হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ছবি: এএফপি।
আশঙ্কাই সত্যি হল। ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) জঙ্গিদের নির্মূল করতে ইরাকের পাশাপাশি সিরিয়াতেও অভিযান চালানোর কথা জানালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বুধবার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ১৫ মিনিটের ভাষণে তিনি এই কথা বলেন। আইএস-এর উদ্দেশ্যে ওবামা বলেন, ‘‘তুমি যদি আমেরিকাকে ভয় দেখাও, তুমি কোথাও নিরাপদ আশ্রয় পাবে না।’’
আইএস যে আল-কায়দা থেকেই উদ্ভূত তা মনে করিয়ে দিয়ে ভাষণে বারাক ওবামা জানান, জাতিবিরোধিতার সুযোগ নিয়ে সিরিয়া ও ইরাকের এক অংশ তারা প্রভাব বিস্তার করলেও ইসলামিক স্টেট বলে কিছু হয় না। তিনি বলেন, ‘‘আমি পরিস্কার বলছি, যে জঙ্গিরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে তাদের আমরা খুঁজে বার করবই, সে তারা যেখানেই থাকুক না কেন। এর অর্থ, ইরাকের মতো সিরিয়াও আইএস-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমার দ্বিধা হবে না।’’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানান, সিরিয়ায় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে প্রধানত বিমান অভিযান চালানো হবে। একই সঙ্গেই ইরাকি ও কুর্দ সেনাদের সাহায্যের জন্য আরও ৪৭৫ জন মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠানোর কথাও বলেন তিনি। তা ছাড়া তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্যও করা হবে। কিন্তু কোনও ভাবেই সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সাহায্য করা হবে না বলেও তিনি জানিয়েছেন। পাশাপাশি আইএস-এর জন্য বিপন্নদের ত্রাণের কাজও চলবে। তবে এই অভিযানকে যুদ্ধ বলতে রাজি হননি ওবামা। তিনি একে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান বলেই মনে করছেন। এর জন্য কোনও সময়সীমাও নির্দিষ্ট করেননি তিনি। বেশ কিছু দিন ধরেই আইএস-কে নির্মূল করার নীতি সর্বসমক্ষে আনার কথা বলছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। মঙ্গলবারই এ বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে তিনি আলোচনাও করেন। তবে কংগ্রেসের দাবি মেনে, সিরিয়ায় আক্রমণ চালানোর আগে ভোটাভুটির প্রস্তাবে তিনি সম্মত হননি।
ইরাকে আইএস-এর বিরুদ্ধে সীমিত মার্কিন অভিযান শুরু হওয়ার পরেই আইএস মূল ঘাঁটি সিরিয়ায় অভিযান চালানোর কথা উঠতে থাকে। ইরাকে সীমিত বিমান অভিযানে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার সময়ে দু’টি লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন ওবামা। এক, ইরাকে মার্কিন নাগরিক ও সম্পত্তির রক্ষা। দুই, ইরাকের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষিত রাখা। মার্কিন সীমিত অভিযানে সাফল্য মিলতে শুরুও করে। আইএস-এর থেকে নিজেদের এলাকা সুরক্ষিত করার পরে উজ্জ্বীবিত কুর্দ পেশমেরগা যোদ্ধারা মসুল বাঁধও দখল করে নেয়। কুর্দ পেশমেরগাদের সঙ্গে মিলিত হয় ইরাকি সেনা ও শিয়া মিলিশিয়ারাও। দখলে আসে হাদিথা বাঁধ। আমেরলি থেকে আইএস-এর অবস্থান হঠিয়ে শিয়া তুর্কমেনদেরও উদ্ধার করা হয়।
মার্কিন অভিযানের প্রতিবাদে দুই মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফোলি ও স্টিভেন সটলফকে হত্যা করে আইএস-এর জঙ্গিরা। আইএস-এর বিরুদ্ধে এর আগে বার বার গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ এনেছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। সাংবাদিক সম্মেলনে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব চাক হেগেল জানিয়েছিলেন, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আইএস অন্য জঙ্গি সংগঠনের থেকে অনেক এগিয়ে। আইএস-কেই আমেরিকার নিরাপত্তার প্রধান সমস্যা বলে তিনি চিহ্নিত করেন। পাশাপাশি মার্কিন সেনার চিফ অফ স্টাফ জেনারেল মার্চিন ডেম্পসি জানান, আইএস-কে নির্মূল করতে হলে সিরিয়ায় অভিযান চালানো জরুরি। এর কিছু দিন পরেই সিরিয়ার উপরে বিমানে নজরদারি চালানোর সবুজ সঙ্কেত দেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এর লক্ষ্য ছিল আইএস-এর শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে এবং আইএস-এর ঘাঁটিগুলি সম্পর্কে আরও নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করা।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ে প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ বিরোধী সুন্নিদের থেকে আইএস-এর উত্থান। প্রখমে শুধু বাসারের বিরোধিতা করলেও পরে বিরোধী দলগুলির সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। আসাদ বিরোধী শক্তির একাধিক নেতা ও কর্মীকে হত্যার অভিযোগ আইএস-এর বিরুদ্ধে আছে। এমনকী তারা আল-কায়দার ছাতার তলা থেকেও বেরিয়ে আসে। কারণ, আইএস-এর তীব্র উগ্র ইসলামি জেহাদের তত্ত্ব মানতে পারেনি আল-কায়দা নেতৃত্বও। সিরিয়ার রাক্কা প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে ক্রমেই এর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর পরেই তাদের ইরাক অভিযান, এক-তৃতীয়াংশ দখল করে নেওয়া এবং খিলাফতের ঘোষণা। পশ্চিমী দেশগুলির থেকেও অনেকে আইএস-এর হয়ে যুদ্ধে নেমেছে। শুধু মতবাদ নয়, আইএস-এর আর্থিক ক্ষমতাও অধিকাংশ জেহাদিকে আকর্ষণ করেছে।
আইএস-কে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর আমেরিকা তাই এর বিরুদ্ধে লড়াই-এ জোট গড়ে তোলার কথা জানিয়েছিল। ইরাকে হায়দার আল-আবিদির নতুন সর্বসম্মত সরকার সোমবারই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। তার পরেই ওবামার এই ঘোষণা। মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরি মধ্যপ্রাচ্য সফর করছেন। বুধবার তিনি ইরাকে ছিলেন। ওবামা জানান, মধ্যপ্রাচ্যে জোট গড়ে তোলার কাজ করতেই তিনি গিয়েছেন। এর সাড়াও মিলতে শুরু করেছে। আরব লিগ আইএস-এর বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছে। এমনকী আমেরিকা বিরোধী আসাদ ও ইরান সরকারও আইএস বিরোধী অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে সিরিয়ার আক্রমণ চালানোর আগে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য আসাদ সরকার আমেরিকাকে জানিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই জোট গড়ে তোলা যথেষ্ট কঠিন কাজ। মধ্যপ্রাচ্যেই বিভিন্ন দেশকে এক সঙ্গে আনা দুরূহ। শিয়া ও সুন্নি প্রধান দেশগুলির এ ক্ষেত্রে প্রায় ভিন্ন মত। পাশাপাশি জোট গড়লেও আমেরিকার লক্ষ্য থাকবে আসাদ সরকার, ইরান এবং লেবাননের শিয়া মিলিশিয়ারা যাতে কোনও ভাবে শক্তিশালী হয়ে না ওঠে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। বুধবারই হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে জানান হয়েছে, আইএস ছাড়া সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী মধ্যপন্থী শক্তিগুলিকে একজোট হতে সাহায্য করবে সৌদি আরব। বৃহস্পতিবারই জন কেরির সৌদি আরব যাওয়ার কথা। অন্য দিকে, শুক্রবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইরাক সফরে আসবেন। ফ্রান্স, ইরাকে আইএস-এর বিরুদ্ধে বিমান অভিযানে অংশ নিতে ইচ্ছুক হলেও সিরিয়ার ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন মত বলে জানিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy