২০০৮-’০৯ সালে জঙ্গলমহলে লালগড়কেন্দ্রিক আন্দোলনের প্রধান মুখ ছিলেন বছর পঞ্চাশের ছত্রধর মাহাতো। ছত্রধরের বাড়ি লালগড়ের আমলিয়ায়। পারিবারিক পেশা চাষাবাদ হলেও ছত্রধর শালপাতার ব্যবসা করতেন। তাঁকে সামনে রেখে পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটির আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল জঙ্গলমহল। শোনা যায়, তাদের শীর্ষ নেতা শশধর মাহাতোর ছাপোষা বড়দা ছত্রধরকে সামনে রেখে কমিটির আন্দোলনের রাশ ছিল মাওবাদীদেরই হাতে। তবুও জঙ্গলমহলে ছত্রধর মাহাতোকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবতার হিসেবেই দেখে এসেছেন এলাকাবাসী। আন্দোলন-পর্বে এক দিকে, যখন মাওবাদীদের হাতে একের পর এক সিপিএম নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, তখনই হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে এলাকা ঘুরে একের পর এক গ্রামে কমিটির আধিপত্য বিস্তার করেছেন ছত্রধর। ছত্রধরের সভা-মিছিলে ছদ্মবেশে মাওবাদীরা থাকলেও, কমিটির আন্দোলনে বরাবরই গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার পক্ষেই সওয়াল করে এসেছেন এই কমিটি নেতা। শশধরের কথা কেউ জানতে চাইলে ছত্রধর বলতেন, ‘ভাইয়ের আর আমার পথ এক নয়। আমি ব্যবসা করে খাই।’
পরে সেই ছত্রধরকেই একেবারে অন্য রূপে দেখল জঙ্গলমহল। ২০০৮-এর ২ নভেম্বর। শালবনিতে ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করে ফিরছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মেদিনীপুর শহরের অদূরে ভাদুতলায় বুদ্ধবাবুর কনভয়ে মাইন ফাটল। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন বুদ্ধবাবু ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান। জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হল পুলিশি ধরপাকড়। তিন দিন পরে ৫ নভেম্বর ভোররাতে লালগড়ের ছোটপেলিয়া গ্রামে তল্লাশিতে যায় লালগড় থানার পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে ওই গ্রামের আদিবাসী মহিলাদের নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে। পুলিশের বন্দুকের নলের খোঁচায় ছিতামণিদেবীর বাঁ চোখটি নষ্ট হয়ে যায় বলে অভিযোগ।
আদিবাসী মহিলাদের সেই নিগ্রহের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠল লালগড়। ক্রমে ‘জনসাধারণ’ পোস্টার দিয়ে গাছ কেটে শুরু হল অবরোধ-আন্দোলন। গঠিত হল ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটি’। সেই কমিটির মুখপাত্র হিসেবে হঠাৎই আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় উঠে এলেন ছত্রধর। জঙ্গলমহলের নিপীড়িত, শোষিত আদিবাসী-মূলবাসীদের নিয়ে ছত্রধরের নেতৃত্বে অভাবনীয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মিছিলের সাক্ষী থাকল সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম। আন্তর্জাতিক স্তরে সেই আন্দোলন নিয়েও চর্চা চলল। ওই সময় পুলিশের রিপোর্ট বলছে, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা নিজেদের সংগঠন বিস্তারের জন্য দৃশ্যত একটি ছদ্ম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ‘মডেল’কে বাস্তবায়িত করেছিল। ছত্রধর ছিলেন সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাণ্ডারী।