Advertisement
E-Paper

তারকাদের ছবি দেখে ভুলবেন না, মহাকুম্ভ গরিবদের! ওখানকার প্রকৃত অবস্থা দেখলে খাওয়া ভুলবেন

“গঙ্গা এখানে সত্যিই ‘ভাগের মা’! প্লাস্টিক দিয়ে জলেও ভাগাভাগি। কিছুটা অংশ তারকাদের জন্য সংরক্ষিত। বাকিটা তথাকথিত দরিদ্রদের জন্য।”

সায়নী দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৫
মহাকুম্ভে অভিনেত্রী সায়নী দত্ত।

মহাকুম্ভে অভিনেত্রী সায়নী দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।

ছোট থেকে মহাদেবের ভক্ত। প্রায়ই স্বপ্নে দেখি আরাধ্য দেবতাকে। তাঁর টানেই কিনা জানি না, এ বছর প্রয়াগ গেলাম। মহাকুম্ভে যোগ দিয়ে মহাদেবকে স্মরণ করব বলে। সব কিছুই আচমকা ঠিক হয়েছে। আমার স্বামী কেবল জানতেন, আমি যাচ্ছি। মা-বাবাকেও বলে যেতে পারিনি। সঙ্গী আমার বান্ধবীরা। বাবা এর আগে কথায় কথায় বলেছিলেন, তীর্থ করতে গেলে যেন নিজের প্রভাব না খাটাই। বাকি অতি সাধারণদের মতোই যেন সেখানে পায়ে হেঁটে পৌঁছই। তবেই পুণ্যলাভ হবে। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছি। তার ফলে, প্রয়াগের কুম্ভমেলা দেখে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না...’।

মহাকুম্ভ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এই তীর্থ আদতে দরিদ্র মানুষদের সমাগমস্থল। এটাই আমাদের দেশের প্রকৃত অবস্থান। হলিউড-বলিউড-টলিউডের খ্যাতনামীরা জড়ো হয়েছেন প্রচারের স্রোতে গা ভাসাতে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসার স্বার্থে।

মহাকুম্ভে গঙ্গা আরতিতে ব্যস্ত সায়নী দত্ত।

মহাকুম্ভে গঙ্গা আরতিতে ব্যস্ত সায়নী দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।

সমাজমাধ্যমে তারকাদের ভাগ করে নেওয়া ছবি দেখে বলতেই পারেন, ওঁরা যে স্নান করেছেন পরিচ্ছন্ন জলে! সেখানে মলিনতা, কলুষতা, দারিদ্রের লেশমাত্র নেই! সাফ জানাচ্ছি, ওই ছবি দেখে ভুলবেন না। তারকাদের জন্য আলাদা ঘাট রয়েছে। তাঁরা সেখানে স্নান করেছেন। তাঁদের ঘাটের জল তাই পরিচ্ছন্ন, সত্যিই স্ফটিক-স্বচ্ছ। কারণ, গঙ্গা এখানে সত্যিই ‘ভাগের মা’! প্লাস্টিক দিয়ে জলেও ভাগাভাগি। নদীর কিছুটা অংশ তারকাদের জন্য সংরক্ষিত। এই তালিকায় রয়েছেন ‘হেভিওয়েট’ সাধুসন্তরাও। যাঁদের সঙ্গে ধনকুবের ব্যবসায়ী, রুপোলি পর্দার তারকারা ছবি তুলে সমাজমাধ্যমে ভাগ করে নিচ্ছেন। এঁরা আবার আসবেন শিবরাত্রির দিন।

সঙ্গমের বাকি ঘাট, সেখানকার জল যদি দেখেন, তা হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাবেন। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে! প্রচণ্ড অপরিচ্ছন্ন, যত্রতত্র নোংরা ভাসছে। সে সব ধুতে ধুতে শ্রীরামচন্দ্রের গঙ্গা সত্যিই ‘ময়লি’! জল কালো কুচকুচে। মহিলাদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই। ওঁরা প্রকাশ্যে ভিজে পোশাক ছাড়ছেন। সেই ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল। চড়া দামে বিকোচ্ছে। রাস্তায় থিকথিক করছে মানুষ। যাতে হারিয়ে না যান তাই মেয়েরা পরস্পরের ওড়নায় গিঁট বেঁধে নিয়েছেন! সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘোষণা, অমুক তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।

এঁদের ডিঙিয়ে হাঁটা মানে পর্বত ডিঙোনোর সমান।

মহাকুম্ভে তীর্থযাত্রীদের জন্য খাওয়ার বন্দোবস্ত।

মহাকুম্ভে তীর্থযাত্রীদের জন্য খাওয়ার বন্দোবস্ত। ছবি: সংগৃহীত।

১৭ ফেব্রুয়ারি বিমানে চেপে এলাহাবাদের প্রয়াগে পৌঁছাই। আমরা ঠিক করি, পায়ে হেঁটে পুণ্য করব। সেই মতো হোটেলে সব জিনিস রেখে, পোশাক পাল্টে পথে নামলাম। দেখি, দলে দলে নানা বয়সি নারী-পুরুষ হাঁটছেন। ওখানকার রামমন্দির থেকে সঙ্গমস্থলের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে সেই স্থান পর্যন্ত পথের দু’ধারে অজস্র লোকের অস্থায়ী আস্তানা। সকলে অবলীলায় পথেই শুয়েবসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আরও শুনবেন? বিমানের ভাড়া এতটাই বেশি যে, তা সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই হেঁটে হেঁটে, থেমে থেমে গন্তব্যে পৌঁছচ্ছেন সকলে পুণ্যলাভের আশায়। খালি পায়ে তাঁদের সঙ্গেই হাঁটতে শুরু করলাম।

এত অব্যবস্থার মধ্যেও একটি ব্যবস্থা ভীষণ ভাল, এখানকার খাওয়ার ব্যবস্থা। পথের দু’ধারে ঢালাও নিরামিষ খাবারের দোকান। সেখানে পেট ভরে খাবার মিলছে। প্রত্যেক দোকানের খাবার যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর। এই দোকানের পাশাপাশি দেশের ধনকুবের ব্যবসায়ীরাও খাবারের দোকান দিয়েছেন। তাঁদের নাম ঊহ্য থাক। এক ব্যবসায়ী এই ফাঁকে চুটিয়ে ব্যবসা সেরেছেন। অন্য এক ব্যবসায়ী বিনামূল্যে নারায়ণসেবা করে পুণ্যের ঝুলি ভরেছেন। তাঁর দোকানে খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে গরম গরম পুরি, তরকারি, পনির, আর প্রচুর রসমালাই জাতীয় মিষ্টির সমাহার। যত ইচ্ছে তত খান— কোনও বাধা নেই। ক্লান্তি এড়াতে এখানে তীর্থযাত্রীরা বসছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন, খাওয়াদাওয়া সেরে গঙ্গার ঘাটে যাচ্ছেন।

পুণ্যের আশায় মহাকুম্ভে জনসমাগম।

পুণ্যের আশায় মহাকুম্ভে জনসমাগম। ছবি: সংগৃহীত।

আমরাও এ ভাবে বিশ্রাম নিতে নিতে গন্তব্যে পৌঁছেছি। এক তরুণী বাঙালি বৈষ্ণবী যেচে ফুল দিয়ে গিয়েছেন, পুজোর জন্য। ওঁর মুখে বাংলা ভাষা শুনে যেমন অবাক, তেমনই তৃপ্ত। কোটি কোটি লোকের এই সঙ্গমস্থল এ ভাবে হৃদয়ের তাপে উষ্ণ। স্বজাতি-বিজাতীয়ের কোনও ভেদ নেই, বিরোধ নেই। শিখ, জৈন, বৈষ্ণব, শাক্ত হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়— এখানে এসেছেন পাপ নিবেদন করে কলুষমুক্ত হতে! যাঁরা এটা বুঝতে পারবেন, তাঁদের কাছে সত্যিই সেরা তীর্থ মহাকুম্ভ। নোংরায় কালো হয়ে ওঠা জল, দূষিত পরিবেশ তাঁদের কাবু করতে পারবে না। অতি সাধারণেরা তাই এখানে স্নান সেরে ভক্তিভরে দূষিত জল বোতলে পুরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।

আমি স্বাস্থ্যসচেতন। ওঁদের মতো ভক্তির আতিশয্যও নেই। তাই বাড়িতে কুম্ভের কলুষিত জল আনতে পারিনি। তবে একেবারে খালি হাতেও ফিরিনি। অনেক মানুষের ভালবাসা এই তীর্থ আমায় উপহার দিয়েছে। আমি তাতেই তৃপ্ত।

Sayani Datta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy