আদালত চত্বরে মদন মিত্র। মঙ্গলবার রণজিত্ নন্দীর তোলা ছবি।
সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে ফের তিন দিন সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল আদালত। আগামী ১৯ তারিখ তাঁকে আদালতে হাজির করাতে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
আবার যাতে সিবিআই হেফাজতে না যেতে হয়, সে জন্য মঙ্গলবার আদালতে দাঁড়িয়ে বিস্তর চেষ্টা করেছিলেন মদন! নিজেই বিচারককে জানিয়েছিলেন, কী ভাবে ‘ভয়’ দেখাচ্ছেন সিবিআই-এর গোয়েন্দারা। এমনকী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলার জন্যও তাঁর উপর ‘মানসিক অত্যাচার’ করা হচ্ছে। করজোড়ে বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়কে বললেন, “স্যার। দয়া করে আমাকে আর সিবিআই হেফাজতে পাঠাবেন না। ওখানে গেলে আমি মরে যাব।” পাঁচ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে মন্ত্রী মদন মিত্রকে নিতে চেয়েছিল সিবিআই। নিজেদের হেফাজতে মদনকে ফের নেওয়ার আবেদন জানিয়ে এ দিন আদালতে সিবিআইয়ের আইনজীবী জানিয়েছেন, সারদা প্রতারণা মামলায় সরাসরি অভিযুক্ত মন্ত্রী। তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনই বেশ কিছু নথি ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে। শুনানি শেষে সেই আর্জি মেনে ফের মদনকে তাদের হেফাজতে তিন দিনের জন্য পাঠালেন আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট।
আদালতে মদন এ দিন নিজে থেকে বলে বসেন, “ওরা আমাকে দিয়ে জোর করে বলিয়ে নিতে চাইছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাকা নিয়েছেন। আমি বলিনি। বলব না। তখন ৫০ জন অফিসার এসে চিৎকার করে আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।” প্রশ্ন উঠেছে, আদালতে কেউ তাঁকে মমতার নাম বলতে বলেননি। আদালতে তাঁর আইনজীবীদেরই তো সওয়াল করার কথা। তা হলে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে কেন আচমকা মমতার নাম করলেন মদন? ১১ সেপ্টেম্বর ঠিক এ ভাবেই তো রজত আচমকা নিজে থেকে বলে উঠেছিলেন, “সাত দিন কেন, সত্তর দিন হেফাজতে রাখুন। কিন্তু, মমতা ও মুকুলকে টাকা দিয়েছি তা বলাতে পারবেন না।”
মন্ত্রীর গ্রেফতারির ঘটনা নিয়ে এ দিন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী জানান, আদালতের উপর ভরসা রাখা উচিত। তাঁর মতে, গুরুতর মামলায় মদনবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে এজেন্সি এর তদন্ত করছে, সেটিও অতি উচ্চ পর্যায়ের। এর পর ওই এজেন্সিকে প্রমাণ দাখিল করতে হবে। তার উপর নির্ভর করবে বিচার। রাজ্যপাল সাধারণ মানুষকে আইনের উপর আস্থা রাখতে পরামর্শ দেন।
গত শুক্রবার গ্রেফতারের পরে শনিবারই মদন মিত্রকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়। ওই দিন বিচারক তাঁকে চার দিন সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সে কারণেই এ দিন দুপুর ২টো ৫০ মিনিট নাগাদ মদনকে আলিপুর আদালতে নিয়ে আসা হয়। তিনি ঠিক কোন গাড়িতে আছেন জনতা তা বোঝার আগেই পুলিশ তাঁকে নিয়ে আদালত চত্বরে ঢুকে যায়। আদালত কক্ষে ঢোকার আগে জনতার উদ্দেশে হাতও নাড়েন মন্ত্রী। কিন্তু, আদালত চত্বরের বাইরে ব্যারিকেড করে মদনবাবুর যে অনুগামীদের আটকে রেখেছিল পুলিশ, গাড়ির কনভয় দেখে তাঁরা উত্তাল হয়ে ওঠেন। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি বাধে।
বেলা সওয়া দু’টো নাগাদ তাঁকে সঙ্গে করে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে পাঁচটি গাড়ির কনভয় নিয়ে আলিপুর আদালতের উদ্দেশে রওনা হন সিবিআই আধিকারিকরা। মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন আর এক ধৃত আইনজীবী নরেশ ভালোড়িয়া। মদনকে যখন সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন ওই চত্বরে প্রচুর উৎসাহী মানুষের ভিড়। অফিসকর্মী থেকে শুরু করে পথচারী লোকজনদের মাঝে কিছুটা স্তিমিত লেগেছে মদন-অনুগামীদের। তবুও ‘দাদা’ যাওয়ার আগে তাঁদের বলে যান, “আদালতে বিচার হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মেনে চলুন। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।”
এ দিন সকাল সওয়া ৭টা নাগাদ বিধাননগর ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানা থেকে বার করে মদনকে সিবিআই দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সূত্রের খবর, চা-বিস্কুট খাইয়ে তাঁকে বেশ কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরা। আদালতে হাজির করাতে হবে বলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই করার ব্যাপারগুলিও মিটিয়ে নেওয়া হয় ওই সময়ে। সোমবার মন্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে পরিবারের লোকেদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ দিন সকালেই এক অনুগামীকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। বরাহনগর এলাকার ওই তৃণমূল কর্মী-সমর্থক তথা মদন-অনুগামী অরুণ সেনগুপ্ত সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে বলেন, “দাদা ভাল আছেন। মিনিট দু’য়েক কথা হয়েছে।”
তবে মদন ভাল থাকলেও, তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন সিবিআই কর্মীরা। মন্ত্রীকে আদালতে হাজির করাতে গিয়ে আগের দিন যে ভাবে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে তাদের, সেই বিষয়ে উদ্বিগ্নই ছিল সিবিআই। যদিও সিজিও কমপ্লেক্স এবং আলিপুর আদালত চত্বরে আরও নিরাপত্তা চেয়ে আগেই বিধাননগর এবং কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে তারা। তাতে এ দিন কাজ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থার একাংশ। এ দিন সকাল থেকেই সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে দেখা গিয়েছে বাড়তি বাহিনী। এমনকী, মদনকে যাতে কনভয়ের ঘেরাটোপে আদালতে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাও করা হয়। রাখা হয় বাড়তি গাড়িও। এ দিন সকালে সিজিও চত্বরে হাতে গোনা কয়েক জন মদন-অনুগামীকে চোখে পড়লেও বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা বেড়েছে।
একই ছবি দেখা গিয়েছে আলিপুর আদালত চত্বরেও। সকাল থেকেই মোতায়েন ছিল পর্যাপ্ত পুলিশ। দুপুরে সারদা-কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার সবচেয়ে হেভিওয়েট ব্যক্তিকে হাজির করার আগে গোটা চত্বর মুড়ে ফেলা হয় পুলিশি নিরাপত্তায়। বেলা ১২টা পর্যন্ত আদালত চত্বরের বাইরে তৃণমূল সমর্থক তথা মদন-অনুগামীদের ভিড় তেমন একটা ছিল না। পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে এর পর থেকেই। বেলা সাড়ে ১২টা থেকে পৌনে ১টার মধ্যে তিনটি মিছিল এসে পৌঁছয় আদালতের মূল গেটের বাইরে। প্রতিটি মিছিলে ৬০ থেকে ৭০ জন করে সমর্থক ছিলেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভিড়ের বহর।
গত শনিবার এই আদালতেই মদনকে হাজির করাতে চূড়ান্ত হিমশিম খেয়েছিল সিবিআই। লোকে লোকারণ্য সেই চত্বরে মদনকে গাড়ি থেকে নামানোর পাশাপাশি, নিজেদের হেফাজতে রাখার নির্দেশ পাওয়ার পরও আদালত থেকে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় সিবিআইকে। এর পরই তৎপর হয় কেন্দ্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থা। গোটা ঘটনা সবিস্তার জানানো হয় দিল্লির সদর দফতরে। জল্পনা ছড়ায়, প্রয়োজনে সিবিআই অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে সারদা-তদন্তের কর্মকাণ্ড।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy