ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে মার্কিন সি-১৭ বিমান। ছবি: এপি
শেষমেশ ইরাকে বিমান আক্রমণ চালাল আমেরিকা। বৃহস্পতিবার প্রয়োজনে সীমিত বিমান আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। নিজের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনার পরে এই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পাশাপাশি, কোনও পরিস্থিতিতেই ইরাকে মার্কিন সেনা ফিরবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। এর আগেই পেন্টাগন জানিয়েছিল, সুন্নি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া-র (আইএসআইএস) হানায় ইরাকের উত্তর-পশ্চিমে সিনজার পর্বতে আশ্রয় নেওয়া ইয়াজিদি সম্পদায়ের খ্রিস্টানদের জন্য বিমান থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলা হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই হয় ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, নয় আইএসআইএস-এর অত্যাচারে মারা যেতে পারেন বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এর পরেই এ দিন উত্তর ইরাকে আইএসআইএস-এর গোলাবারুদের সংগ্রহে বিমান আক্রমণ চালান হয় বলে পেন্টাগন জানিয়েছে। এখানে থেকে উত্তরে কুর্দদের উপরে হামলা চালানো হচ্ছিল। ইরাকে সরকারি সূত্রে খবর, উত্তর ইরাকের সিনজার প্রদেশে এই মার্কিন হানায় আইএসআইএস-এর ৪৫ জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে, আহত ৬০ জন। এই হানার অনুমতি দিলেও বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “বিশ্বের সব সমস্যার সমাধান করা আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা চোখ বুজেও থাকতে পারে না।” সিনজার পর্বতে খ্রিস্টানদের গণহত্যা আটকানোর জন্য ত্রাণের পাশাপাশি প্রয়োজনে বিমান আক্রমণও জরুরি বলে তিনি জানান।
সিরিয়ার বেশ কিছু অংশে প্রভাব বিস্তার করার পরে চলতি বছরের মার্চ থেকে ইরাকের সুন্নি প্রধান অঞ্চলগুলিতে অভিযান শুরু করে সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসআইএস। তাদের ঝড়ের বেগে আক্রমণে উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম ইরাকের একের পর এক শহরের পতন হয়। সঙ্কটে পড়ে যায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আল-মালিকির নেতৃত্বাধীন সরকার। এর পরে নিজেদের দখল করা এলাকা ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিচয় দিয়ে খিলাফতের ঘোষণা করে আইএসআইএস। নিজেদের নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিকে খলিফা বলেও ঘোষণা করে তারা। এর পরে বেশ কিছু দিন আইএসআইএস-এর অগ্রগতির চেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। এর মধ্যে অবশ্য ইরাকের শিয়া-প্রধান সরকারের সেনা সংগঠিত হয়ে আইএসআইএস-কে পাল্টা আঘাত হানতে থাকে। কয়েকটি শহর ইরাকি সেনা পুনর্দখলও করেছিল। কিন্তু তার পরেও ইরাকের একটি বড় অংশ আইএসআইএস-এর দখলে থেকে যায়।
আইএসআইএস-এর সঙ্গে লড়াইয়ে ইরাকি সেনাকে সাহায্য করতে আমেরিকা আগেই মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞ ও সেনার প্রায় ৩০০ জনের দলকে ইরাকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মালিকির বার বার অনুরোধেও আকাশপথে আইএসআইএস জঙ্গিদের উপরে আক্রমণ চালাতে অস্বীকার করেছিল আমেরিকা। এ নিয়ে মালিকি সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতিও হয়। এমনকী, মার্কিন সাহায্য না পেয়ে মালিকি, রাশিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কেনেন। এ বার সেই ইরাকেই বিমান হামলার অনুমতি দিলেন ওবামা। এর পিছনে ইরাকের সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের সাম্প্রতিক সঙ্কট দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ক’মাসে নিজেদের দখল করা এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন বলবৎ করে আইএসআইএস। আইএসআইএস-এর দখলে থাকা ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলে খ্রিস্টানদের ধর্ম পরিববর্তন বা মৃত্যুবরণ— কোনও একটি বেছে নিতে বলা হয়। খ্রিস্টানদের বাড়িগুলিকে চিহ্নিত করা হয়। নানা ভাবে তাদের উপর সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। রেয়াত করা হয়নি শিয়াদেরও। মসুলে থাকা প্রাচীন শিয়া মসজিদ ও স্মারক ধ্বংস করে আইএসআইএস। তাদের ক্রমাগত অত্যাচারে অনেক খ্রিস্টান ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। এর মধ্যে অনেকেই কুর্দদের দখলে থাকা ইরাকের বৃহত্তম খ্রিস্টান শহর কারাকোশ আশ্রয় নেন।
কিন্তু কয়েক দিন আগে আবার এলাকা দখল করা শুরু করে আইএসআইএস জঙ্গিরা। এ বার তাদের লক্ষ্য উত্তরের কুর্দ স্বায়াত্তশাসিত অঞ্চল। বুধবারই আইএসআইএস-এর হাতে কারাকোশ-এর পতন হয়েছে বলে ফ্রান্সের সরকারের পক্ষ থেকে জানান হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এর মধ্যেই কারাকোশ শহরের চার্চগুলি থেকে ক্রস নামিয়ে দিয়েছে জঙ্গিরা। ধ্বংস করা হয়েছে বেশ কয়েকটি চার্চও। প্রাণভয়ে খ্রিস্টানরা কুর্দ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের দিকে যাচ্ছেন। পিছনে ধাওযা করছে আইএসআইএস জঙ্গিরা। অন্য দিকে, সিনজার শহরও আইএসআইএস-এর দখলে চলে এসেছে। এই শহরেও অনেক খ্রিস্টান বাস করতেন। কিন্তু আইএসআইএস আসার পরে এখান থেকে প্রায় দুই লক্ষ খ্রিস্টান ইরাকের উত্তর-পশ্চিমে সিনজার পর্বতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় ইয়াজিদি গোষ্ঠীর পঞ্চাশ হাজার খ্রিস্টান রয়েছেন। এঁরা রোমান ক্যাথলিক। বৃহস্পতিবারই এঁদের অবস্থা নিয়ে ভ্যাটিকানের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। ইয়াজিদিরা সিনজার পর্বতে আটকে রয়েছেন বলে খবর। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় এদের মধ্য অনেকেরই খারাপ অবস্থা। বিশেষ করে অনেক শিশুরই ডিহাইড্রেশন হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এই অবস্থায় পেন্টাগনের পক্ষ থেকে জানান হয়, তারা পর্বতে ত্রাণসামগ্রী ফেলছে। কিন্তু এখানে এ ভাবে আরও কিছু দিন আটকে থাকলে অনেকেরই মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। তারা কুর্দদের দখলে থাকা এলাকার দিকেও যেতে পারছেন না। কারণ, পথ আটকে রয়েছে আইএসআইএস।
এ দিকে আইএসআইএস আরও এগিয়ে কুর্দদের দখলে থাকা আরবিলের দিকে যেতে পার বলে আশঙ্কা। সে ক্ষেত্রে কুর্দ পেশ-মেরগা যোদ্ধাদের শক্তি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।ফলে কুর্দদের অস্ত্র সাহায্যের কথাও ভাবছে মার্কিন প্রশাসন। এ দিনের বিমান হামলা তারই সূচনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ওবামা বলেন, “ইরাকের জন্য কোনও মার্কিনি-দাওয়াই মজুত নেই। ইরাকের সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।” তাই বিমান হানার অনুমতির পাশাপাশি মালিকিকে সর্বদল সম্বনয় করে নতুন সরকার গঠনের জন্য চাপ বজায় রেখেছে মার্কিন প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy