সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক কী রকম, সেটা স্বল্প পরিসরে ব্যখ্যা করা আমার পক্ষে কঠিন। ও তো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন শিল্পী। এক জন কল্পনার মানুষের সঙ্গে অন্য এক জন কল্পনার মানুষের দেখা হলে যা যা হতে পারে, আমাদের সম্পর্কটাও ঠিক সেই রকমের।
আরও পড়ুন:
মনে পড়ছে, বছর দশেক আগে সঙ্গীতশিল্পী শুভা মুদগলের ‘গাজা রাজা’ সঙ্গীত উৎসবে সব্যসাচীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মধুরিমা সিংহ। সব্যসাচীর সঙ্গে যে আমার নিয়মিত দেখা হয়, সে রকম নয়। তবে যখনই দেখা হয়, দু’জনের মধ্যে স্বপ্নের আদানপ্রদান হয়। তার মধ্যে কিছু বাস্তবায়িত হয়, আর কিছু ভবিষ্যতের জিম্মায় থেকে যায়।
এ বার যখন ওর ২৫ বছরর পূর্তি উপলক্ষে ফ্যাশন শোয়ের জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম, সেখানে ‘খর বায়ু বয় বেগে’ গানটা ব্যবহার করেছি। দেশাত্মবোধক গানের প্রতি সব্যসাচীর আলাদা রকমের শ্রদ্ধা রয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই ও আমাকে বলে যে গানটিকে ব্যবহার করতে চায়। ও চেয়েছিল বাংলা থেকে যেন আমাদের বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেন মানুষ বুঝতে পারেন, বাংলায় এখনও মানবিকতা, ভালবাসা এবং বিদ্রোহ রয়েছে।
তার পর যখন ফ্যাশন শোয়ে দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে থেকে গানটি বেজে উঠল, সাংঘাতিক মনে হয়েছিল। সব্যসাচী পরে আমাকে জানিয়েছিল যে শো দেখতে ওর আমেরিকান যে ভক্তরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁরা নাকি ভাষার ঊর্ধ্বে গিয়ে এটা যে বিদ্রোহের গান, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন।

রেকর্ডিংয়ে শিল্পীদের নির্দেশ দিচ্ছেন দেবজ্যোতি। ছবি: সংগৃহীত।
সব্যসাচীর কাছে রবীন্দ্রনাথ একটা ব্রহ্মাণ্ড। তাই আবহ তৈরি করার সময়ে আমার এক জনের কথাই মনে হয়— অনিন্দ্য নারায়ণ। তিনি আমাকে আরও পাঁচ জনের নাম প্রস্তাব করেন। ফলে দীপাঞ্জন পাল, অরূপ সরকার, শুভজিৎ চক্রবর্তী, সায়ন মিত্র, অজিষ্ণু চৌধুরীকে সঙ্গে পেলাম। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে এঁদের প্রত্যেকেরই স্পষ্ট উচ্চারণ। সেই মতো আমরা গানটা তৈরি করি। ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে আমরা কাজটা করি। কারণ এটা যে বিদ্রোহের গান, সেটা যেন সকলে বুঝতে পারেন, সে দিকে খেয়াল রেখেছিলাম।
সুরেলা কণ্ঠ হলেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায় না। আমি বিশ্বাস করি, সেখানে একটা গভীর বোধ, চেতনার প্রয়োজন। সুরকার রবীন্দ্রনাথকে আমি বাখ, বেঠোফেন এবং মোৎজ়ার্টের সঙ্গে একই সারিতে রাখি। সলিল চৌধুরীও বলতেন রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে আধুনিক। সেখানে সব্যসাচী যে ভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবতে পারে, সেটা কিন্তু অন্য কেউ করতে পারবে না। আর ও নতুন করে রবীন্দ্রনাথের গানকে দেখার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতেও আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করব।
এখানে আরও বেশ কিছু গান আমরা ব্যবহার করেছি। যেমন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘ও যে মানে না মানা’। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এক সময় যে বাংলা থেকে চেতনার আলো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, আমরা সেই জায়গাটাকে পুরো কাজটার মাধ্যমে ধরতে চেয়েছিলাম। পাশাপাশি প্রচুর ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুরও আমি ব্যবহার করেছিলাম। যে কোনও যাত্রা শুরু জন্য একটা শক্তির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ‘খর বায়ু’ সেই কাজটা করেছে।

সব্যসাচীর সঙ্গে আচোলনায় দেবজ্যোতি। ছবি: সংগৃহীত।
সব্যসাচী কিন্তু আমাকে দায়িত্ব দিয়েই বসে থাকেনি। কী কী গান, কী ভাবে কাজটা হচ্ছে— শুরু থেকে আমার সঙ্গে আলোচনা করত। ও সারা পৃথিবীর সঙ্গীত সম্পর্কে অবগত। ওর সঙ্গীতের জ্ঞান প্রশ্নাতীত। হয়তো কিছু একটা মাথার মধ্যে ঘুরছে। সঙ্গে সঙ্গে সেটা হোয়াট্সঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল। আর ও যেটা চাইছে, সেটাই করতে হবে।
সারা জীবনে আমি অনেক ধরনের কাজ করেছি। ঋতুপর্ণের (পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ) সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি। বাংলাদেশে কাজ করেছি। সব্যসাচীর বিজ্ঞাপনের জন্য আমি প্রায় আড়াইশো-তিনশো সুর তৈরি করেছি। কিন্তু এই বিশেষ কাজটিকে একটু অন্য ভাবে তৈরি করতে চেয়েছিলাম। যেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের ফিউশন তৈরি হবে। আগামী দিনেও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে জুটি হিসেবে আমরা দু’জনে কী ভাবে কাজ করতে পারি, কী ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে জ্যাজ়ের ব্যবহার করা যায়, সে সব নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। সব্যসাচীর ফ্যাশন শো শুধুই কোনও ‘ফ্যাশন শো’ নয়। তার ব্যাপ্তি আরও বড়। ওঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে নতুন করে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। সব্যসাচীর মতো এক জন বিশ্বমানের পরিপূর্ণ শিল্পীর সঙ্গে আগামী দিনে কাজের অপেক্ষায় রয়েছি।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)