Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
R.D.Burman

R D Burman: মুম্বই থেকে পঞ্চম দুটো স্যুটকেস আনত, একটাতে নিয়ে যেত পটল-ঝিঙে-চিচিঙ্গে

রাহুল দেব বর্মন ফিরলেন, কিন্তু পঞ্চম তুই আর ফিরলি না! আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য কলম ধরলেন অভিজিৎ দাশগুপ্ত।

রাহুল দেব বর্মনকে নিয়ে অভিজিৎ দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণ।

রাহুল দেব বর্মনকে নিয়ে অভিজিৎ দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণ।

অভিজিৎ দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ১৯:৫৬
Share: Save:

সকাল থেকে ৩৬/১ সাউথ এন্ড পার্কের পঞ্চমের কলকাতার বাড়ির সামনে জটলা। জনা ত্রিশেক মানুষ। গেটের বাইরে আম গাছের সামনে ফুল রেখে যাচ্ছেন। তাঁদেরই কেউ গলা ছেড়ে গাইছেন 'শোলে' ছবির কিংবদন্তি গান ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে...’। এ ভাবেই সারা দিন ঘুরে ফিরে ভক্তদের রাহুল দেব বর্মন পুজো চলেছে। আমার পঞ্চমের। পঞ্চম, তুই নিশ্চয়ই সব দেখতে পাচ্ছিস? আর আমি ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’-র দিনগুলো দেখতে পাচ্ছি, জানিস?

মাঝে তোর খুব খারাপ সময় কেটেছিল। কাউকে পাশে পাসনি। একা একাই দুঃখ পেয়েছিস। তার পরেই তোর হাতে আসে বিধু বিনোদ চোপড়ার এই ছবির কাজ। আমিও তখন মুম্বইয়ে কাজের সূত্রে। এক দিন কাজ ফুরোতেই সটান তোর স্টুডিয়োয়। সে দিন কুমার শানুর গান রেকর্ডিং হচ্ছিল। রেকর্ডিং রুমের কাচের ঘর থেকে আমায় দেখেই এক ছুটে বাইরে তুই। বললি, "আজ প্যাক আপ। তুলুমা, চল তোর সঙ্গে আজ আড্ডা দেব।" অবাক হয়েছিলাম। বারণ-ও করেছিলাম তোকে। বলেছিলাম, "এ ভাবে কাজ ফেলে আসিস না।" বলেছিলি, "কাজ থাকবে। তুই তো রোজ থাকবি না! অনেক কথা জমে আছে রে তুলুমা।"

সে দিন অনেক দুঃখও করেছিলি। বলেছিলি, ‘‘দুঃখের দিনে কাউকে তো পেলাম না! চাকা আবার ঘুরতে চলেছে। রাহুল দেব বর্মন আবার ফিরবে।’’ ছবির গান অসম্ভব জনপ্রিয় হল। তুই কথা রাখলি। রাহুল দেব বর্মন ফিরলেন। কিন্তু পঞ্চম, তুই আর ফিরলি না! আজও সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে। তোর রাজার মতো চলে যাওয়া। আর প্রচুর গান রেখে যাওয়া। যার টানে আজও তোর জন্মদিনে তোর বাড়ির সামনে ভিড় জমান ভক্তরা।

পঞ্চম, তুই বরাবরই রাজার মতোই ছিলি। শচীন দেব বর্মন-মীরা দেব বর্মনের সন্তান। আমার আপন পিসুতুতো দিদির ছেলে তুই। জন্ম কলকাতায়। একটু বড় হওয়ার পর জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে মু্ম্বইয়ে। সরস্বতী পুজোর সময় তিন মাসের জন্য সস্ত্রীক আসতেন। তুই থাকতিস আমাদের কাছে। যৌথ পরিবারে। তোর সবচেয়ে আপনার ‘মণি দাদু’-র কাছে। আমার বাবা নির্মলকুমার দাশগুপ্ত ওরফে তোর ‘মণি দাদু’-ই কলকাতায় তোর লোকাল গার্জেন। আমি তোর মামা। যদিও নামেই মামা, আসলে আমরা বন্ধু। তবে আমি তোর যত না বন্ধু তার থেকেও তোর বেশি ভাব ছিল আমার বাবা-র সঙ্গে। তোর মনে আছে? নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তুই আর আশা গান গাইছিস, ‘মণিকা, ও মাই ডার্লিং’! হঠাৎ গানের ভাষা গেল বদলে। তুই গেয়ে উঠলি, ‘মণি দাদু, তুমি আমার ডার্লিং.... নীচে নেমে এসো... তোমার জন্য কফি রাখা আছে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা শুনে নেমে এসে পরে তোকে বকেছিলেন, কী করছিস এ সব পঞ্চম? তুই যথারীতি ঠোঁট উল্টে বললি, "ধুররর! কে কী ভাবল, বয়েই গেল।"

বরাবরই এ রকম দুষ্টুমি করতে ভালবাসতিস। কলকাতার রাস্তায় তখন গ্যাসের বাতি। তুই রোজ সেই বাতি জ্বালানোর নব ভেঙে দিতিস। রোজ বাতিওয়ালা মই লাগিয়ে উঠে অবাক হয়ে যেতেন। তার পর সেই নব লাগিয়ে আলো জ্বালিয়ে ফিরে যেতেন। পড়াশোনা একেবারে ভালবাসতিস না। কোনও একটা বিষয়ও তোর মনে দাগ কাটতে পারেনি। অথচ তুই দারুণ বুদ্ধিমান ছিলি। খেলাধুলোতেও তুখোড় ছিলি। সাঁতারে যদি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতিস, দেশ অনেক মেডেল পেত। শচীন কর্তার মতো ব্যাডমিন্টনও খেলতিস খুব ভাল। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল-- কোনওটাতেই কমতি ছিলি না।

শেষমেশ যদিও পড়াশোনা আর করলি না। ভাবলে হাসি পায়, নতুন ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় ফেল করেছিস। এ দিকে খেলাধুলোর জন্য এক গাদা পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফিরছিস! এমন ব্যতিক্রম বোধ হয় তোর পক্ষেই সম্ভব। তুই যখন তোর মা-বাবার কাছে মুম্বই চলে গেলি, বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। তুই যদিও ঘুরে ফিরে আসতিস। বছরে দু’তিন বার। আসতিস, সারাক্ষণ হইচই করতিস। আমাদেরও মাতিয়ে রাখতিস।

তোর কলকাতা আসা মানেই সঙ্গে ইয়া বড় দুটো স্যুটকেস। একটা তোর জামা-কাপড়ে ভর্তি। অন্যটা ফাঁকা। কেউ বয়ে বয়ে ফাঁকা স্যুটকেসও যে আনতে পারে, তোকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অবশ্য, তুই যখন ফিরতিস তখন আর সেটা ফাঁকা থাকত না। কলকাতা থেকে রাহুল দেব বর্মন অনেক কেনাকাটা সেরে স্যুটকেস বোঝাই করে ফিরতেন প্রতি বার।

কী থাকত তাতে? পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, চিচিঙ্গে। মু্ম্বইয়ের বাজারে নাকি এই সবজি খুঁজেই পেতিস না তুই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Singer Music Composer R.D.Burman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE