“বাঁচাও আমার মেয়েকে...!”
সে দিন আর্তনাদ করে উঠেছিলেন ছ’বছরের শিশুকন্যার অসহায় মা। তার পর রক্তাক্ত মেয়েকে নিয়ে হাসপাতাল, থানা, আদালত। বিচারক যখন ছোট্ট মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী হয়েছে তোমার সঙ্গে?” আধো গলায় মেয়েটি শুধু বলতে পেরেছিল, “আমায় জড়িয়ে ধরেছিল, আমার ব্যথা লাগছিল খুব!”
নাবালিকা ধর্ষণ মামলার সওয়াল-জবাব সহ্য করার মতো ক্ষমতাই ছিল না ছোট্ট মেয়েটির। মানসিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল প্রায় অনিবার্য ভাবে। খোদ কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এমন এক ঘটনা নাড়িয়ে দেয়নি শহরকে। তবু, বেঁচে আছে মেয়েটি। কেমন আছে সে?
সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাত ধরে এগোলেই উচ্চবিত্ত প্রাসাদ-মহলের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ঝুপড়ি। খোলা আকাশের নীচে চলার পথেই বসত গড়েছে বহু মানুষ। সেখানে থাকে এই মেয়েটিও। বাবা ডুবে থাকেন নেশায়। মা কাজ করেন গৃহকর্ম সহায়িকা হিসাবে। তাঁর উপার্জনেই মুখে গ্রাস ওঠে দু’বেলা। এমন সংসারে মেয়ের পড়াশোনার কথা ভাবাই যায় না। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই ভাবেন, ছোট্ট মেয়েকে ভিক্ষাপাত্র দিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দিলে বরং দু’পয়সা রোজগার হতে পারে।
কিন্তু হয়নি তেমন।
দালানে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। —নিজস্ব চিত্র।
এক ভোরে খুলে গিয়েছে রামধনু রঙের দরজা। ফুটেছে ভোরের আলো। নির্যাতিতা শিশুটির বয়স এখন সাত। যে দিন রক্ত মাখামাখি অবস্থায় ঘরে ফিরে মাকে বলেছিল “ব্যথা করছে মা”, সে দিন বুঝতেই পারেনি কী ঘটে গিয়েছে। সেই প্রথম থানায় গিয়ে পুলিশ দেখেছিল। দৌড়-ঝাঁপ, প্রশ্ন-উত্তরের মাঝখানে উর্দিধারীরাই কি মন কেড়ে নিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটির? তাই বছর পার করে মেয়েটি স্বপ্ন দেখে— পুলিশ হবে।
তাই ভিক্ষাপাত্র নয়, পড়াশোনার পথে চলছে মেয়েটি। ঘুম থেকে উঠেই সে চলে যায় ‘রামধনু বাড়ি’তে। সেখানেই কাটে সারা দিন। ছোট্ট মেয়েটির এখন ভাল লাগে যোগ-বিয়োগের ধারাপাত। সেখান থেকেই স্কুলেও যায়। ফিরে আসে সেই সাতরঙা স্বপ্নের বাড়িতে। বিকেলে নাচ-গান, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা।
দাবা খেলছে ওরা। —নিজস্ব চিত্র।
রামধনু বাড়িতে যাতায়াত আরও ৩০ জনের। বেশির ভাগই বালিকা বা কিশোরী। বয়স পাঁচ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। সকলের গল্প যেন একই মুদ্রার এ পিঠ কিংবা ও পিঠ।
টিনার জন্মের পরই তার মা ফেলে রেখে চলে যায় তাকে। বাবা ভবঘুরে। ছোট্ট মেয়েটির ভরসা ৯০ বছরের ঠাকুমা। পেট ভরাতে ঠাকুমা রাস্তায় রাস্তায় কাগজ কুড়োন। সঙ্গে যেতে হয় নাতনিকেও। তবু, স্কুলে যায় সে। আবার শান্তা পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। তার পারিবারিক পরিস্থিতিও বাকিদের থেকে আলাদা নয়। বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চায়। যদিও তার পছন্দের বিষয় ইংরেজি। স্কুল ছুটি থাকলে সারা দুপুর বেলা মিমির সঙ্গে দাবার ছকে ‘চেক মেট’ করে সে।
এক কোনায় মন দিয়ে ইংরেজি পড়ছে। —নিজস্ব চিত্র।
এদের কারও রাতের ঠিকানা সুলভ শৌচালয়ের সিঁড়ি, কেউ রাত কাটায় ফুটপাতে। অনেক মেয়েই বাবার পরিচয় জানেই না। অথবা আদরের বাবা ডুবে থাকে নেশায়, মারধর করে মাকে। নানা ধরনের নির্যাতন ওদের কাছে খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবু, তারই মধ্যে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করে ওরা। টিনা, শান্তা, মিমিরা (সকলের নাম পরিবর্তিত) ফুটপাতে শুয়েই স্বপ্ন দেখে। স্কুলে যায়, নাচ শেখে, কাঁটা বুনে বুনে শীতপোশাক বানায়। সাদা খাতা ভরে যায় রঙে। ভাল লাগে ওদের।
রামধনু বাড়িতে দক্ষিণ কলকাতার ফুটপাতবাসী প্রায় ৩২ জন মেয়ের রোজ আনাগোনা। দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা ছবি। কোথাও লাগানো রয়েছে ‘ভাল ছোঁয়া’, ‘খারাপ ছোঁয়া’র বিশেষ বার্তা। কোথাও আবার ঋতুস্রাব নিয়ে সচেতনতা। ওই বাড়িতেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাটায় প্রতিটি শিশু। প্রাতরাশ থেকে রাতের খাবার— জোগান মেলে সেখানেই।
প্রথম প্রথম ওদের কারও পরিবারই সন্তানের পড়াশোনায় আগ্রহী ছিল না। কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতা নিবাসী মিত্রবিন্দা ঘোষ। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতবাসী শিশুদের নিয়ে ২০১৯-এ পথ চলা শুরু তাঁর। তিনি বলেন, “প্রথম দিকে ওদের সঙ্গে কথা বলতাম ফুটপাতেই। সেখানেই পড়াশোনা, আঁকা। সামান্য সময়। দল বড় হতেই আমরা পাশের একটা মাঠে জড়ো হতাম। কিন্তু এ ভাবে তো চলতে পারে না। তাই রামধনু বাড়ির জন্ম।”
পরিবার এবং বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে মিত্রবিন্দা সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কাছাকাছিই একটি বাড়ি ভাড়া নেন। সেখানে সারা দিনের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত ছোট্ট শিশুগুলির। যাতে পরিবারের আঁধার থেকে দূরে থেকে আলোর পথ পায় ওরা। মিত্রবৃন্দা বলেন, “আমি চাই এই অসহায় মেয়েরা বাঁচার একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাক। ওরা নিজেরা ঠিক-ভুলটা বুঝুক।”
রোজ ভোরে খুলে যায় রামধনুর দরজা। দু’টি ঘর এবং একটি বড় দালানযুক্ত সে বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সোজা তিন তলায় উঠে গেলেই দেখা যায় ওদের। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ নাচছে, এক কোনায় মন দিয়ে ইংরেজি পড়ছে, আবার কেউ মগ্ন দাবা খেলায়। স্কুল ছুটির দুপুরগুলো এ ভাবেই কেটে যায় ওদের। সারা দিন কাটিয়ে শুধু রাতে ওরা ফিরে যায় পরিবারের কাছে। পর দিন ভোরে আবার ফোটে সাতরঙা আলো।