, মানুষ আনন্দ পাওয়ার ছলে এই ধরনের টুল ব্যবহার করছে দেদার, তাতে বাস্তবের সঙ্গে মেশিন দিয়ে তৈরি করা বাস্তবধর্মী ছবির বিভেদ দ্রুতই দূর হয়ে যাচ্ছে। তাতে তথ্য চুরি, অস্তিত্বের সঙ্কটের মতো সমস্যা বৃদ্ধির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ইন্টারনেটে পাওয়া ছবির গুরুত্বও কমে যাবে বলেই মনে করেন অধ্যাপক।