Advertisement
E-Paper

যৌনকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করে প্রতি বার নতুন উপলব্ধি হয়েছে, সমাজের দ্বিচারিতা দেখেছি

মনে আছে, বহু গলি সেই পাড়ার মধ্যে। বাড়িগুলি ছিল গায়ে গায়ে লাগানো। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উপরে উঠে একটা তলায় প্রায় ৫০টা সংসার। ঘরগুলোতে মাদুর পাতা। একটা কাঠের বেঞ্চে মাদুর পেতে আমাদের বসতে দিয়েছিলেন ওঁরা।

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২৫ ১৪:১৫
Actress Rituparna Sengupta said what she has learnt about prostitutes after working in several films

যৌনকর্মীর চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ছবি: সংগৃহীত।

যৌনকর্মীর চরিত্রে একাধিক ছবিতে কাজ করেছি। প্রথম কাজ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’। সে কথাই বলি আগে। সেই সময়ে যৌনকর্মীদের জীবনযাপন নিয়ে একেবারেই অবগত ছিলাম না। ওঁদের জীবনযাপন বোঝার জন্য যৌনপল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মনে আছে, বহু গলি সেই পাড়ার মধ্যে। বাড়িগুলি ছিল গায়ে গায়ে লাগানো। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উপরে উঠে একটা তলায় প্রায় ৫০টা সংসার। ঘরগুলোতে মাদুর পাতা। একটা কাঠের বেঞ্চে মাদুর পেতে আমাদের বসতে দিয়েছিলেন ওঁরা। ছোট্ট ঘরের মধ্যেও ওঁদের আন্তরিকতার শেষ ছিল না। খুব কষ্টের মধ্যেও ভাল থাকার রসদ খুঁজে নিতে জানেন ওঁরা।

যৌনকর্মীদের শিশুদের স্কুলের পরিবেশও দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যৌনকর্মীদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এ পুরুলিয়ার একটি যৌনপল্লী দেখানো হয়েছিল। গ্রামের যৌনপল্লী কেমন হয়, সেটা সম্পর্কেও একটা ধারণা তৈরি করতে বলা হয়েছিল।

এই ছবিটার নাম খুব অর্থবহ। সমাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওঁরা এখনও ‘মন্দ মেয়ে’ বলেই পরিচিতি পান। ওঁদের কারা মন্দ করল, সেটা কিন্তু আজও কেউ ভাবে না। আজ বিশ্ব যৌনকর্মী দিবসে এসে সেটাই মনে হয়। আজও কিন্তু এই ছুতমার্গ রয়ে গিয়েছে। রাতে এই যৌনকর্মীদের কাছে যাওয়ার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আবার সকালে তাঁদেরই ছি ছি করে সকলে। কী অদ্ভুত দ্বিচারিতা আমাদের সমাজের!

যুগের পর যুগ ধরে এই দ্বিচারিতা চলে আসছে। অথচ এই সমাজের জন্যই কিন্তু যৌনকর্মী হয়ে উঠতে হয়। তাঁরা তো স্বেচ্ছায় যৌনকর্মী হন না। নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাসে তাঁদের এই পরিণতি হয়। আবার যৌনকর্মী হয়ে উঠলে, সমাজ তাঁদের দিকেই আঙুল তোলে।

এই প্রতিকুলতার মাঝেও ভাল থাকতে জানেন ওঁরা। ‘রাজকাহিনী’-তে অভিনয় করার সময়ে অন্য রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই ছবির প্রেক্ষাপটে ইতিহাস ছিল। তবে সেই যুগেও কিন্তু যৌনকর্মীদের নিয়ে একই রকমের ছুতমার্গ ছিল। ওঁদের উপর মানুষ অধিকারবোধ দেখাবে। আবার নিজেদের সুবিধামতো দূরেও ঠেলে দেবে। এই দ্বিচারিতা প্রতি যুগেই ছিল, আছে।

আজকের দুনিয়ায় অর্থের বিনিময়ে কত অপরাধ, কত দুর্নীতি ঘটে যায়। যৌনকর্মীরা তো দেহের বিনিময়ে ন্যায্য পাওনাটুকুই নেন। তাঁরা তো চুরি, ডাকাতি বা খুন করছেন না। কাউকে ঠকাচ্ছেনও না। কোনও রাখঢাক না করেই তাঁরা রোজগার করছেন। মানুষ তো তাঁদের কাছে যাচ্ছে। তাই টাকা নিচ্ছেন। টাকা না পেলে তাঁদের জীবনধারণই বা হবে কী ভাবে?

আরও একটি বিষয় লক্ষ করেছি। অনেকেই ভেবে নেন, যৌনকর্মীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হতে তাঁদের সম্মতির প্রয়োজন নেই। তাঁরা যেন সহজলভ্য। সম্মতি না নিয়ে ওঁদের সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হওয়াকেও ধর্ষণ বা হেনস্থাই বলা হবে। যৌনকর্মীদের জন্য আমার অশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে। যৌনকর্মী হওয়া তো সহজ বিষয় নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র জীবনধারণ করার জন্য তাঁরা এই পেশা বেছে নিয়েছেন। তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। কেউ হয়তো দ্বিতীয় রাস্তা খুঁজে পেলে নতুন করে জীবন গুছিয়ে নেন। আর বাকিরা হয়তো পরজন্মের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। পরজন্মে গোছানো জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেন।

‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘রংবেরঙের কড়ি’ ছবিতেও যৌনকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করেছি। তরুণ মজুমদারের ‘জনপদবধূ’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু পরিচালক প্রয়াত হওয়ায় সেই কাজটি আর করা হল না। দেবদাসী প্রথার উপরে সেই ছবির গল্প ছিল। প্রতি বার যৌনকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে নতুন কিছু উপলব্ধি করেছি। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই প্রবল বেদনা। এই অনুভূতিগুলো আমার ভিতরে রয়ে গিয়েছে।

Rituparna Sengupta Rajkahini Sex Workers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy