গত বছর মুকুল রায়ের ওয়ার্ড অফিসে রাজা দত্ত। —ফাইল চিত্র।
রাজার কাছে যাওয়া সহজ।
ফেরা কঠিন।
কেন, সে উত্তর জানে হালিশহর। আরও বেশি করে জানে রাজ-অনুচরেরা। কারণ, রাজ-সঙ্গ ছাড়তে চাইলে শাস্তি অনিবার্য!
কী সেই শাস্তি?
যতই পেয়ারের লোক হোক না কেন, বেতালে বাজলে ‘খবর’ করে দেওয়া নাকি রাজা দত্তের বাঁ হাতের খেল! অর্থাৎ, তার কাছ থেকে মুক্ত হতে চাওয়া মানে একেবারে ‘মুক্তি’। বলছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজারই এক চ্যালা। সেখানে পুলিশেরও কিছু করার জো নেই।
‘রাজ-রোষ’ কাকে বলে, হালিশহরের বারেন্দ্র গলির সমাজপতি পরিবার তো টের পেয়েছে এই সে দিন। তার দেড় বছর আগেই রাজার রোষের পরিণতি টের পেয়েছিল তার অনুচরেরা। খুন হতে হয়েছিল রাজার ‘প্রিয়পাত্র’ বান্টিকে। এমনকী, এ বার ভোটের দিনও গুলি খেতে হয় রাজার আর এক অনুচর পাপন সাহাকে। বরাত জোরে পাপন বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু ফের হামলার ভয়ে এখন সে গোপন ডেরায়। কথা বলতেও কাঁপে।
কেন খুন হতে হয়েছিল বান্টিকে?
পুলিশ এবং রাজার কিছু চ্যালার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুকুর-ভরাট থেকে শুরু করে প্রোমোটারদের বাড়ি তৈরির বালি-সিমেন্ট সরবরাহ করা দিয়েই পুরসভার বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান রাজা দত্তের কাছে হাতেখড়ি বান্টির। আনুগত্যের কারণে রাজার ‘প্রিয়পাত্র’ হয়ে উঠতে সময় লাগেনি তার। বছর তিনেক এই কারবারে কাটিয়ে বান্টি বুঝতে পারে যে, নিজে কাজ করলে লাভ অনেক বেশি। কেবল ‘দাদা’র অনুগ্রহের উপর তাকে ভরসা করে থাকতে হবে না। ধীরে ধীরে সে নিজে আলাদা ভাবে কাজ করতে শুরু করে। প্রথমে ছিল জমির দালালি। তার পর পুকুর ভরাট। কিন্তু সে খবর রাজার কানে আসতে সময় লাগেনি। রাজ-রোষে পড়ে সে। তার পরেই চুপিসারে তাকে সরানোর ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়।
রাজার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের এক যুবক জানায়, বছর দেড়েক আগের এক রাতে বকুলতলায় রাজা দত্তের ‘সিংহাসন’ বাঁশের মাচায় দলের কয়েক জনের সঙ্গে বসে ছিল বান্টি। কাছাকাছিই ছিল রাজা। খুব কাছ থেকে গুলিতে বান্টি খুন হয়ে যায়। সেই সময় ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী মেলেনি বলে পুলিশ দাবি করে। বান্টি খুনে পুলিশ পাপন-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করে। পরে জামিন পায় পাপন। সেই মামলা এখনও চলছে। কিন্তু রাজার সঙ্গে বান্টির যতই ওঠাবসা থাক, পুলিশ কখনও রাজাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। পুলিশের যুক্তি, তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না। তদন্তেও তার নাম উঠে আসেনি।
এই দেড় বছরে পাপনও রাজার ‘প্রিয়পাত্র’ হয়ে উঠেছিল। তাকে পুরসভার কাজ দিয়ে ঠিকাদার বানানোর কারিগর রাজা। পাপনও গুরুদক্ষিণা কিছু কম দেয়নি। কিন্তু, ইদানীং সে-ও রাজার থেকে কিছুটা দুরত্ব বাড়িয়েছিল। তাতেই সে-ও রাজ-রোষে পড়ে বলে সূত্রের খবর।
গত সোমবার, ভোটের দুপুরে হালিশহর পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের দত্তপাড়ায় তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ের সামনেই বসে ছিল ওই দলের কর্মী পাপন। সঙ্গে দুই শাগরেদ। আচমকা পিছন থেকে পরপর দু’টি গুলি চলে। গুলি পাপনের পিঠে লাগে। জখম হয় বিশু নামে তার এক শাগরেদ। এক কাউন্সিলর দু’জনকে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এক দিন ভর্তি থাকার পর সে বাড়ি ফিরতে চাইলে চিকিৎসকরা অনুমতি দেননি। এক রকম জোর করে ঝুঁকি নিয়েই ‘বন্ড’ সই করে পাপন পালিয়ে যায়। সঙ্গে বিশুও। কিন্তু কেন?
গোপন ডেরা থেকে পাপনের উত্তর, ‘‘না এসে উপায় ছিল না। আর ক’দিন হাসপাতালে থাকতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু আমাকে কে মারার চেষ্টা করল, তা-ই তো জানি না!’’
পাপন কোনও নাম না তুললেও দলের কেউ কেউ বলছে, ‘দাদা’র নাম নিতেও সে কাঁপছে। ‘দাদা’র বহু গোপন কাজের সে সাক্ষী। সে বেলাইন হলে রাজার চিন্তা বাড়ে বইকি! অসীম, সুরজিৎ আর বলাই নামে যে তিন জনের কথা পাপন পুলিশকে জানিয়েছে, তারাও রাজারই অনুচর। তাদের কেউ এখনও ধরা পড়েনি। বিরোধীদের দাবি, পাপন খুন হলে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ মারা সহজ হত রাজাদের। ভোটের বাজারে ‘বিরোধীরা তাকে খুন করেছে’ বলা সহজ হতো। চলে আসত লাশের-রাজনীতিও। এই মামলাতেও পুলিশ এখনও রাজাকে জেরা করেনি। পাপনের উপর হামলার সময়েও রাজা দত্ত কাছাকাছিই ছিল বলে দাবি তার এক চ্যালার।
পুলিশ যে রাজাকে ঘাঁটাতে সাহস করে না, তার পিছনে রায় পরিবারের বাপ-ছেলের ‘হাত’ থাকার কথাই বলছেন অনেকে। রাজার দৌরাত্ম্য বাড়ছে জেনেও এলাকার বিধায়ক শুভ্রাংশু কেন লাগাম দেননি, এ প্রশ্নও উঠছে দলে।
এ দিন শুভ্রাংশুর ফোন বন্ধ ছিল। তাঁর প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তাঁর বাবা মুকুল রায়ের ফোন বেজে গিয়েছে। তিনি ধরেননি। বিরোধীদের অভিযোগ, ‘দামাল’ রাজার পায়ে বেড়ি পড়ালে, সে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারে, সেই ভয় রয়েছে রায় পরিবারের।
তবে, সমাজপতি পরিবারের মেয়ে দেবশ্রী এখনও বলছেন, ‘দাদার কীর্তি’র শেষ দেখে ছাড়বেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy