অমিতাভ বচ্চন তখন কলকাতাবাসী। চাকরি করেন। বাকি সময় বন্ধুদের সঙ্গে শহরে চক্কর কাটেন। সেই সময় নাকি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ধারে ভাঙের পাঁপড় বিক্রি হত! অমিত স্যর তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে সেটা খেতেন। একবার ভাঙের পাঁপড় খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে কী বিপত্তি! বেসামাল অবস্থায় পুলিশের হাতে আটক। ভাগ্যিস, শ্রীঘরে যেতে হয়নি।
সাল ২০১৮। সেই গল্প রসিয়ে রসিয়ে নিজমুখে আমায় শুনিয়েছিলেন ‘বিগ বি’।
তখন আমার দিন ফিরেছে। তিনটি চ্যানেলের তিনটি জনপ্রিয় ধারাবাহিকে অভিনয় করছি। ঝুলিতে কয়েকটি ছায়াছবিও। এমন সময় ডাক পাঠালেন পরিচালক প্রদীপ সরকার।
বাংলায় কাজের ফাঁকে মুম্বই গিয়ে দাদার সঙ্গে একাধিক বিজ্ঞাপনের ছবি করছি। তেমনই একটি কাজের কথা জানিয়ে ফোন করলেন ওঁর দলের একজন। একটি নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে জানতে চাইলেন, ওই তারিখে আমি ফাঁকা আছি কি না। ডায়েরির পাতা উল্টে দেখলাম, তার দু’দিন আগে বা দু’দিন পরে একটি তারিখ আছে। নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকে আমি ব্যস্ত। বললাম, তারিখটা কিছু এগিয়ে বা পিছিয়ে আনা যায়? তিনি বললেন, যাঁর সঙ্গে আপনি কাজ করবেন তাঁকে এ কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাতে পারব না আমরা।
আরও পড়ুন:
কথাটা হেঁয়ালির মতো শোনাল! কার বিপরীতে কাজ করছি যে, তাঁর দিন বদলানো যাবে না?
জানতে চাইলাম সে কথা। ওই ভদ্রলোক জানালেন, অমিতাভ বচ্চন! আমি চুপ। প্রথমে মনে হল, ভুল শুনেছি। তার পর সন্দেহ জাগল, তারিখ পাওয়ার অছিলায় এ সব বলে ভোলানোর চেষ্টা হচ্ছে না তো? সরাসরি প্রদীপদাকেই ফোন করলাম। দাদা ফোন তুলে প্রচ্ছন্ন অনুযোগ করলেন, “তুই এত বড় হয়ে গিয়েছিস, সময় দিতে পারছিস না!” পাল্টা জানতে চাইলাম, সত্যিই অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে শুটিং আমার? এবার প্রদীপদাও অবাক। বললেন, “তুই বিশ্বাস করিসনি?” বুঝলাম, যা শুনেছি ঠিক শুনেছি। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ওঁর জন্য গোটা মাস ছেড়ে দিতে রাজি।
প্রদীপদা হেসে ফেললেন। দুটো ছবির প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়ে গেল।
নির্দিষ্ট দিনে মুম্বই। আড়াই মিনিটের ছবি। মানে, অনেক ক্ষণ অমিতজির সঙ্গ পাব। এদিকে মুখোমুখি হওয়ার আগে পেট গুড়গুড়। না জানি কেমন আচরণ করবেন! কিছু ক্ষণ শুটিংয়ের পর বুঝলাম, উনি হচ্ছেন ‘সবার আমি ছাত্র’। প্রত্যেকের কথা শুনছেন। সেইমতো কাজ করার চেষ্টা করছেন। একবার সংলাপ বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপদাকে বললেন, “প্রদীপ, আর একবার যাব।” দাদা বোঝাচ্ছেন, তিনি অন্য অ্যাঙ্গেলেও শট নিয়েছেন। আর টেক দিতে হবে না। বচ্চন স্যর মানবেনই না! আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রদীপ, আমি তো হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। তখন সেলুলয়েডে শুটিং হত। হৃষীদা বলতেন, দরকারে একশো বার মহড়া দিয়ে নে। শটের সময় ভুল করবি না। ফিল্ম ফেলতে হলে তোদের থেকে পয়সা নেব। ওই অভ্যাস রয়ে গিয়েছে।”
বিজ্ঞাপনী ছবিতে অম্বরীশ ভট্টাচার্য ও অমিতাভ বচ্চন। ছবি: ফেসবুক।
আড্ডার সূত্রপাত ওখান থেকেই। এর পর কলকাতার কথা, নিজের টিকে থাকার কথা, বাংলা নাটক থেকে ওটিটি হয়ে ওঁর প্রযুক্তিপ্রীতি— কিচ্ছু বাদ দেননি!
কথায় কথায় বলেছিলেন, “টিকে থাকতে গেলে সমসাময়িক থাকতে হবে। আমি সারা ক্ষণ সেটাই চেষ্টা করি।” বলেই আমার হাতে ওঁর ফোন দিলেন। দেখালেন, সেখানে সমস্ত অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন, কেবল বিশ্বের খবর হাতের মুঠোয় ধরে রাখবেন বলে! তাঁর মতে, “সমসাময়িক আছি বলেই টিকে গেলাম! নইলে আমার সময়ের বাকি নায়কদের মতো আমাকেও এখন কোনও অন্ধকার বাংলোয় বসে অতীত আঁকড়ে একাকী বাঁচতে হত।” তার পরেই বাংলা ওটিটি-তে কেমন কাজ হচ্ছে, জানতে চাইলেন। দেখলাম, ছোটপর্দার প্রতি কী অসীম শ্রদ্ধা! “আমার দ্বিতীয় জন্ম তো টেলিভিশন দিয়েছে। রিয়্যালিটি শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ না করলে আমি তো ডুবে যেতাম”, অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর। অথচ টলিউডে বড় আর ছোটপর্দা নিয়ে এখনও ছুতমার্গ!