ছবি: এপি
মারা গেলেন অস্কার জয়ী ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবরো। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। বেশ কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। অ্যাটেনবরোর পরিবার সূত্রে খবর, রবিবার দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের সময়ে মৃত্যু হয়েছে এই পরিচালক-অভিনেতার।
ফিল্মের সঙ্গে অ্যাটেনবরোর সম্পর্ক প্রায় ছয় দশকের। ক্যামেরার সামনে এবং পিছনে— দুই ভূমিকাতেই সমান সাবলীল ছিলেন তিনি। অভিনেতা হিসাবে ব্রাইটন রকের পিঙ্কি ব্রাউন, দ্য গ্রেট এসকেপের স্কোয়াড্রেন লিডার রজার বার্টলেট থেকে হালের জুরাসিক পার্কের বৃদ্ধ জন হ্যামন্ড দর্শকের মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। তবে পরিচালক-প্রযোজক অ্যাটেনবরোকে মানুষ মনে রাখবে ‘গাঁধী’ ছবিটির জন্য। ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটির জন্য অ্যাটেনবরো দু’টি অ্যাকাডেমি, দু’টি বাফটা এবং দু’টি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পান। প্রতিক্ষেত্রেই সেরা পরিচালক এবং বছরের সেরা ফিল্মের সম্মান পায় সিনেমাটি। আটটি অস্কার জিতে সর্বকালের অন্যতম সেরা ছবিগুলির তালিকায় ঢুকে পড়ে সিনেমাটি। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করে অভিনেতা বেন কিংসলে বলেছেন, “‘গাঁধী’-র মতো সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে আমাকে মনোনীত করার জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকব। সব সময়েই তাঁর অভাব অনুভব করব আমরা।” ‘গাঁধী’-র জন্য সেরা অভিনেতার অস্কার জিতেছিলেন কিংসলে। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন টুইট করেন, “ব্রাইটন রক এবং গাঁধীর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো। বিনোদন জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হল।”
১৯২৩ সালে জন্ম রিচার্ড অ্যাটেনবরোর। মাত্র ১২ বছর বয়সে ‘দা মাউসট্র্যাপ’ নাটক দিয়ে অভিনয় জীবনে আত্মপ্রকাশ। এর ছ’বছর পর শুরু করেন পেশাদার নাট্য জীবন। ১৯৪২ সালে ‘ইন হুইচ উই সার্ভ’ দিয়ে সিনেমায় আত্মপ্রকাশ। ব্রিটিশ অ্যকাডেমি অফ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টসের সভাপতি ছিলেন তিনি, ছিলেন প্রিমিয়ার লিগের বিখ্যাত ক্লাব চেলসির আজীবন প্রেসিডেন্ট।
চলচ্চিত্র জগতে শেষ বড় ইংরেজ
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
রিচার্ড অ্যাটেনবরো সম্ভবত চলচ্চিত্রের জগতে রবীন্দ্রনাথ কথিত শেষ বড় ইংরেজ। ক্রমশই তিনি হয়ে উঠছিলেন মহারানির সেই নীলরক্তের সুসন্তানদের অন্যতম, যাঁরা ব্রিটিশ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। আর এই জন্যই সত্তর দশকের মাঝামাঝি তাঁকে ‘নাইটহুড’-এ সম্মানিত করা হয়। অথচ, চল্লিশের দশকে যখন তিনি প্রথম ছায়াছবির দুনিয়ায় এলেন, তখন অভিনেতা হিসেবে ‘ইন হুইচ উই সার্ভ’ ছবিতে (১৯৪২) তিনি মোটেই শীতলচক্ষু, চাপা চিবুকের ইংরেজ ভদ্রলোক নন, বরং যেন একটু উদাসীন যুবা যাঁর ঠোঁটে অনিশ্চয়তা।
গাঁধী ছবির শ্যুটিং চলাকালীন বেন কিংসলের সঙ্গে আলাপচারিতায়।
আমরা বুঝতে পারলাম, সিনেমার বীরপুরুষদের মধ্যে অ্যাটেনবরো এক জন আকর্ষণীয় ‘কাপুরুষ’। শার্ট আর প্যান্ট পরিহিত অ্যাটেনবরো তখনও পর্যন্ত ষাট দশকের লঘু পাখনার টিনএজারদের মতো নন, কিন্তু কোথাও রক্ষণশীল সমাজের একটা ফাটল।আর আশ্চর্য, সেই অ্যাটেনবরোই অস্কার পেলেন তাঁর কুড়ি বছরব্যাপী সাধনার ফসল ‘গাঁধী’র জন্য। যে ছবিতে আমরা দেখতে পাই শাসক কী ভাবে শাসিতের সুমিত মূল্যায়ন করে। গাঁধী, শেষ বিচারে, এমন এক প্রতিরূপায়ণ যা ইংরেজ গণতান্ত্রিক সমাজের আত্মবিশ্বাসের লক্ষ্মণ। এই যে দূর ভারতবর্ষে এখনও আমরা ইংরেজিয়ানা বলতে, হয়তো ভুল ভাবে সমায়ানুক্রমিতা, সমদেশদর্শিতা বা সুবিচার বুঝি, তার অনেকটাই কারণ অ্যাটেনবরোর চিত্রনাট্য।
‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’তে সত্যজিত্ রায়ের সঙ্গে অ্যাটেনবরো।
তবে রিচার্ড অ্যাটেনবরো আমাদের সম্পূর্ণ জয় করে নিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’তে। জেনারেল উট্রামের ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয় সাম্রাজ্যবাদ ও মনুষ্যত্বের অন্তর্বর্তী অবস্থান। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-র সামনে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও তিনি যে শব্দ হারিয়ে ফেলেন, তাঁর অবনত নীল চক্ষু, বস্তুত, ইংরেজ রাজশক্তির পক্ষ থেকে ভারতীয়দের কাছে একটি ক্ষমাপ্রার্থনা। অযোধ্যা অধিকার কত দূর আইন সমর্থিত তা ব্রিটিশ সংসদেরও জানা ছিল না। বরং জেমস উট্রাম তাঁর ব্রিটিশ আভিজাত্যবোধ থেকেই জেনেছিলেন, বস্তুত, অযোধ্যা দখল ব্রিটিশ সিংহের কদর্য নখদন্ত প্রদর্শন। তবু রাজকর্তব্য, লর্ড ডালহৌসির নির্দেশ পালন করতে হল তাঁকে। হয়তো ‘জুরাসিক পার্ক’-এর বৃদ্ধটিকেও আমরা মনে রাখব। তবু, স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবরোর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে মহারানির শিলমোহর আর একটু ক্ষয়ে গেল এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
রিচার্ড অ্যাটেনবরোর স্মরণীয় কিছু সিনেমা
অভিনেতা
পরিচালক
• ইন হুইচ উই সার্ভ (১৯৪২)
• ব্রাইটন রক (১৯৪৭)
• দা লিগ অফ জেন্টলম্যান (১৯৬০)
• দা গ্রেট এসকেপ (১৯৬৩)
• ডক্টর ডুলিটল (১৯৬৭)
• ১০ রিলিংটন প্লেস (১৯৭১)
• জুরাসিক পার্ক (১৯৯৩)
• মিরাকল অন থার্টিফোর্থ স্ট্রিট (১৯৯৪)
• এলিজাবেথ (১৯৯৮)
• ইয়ং উইনস্টোন (১৯৭২)
• গাঁধী (১৯৮২)
• আ কোরাস লাইন (১৯৮৫)
• ক্রাই ফ্রিডম (১৯৮৭)
• চ্যাপলিন (১৯৯২)
• স্যাডোল্যান্ডস (১৯৯৩)
• ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৬)
• গ্রে আউল (১৯৯৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy