Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Bengali Serial Strike

শিল্পী-প্রযোজক তীব্র চাপানউতোর, টলিপাড়ার উত্তাপ কমার লক্ষণ নেই

জনপ্রিয় ধারাবাহিকের লেখিকা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় মুখ খুললেন আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে। কী বললেন তিনি? এ দিকে জনপ্রিয় টেলি সিরিয়াল থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন খোদ মুখ্য চরিত্রই! তা-ই বা কেন?

শুটিং ফ্লোরের এই চেনা ছবি ক’দিন ধরেই বন্ধ টলিপাড়ায়।

শুটিং ফ্লোরের এই চেনা ছবি ক’দিন ধরেই বন্ধ টলিপাড়ায়।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ১৬:০৩
Share: Save:

থমকে আছে টলিপাড়া! দফায় দফায় মিটিং। হোয়াটসঅ্যাপের টেক্সট মেসেজ... ফেসবুক পোস্ট... টুইট, কোনও কিছুতেই কাজ শুরু করানো যায়নি। টলিপাড়ায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষের চাঁচাছোলা যুক্তি!
যেমন...

‘প্রোডিউসাররা আর্টিস্টদের মুখ বিক্রি করে নিজেরা মার্সিডিজ চড়ে বেড়ায়।’

‘এক নম্বর ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্ররা যথেষ্ট মোটা অঙ্ক পেয়ে থাকে। আর চরিত্রের জনপ্রিয়তার সুবাদে তাঁরা মাচা করে ফিতে কেটে প্রচুর টাকা পান।’

কালো আঁচড় লেগেছে এমন দুই পক্ষের, যারা সব সময়ে বিপদে একে অন্যের পাশে থেকেছে।
কেন এমন হল?

আরও পড়ুন: শুটিং এখনও বন্ধ, নতুন সিদ্ধান্ত নিল চ্যানেল

জনপ্রিয় ধারাবাহিকের লেখিকা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় মুখ খুললেন আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে। ‘‘অনেক দিন ধরেই একটু একটু করে ঝামেলা বাড়ছিল। জুলাইয়ের প্রথম থেকে টেকনিশিয়ানদের ৩০ শতাংশ হাইক দেওয়া হয়। তার পরেও বিভিন্ন গিল্ড থেকে দাবি আসে। পরিচালকদের তরফ থেকে বলা হয়, এক লাখ টাকা লাগবে, মেকআপ ম্যানরা বলেন, ৫০ হাজার টাকা লাগবে। আচমকা এই অর্থকরী দাবি প্রযোজকেরা কী করে দেবেন? চ্যানেল থেকে তো আমরা নির্দিষ্ট টাকা পাই!’’ প্রশ্ন তোলেন লীনা।

অন্য দিকে বেঙ্কটেশের অরবিন্দ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘যে আর্টিস্ট যে টাকায় ও যে সময়ে চুক্তিবদ্ধ সেই সময় তাঁকে মানতেই হবে। চুক্তিতে সই করে এখন হঠাৎ কেউ বলছেন, আমি এর চেয়ে বেশি সময় কাজ করলে টাকা চাইব। তা হতে পারে না! আর ধারাবাহিকের প্রসঙ্গে সিনেমা আসছে কেন? সিনেমায় কিন্তু আট ঘণ্টা শিফটের পরে কাজ হলে কেউ টাকা চায় না। কারণ সিনেমায় দিনের ভিত্তিতে সাধারণত আর্টিস্ট পেমেন্ট হয়।’’
আর্টিস্ট-টেকনিশিয়ান এক দিকে, আর এক দিকে প্রযোজক। ক্ষোভ বাড়ছে বই কমছে না।

লীনা আরও স্পষ্ট করে বিষয়গুলো বোঝাতে থাকেন, ‘‘এই যে বলা হচ্ছে, আর্টিস্টের মুখ বিক্রি করে প্রযোজকের ঘরে কোটি টাকা। এক জন লেখিকা হিসেবে আজ প্রশ্ন তুলছি, এই যে নতুন মুখদের এক একটা ব্র্যান্ড তৈরি করা, এটা চ্যানেল আর লেখক, প্রযোজক মিলেই তো করে। নতুন এসে তাঁরা দেখেন, তাঁদের মুখে মুড়ে গেছে শহর। পুজোর ফিতে কাটা থেকে মাচায় যে মোটা অঙ্কের অর্থ তাঁরা পান সেগুলোর প্রত্যেকটাই কিন্তু ধারাবাহিকের সেই চরিত্র হিসেবে।’’ উত্তেজিত লীনা আরও বলেন, ‘‘বিষয়টা টাকার নয়। সম্পর্কের রসায়নের। আজ হঠাৎ কনীনিকা চ্যানেলকে চিঠি পাঠিয়েছেন, তিনি ‘অন্দরমহল’ করবেন না। চ্যানেলকে তিনি বলেছেন, বন্ধ হোক ‘অন্দরমহল’। মানে ভাবুন, যে টেকনিশিয়ান, অভিনেতারা কাজ করছেন তাঁদের ভাত বন্ধ করতে চান তিনি! এই যে অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা পড়ে গেলাম, এগুলোর কী জবাব আছে আর্টিস্ট ফোরামের কাছে? ধারাবাহিক ঠিক করে চালাবার নিশ্চয়তা তাঁরা কি দিচ্ছেন?’’

আরও পড়ুন: শর্ত ছাড়াই আগে শুটিং শুরু হোক, চান প্রসেনজিৎ

এখন প্রযোজক-শিল্পীদের মধ্যে ধুন্ধুমার বাগ‌্‌যুদ্ধ। এক দিকে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়রা, কনীনিকা বম্দ্যোপাধ্যায়রা অন্য দিকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

যদিও কনীনিকা বলছেন, ‘‘অসুস্থতার কারণেই আমি টানা এত ক্ষণ ধরে আর কাজ করতে পারব না। সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত। আমি দু’মাস সময় দিয়েছি। আর ভাত মারার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে? কারণ, এই যে প্রযোজক ও আর্টিস্ট ফোরামের একটা সমস্যা এখন চলছে, আমি সেখানে সোচ্চার হয়ে বলেছি, কাজের ঘণ্টাটা বেঁধে দিলে সকলেরই সুবিধা হবে। সকলের কথাই আমি ভেবেছি।’’

লীনার প্রশ্ন ধরেই অভিনেতা ভরত কলের কাছে এই পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘এই সমস্যাগুলো আর্টিস্ট ফোরামকে জানাতে হবে। বাচ্চা না কাঁদলে মা বুঝবে কী করে তার খিদে পেয়েছে? তবে আজও কাজ বন্ধ! কেন প্রযোজকেরা চুক্তিপত্রে সই করে দশ ঘণ্টার শিফটকে মেনে নিচ্ছেন না? এখন তাঁরা বলছেন, চুক্তিপত্রের দাবি রক্ষা করা যাবে না!’’

উল্টো প্রশ্ন করেছেন আজকের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিকের লেখক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, ‘‘যে আর্টিস্টরা কল টাইমের চার ঘণ্টা বাদে ফ্লোরে আসেন? যে আর্টিস্ট কোনওমতে নিজের অভিনয়ের অংশটুকু আগে শুট করার জন্য মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মতো বর্ষীয়ান অভিনেত্রীকে বসিয়ে রেখে অসম্মান করে নিজের কাজ করে চলে যান? এপিসোড ডিরেক্টরদের বিরক্ত করেন? যে আর্টিস্টরা অনেক দেরি করে ফ্লোরে আসেন তাঁদের ওভারটাইম দিতে তো প্রযোজকরা ভয় পাচ্ছেন। ভাবছেন, ওভারটাইম পাওয়ার জন্য এর পর তাঁরা আরও দেরি করবেন!’’

আর্টিস্ট ফোরাম যদিও সাংবাদিক সম্মেলনে আগেই বলেছে, আড়াই হাজারের মধ্যে হয়তো পঞ্চাশ জন দেরি করে ফ্লোরে আসেন। এই সমস্যা তারা নিশ্চয়ই মেটাবে। যেমন সুদীপ্তা চক্রবর্তী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনি যদি কোথাও চাকরি করেন, তিন মাসের মাইনে না পান, আপনি সেটা নিয়ে প্রশ্ন করবেন না? আর সমস্যাটা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সোহম, রাহুল বা আমার নয়। আমরা ঠিকঠাক সময়েই টাকা পাই। আমরা এমন কিছু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি যাঁরা কাজ করে টাকা চাইতে গেলে তাঁদের কাজ থেকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়!’’ সুদীপ্তা বলছেন, ‘‘কিছু প্রযোজকের জন্য সমস্ত প্রযোজকে নাম খারাপ হচ্ছে। অন্য দিকে, কিছু শিল্পী পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ না করার জন্য গোটা শিল্পী মহলের নাম খারাপ হচ্ছে।’’

আরও পড়ুন: বন্ধ হয়ে যেতে পারে ধারাবাহিকের সম্প্রচার? ধর্মঘটে উঠছে প্রশ্ন

ব্যাঙ্কিং নেই প্রায় কোনও ধারাবাহিকেরই।

সমস্যা বেড়েই চলেছে। যেমন, ইদানীংকালের এক নম্বর ধারাবাহিকের নায়ক নাকি তাঁর প্রযোজকদের কাছে পঞ্চাশ দিনের ছুটি চেয়েছেন ছবি করবেন বলে। তাঁকে ফোন করা হলে তিনি মুখ খুলতে চাননি। বরং আনন্দবাজার ডিজিটালকে অনুরোধ করেছেন, প্রযোজককে অনুরোধ করেছেন এই প্রসঙ্গ না আনতে। তাঁর ছবির ডেট এমনিতেই পিছিয়ে গিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, প্রযোজকও এই পারস্পরিক চাপানউতোরের বাজারে সেই অভিনেতার অনুরোধ রেখেছেন। আসলে এই ইন্ডাস্ট্রির সকলের সঙ্গেই একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু সেখান থেকেই যখন টেকনিশিয়ানরা দাবি করেন, এক দিনে আউটডোর, ইন্ডোর হবে না। চাইলেই কাল আউটডোর হবে না। লেখক হিসেবে সব চরিত্রকে মর্যাদা দিয়ে টিআরপি-র গল্প বুনতে বড় অসুবিধে হয়’’, আফসোস লীনার।

‘ইষ্টিকুটুম’ ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্র যেমন হঠাৎ ভেবেছিলেন, তিনি বড্ড বেশি ওই চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তিনি দুম করে কাজ ছাড়েন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে এবং প্রযোজকদের তাঁকে ছাড়াই হাই টিআরপি বজায় রাখতে হয়।

এই অনিশ্চয়তা থেকেই গিয়েছে।

টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়েই আছে ধারাবাহিকের উপর। মুখে যে যা-ই বলুন, সকলে চান এ বার কাজ শুরু হোক।
ক্যামেরার আলো, শাটারের শব্দ, এক ভাঁড় চায়ে টলি পরিবারের আড্ডা...আর গরম নরম সংলাপ শুরু হোক।
বাঙালি-সন্ধের ড্রয়িংরুম যে বড্ড একা পড়ে যাচ্ছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE