‘গওহর জান’-এর সঙ্গে স্বাগতা মুখোপাধ্যায়ের কি নিবিড় যোগ? কলকাতার মঞ্চে তিনিই একাধিক বার ‘নটী’র ভূমিকায়। শীতের শুরুতে যেমন তাঁর হাত ধরে ‘নটী’ ফিরছেন। মাঝে কয়েক দিনের বিরতি। ‘গওহর’কে আরও একবার দিল্লির মঞ্চে নিয়ে আসবেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়।
মঞ্চে ঘন ঘন গওহর জানের প্রত্যাবর্তন কতটা কাম্য? দর্শক আকর্ষণ হারাবেন না তো? আনন্দবাজার ডট কম প্রশ্ন করেছিল স্বাগতাকে। অভিনেত্রীর নাটক দেখা যাবে রবিবার, ৯ নভেম্বর। অভিনেত্রীর সপ্রতিভ জবাব এল, “তা কেন? কোনও একজনকে নিয়ে একাধিক কাজ মানে তাঁকে আরও বেশি করে জানা। আরও বেশি তিনি আমাদের মননে, চর্চায় থাকবেন। সব কিছু হয়তো আমার নাটকে দেখাতে পারব না। আবার অর্পিতাও সব দিক হয়তো ছুঁয়ে যেতে পারবেন না।” অভিনেত্রীর তাই অনুরোধ, “দর্শকেরা দুটো নাটকই দেখুন। দুটো নাটকে যা যা ভাল কিছু, সবটা আহরণ করুন। এতে নটী আরও অনেক কাল আমাদের মনে জীবিত থাকবেন।” একটু থেমে যোগ করেছেন, “এখনও অর্পিতার নাটক দেখা হয়নি। খুব ইচ্ছে, ওঁর ‘গওহর জান’কে দেখার।”
স্বাগতার গওহর জানকে নিয়ে চর্চা বা কাজ শুরু অনেক বছর আগে। অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ইপ্সিতা মুখোপাধ্যায় ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়িতে নটীকে প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন। স্বাগতার কথায়, “ওই নাটক দিয়ে আমার প্রথম ‘গওহর জান’ হওয়া। আমার নিজের নাটক দ্বিতীয় বার নটীর ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছে।” গত ১০ বছর ধরে তিনি নিজের নাটকে এই চরিত্রে বারেবারে মঞ্চে ফিরে এসেছেন।
অর্পিতা কি তা হলে স্বাগতার ‘গওহর জান’ দ্বারা অনুপ্রাণিত? “সেটা তো বলতে পারব না!”, অকপট স্বীকারোক্তি স্বাগতার। তবে না দেখলেও অর্পিতার গীতিনাট্যের কথা খুবই শুনেছেন। উভয়ের উপস্থাপনায় সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন, উভয়েই একক অভিনয় করেন।
স্বাগতা মুখোপাধ্যায় যখন মঞ্চের ‘গওহর জান’। ছবি: সংগৃহীত।
স্বাগতার কথায়, “ব্যাপারটা খুব কঠিন। মঞ্চে তানপুরার সুর, কিছু নেপথ্য আবহ আর একা আমি— এর বেশি কিচ্ছু নেই। পরিচালকের যুক্তি, বাহুল্যবর্জিত এক নারীর অন্তরকে দর্শকের সামনে পরিবেশন করতে গেলে এর বেশি আর কিছুই প্রয়োজন পড়ে না।” সেই অনুযায়ী অভিনেত্রী কখনও নটীর বাবা, কখনও মা, কখনও প্রেমিক, আবার তিনিই নটী। একই ভাবে নিজের কণ্ঠেই গওহর জানের সমস্ত গান পরিবেশন করেন। একমাত্র বিরতির সময় তিনি মঞ্চ ছাড়েন।
১০ বছর ধরে একজনকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনছেন। অর্থাৎ, স্বাগতা ‘গওহর জান’-এ অভ্যস্ত। তাকে তুলে ধরাও সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠেছে নিশ্চয়? “একেবারেই না”, দাবি তাঁর। অভিনেত্রী বরং ভীষণ ভয়ে থাকেন। নটীর কথা বলতে গিয়ে কোনও সন, তারিখ, ঘটনা বা তথ্য ভুল বলে ফেললে ইতিহাস বিকৃত হবে। ফলে, প্রতি বার তিনি নতুন করে ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠেন। সজাগ থাকেন প্রতি বার। যেন প্রথম অভিনয় করছেন। স্বাগতা জানিয়েছেন, এমন অনেক দর্শক আসেন, যাঁদের সাল, মাস, তারিখ-সহ সমস্ত তথ্য মুখস্থ। আবার এটাও ঠিক, গওহর জান ওঁর রক্তে মিশে গিয়েছেন।
নিজের অভিনয় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অনেক স্মৃতি ভিড় করেছে অভিনেত্রীর কথায়। যেমন, দেবশ্রী রায় ওঁকে নটীর ভূমিকায় দেখে মুগ্ধ। এ কথা আনন্দবাজার ডট কম-এর কাছে স্বীকার করেছেন দেবশ্রীও। বর্ষীয়ান অভিনেত্রী বলেছেন, “মাকে নিয়ে স্বাগতার অভিনয় দেখতে গিয়েছিলাম। এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হতে পারিনি। অনবদ্য লেগেছে ওঁর অভিনয়।” গান শিখতে গিয়ে ভারী মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বাগতার। “বাঈজি ঘরানার গায়কি বা কণ্ঠস্বর একদম আলাদা। আগের বার কয়েকটি গান তুলতে মসকুর আলি খানের কাছে গিয়েছিলাম। রন্তিদেববাবুর কাছেও গিয়েছিলাম গান তুলতে। তিনি গান তোলানোর আগে আমার গলায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে চেয়েছিলেন। পছন্দ হওয়ার পর গান তুলিয়েছেন!”
আরও পড়ুন:
নিজের কণ্ঠস্বর নিয়ে আক্ষেপ ছিল স্বাগতার। তাঁর কণ্ঠে লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলের গান মানায় না! বদলে বেগম আখতার, শুভা মুদ্গল বা ইলা অরুণ তুলনায় যেন বেশি মানানসই। গওহর জানের গান তুলতে গিয়ে অভিনেত্রীর উপলব্ধি, ভাগ্যিস তাঁর কণ্ঠ অন্যদের থেকে আলাদা। তাই তো এই ঘরানার গান তাঁর কণ্ঠে মানিয়েছেন। নটীকে আত্মস্থ করতে গিয়ে তাঁর জীবনযন্ত্রণা, এলোমেলো জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন অভিনেত্রী। আফসোস, “গওহর জান শুধুই ‘তওয়ায়েফ’ ছিলেন না। উনি আমাদের গানের দুনিয়া, বিনোদন দুনিয়াকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। আমরা তাঁকে প্রতিদানে কতটা সম্মান দিতে পেরেছি? কতটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি পরের প্রজন্মের কাছে?” তাই এই ধরনের গবেষণালব্ধ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন তিনি। এ ভাবেই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর চেষ্টা করেন স্বাগতা।