Advertisement
E-Paper

গলির গায়ক আর গলির নন, মিথ্যে আলোয় রঙিন, প্রকৃত গায়ক নিশ্চুপ! বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে দেবজ্যোতি

“কেউ কেউ বলে, এটা ‘গানের গণতন্ত্রীকরণ’— সকলের অধিকার আছে সুরে মিশে যাওয়ার। অবশ্যই আছে। কিন্তু গণতন্ত্র যখন শৃঙ্খলাহীন, তখন সে একপ্রকার ভাঙন ডেকে আনে।”

দেবজ্যোতি মিশ্র

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ ০৯:৩০
গান নিয়ে দেবজ্যোতি মিশ্র, প্রয়াত রাশিদ খান, তবলিয়া তন্ময় বোস।

গান নিয়ে দেবজ্যোতি মিশ্র, প্রয়াত রাশিদ খান, তবলিয়া তন্ময় বোস। ছবি: সংগৃহীত।

আমার ছোটবেলায় গান ছিল একটা অদৃশ্য ঘর— জায়গাটা তেমন দেখা যেত না। কিন্তু তার ভিতর ঢুকতে গেলে নিঃশব্দে হাঁটতে হত। গুরুর পায়ের কাছে বসে, নির্দিষ্ট ভাবে শ্বাস নিতে শিখতে হত। দিনরাত রেওয়াজ করতে হত। কখনও কিছু শিখেও মনে হত, “এটা তো এখনও কিছুই নয়।”

এখন, কেউ একটা মেলোডি বানিয়ে দিল কম্পিউটারে, আর কেউ কপিরাইটের তোয়াক্কা না করেই তার উপর গলা বসিয়ে দিল। গান বানানো হয়ে গেল। শ্রোতা ‘ভিউ’ দেখল, ‘রিল’ বানাল। কিছু ক্ষণের জন্য তাকে মনে হল, সে সুরের মালিক।

এই যুগে গান শেখার ধৈর্য হারিয়ে গিয়েছে...

আমার পরিচিত এক কীর্তন গায়িকা, যিনি শিখছেন ৩০ বছর ধরে, এখন একা বসে রেওয়াজ করেন— জানেন, কেউ শুনছে না। তিনি বলেন, “আমি জানি। আমি তবুও শিখি, কারণ এটাই আমার প্রার্থনা।” তাঁর নাম কেউ জানে না। তাঁর ভিডিয়ো ভাইরাল হয় না। তিনি শুদ্ধ সুরে গাইলে মানুষের মোবাইল স্ক্রল থামে না। আমি তাঁর গান শুনছি। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে জল বয়ে যাচ্ছে। ভাবছি, কী করে ওঁর গান সকলের সামনে নিয়ে আসা যায়। আর উনি ভাবছেন, ওঁর একটা ইউটিউব চ্যানেল করতে হবে! তাঁর একটা ইউটিউব চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে। এই যে কোমলহৃদয়ের মানুষের মনে ‘ক্রাইসিস’ তৈরি হয়েছে, ভয় ঢুকেছে, বিশ্ব সঙ্গীত দিবসেই হয়তো তাঁদের মনে হচ্ছে, ‘আমার গান কি কেউ শুনবে? আমার গান কি কখনও বিশ্বের কাছে পৌঁছোবে না?’ অন্য দিকে, হয়তো তাঁরই গাওয়া একটি গান একজন বেসুরো নিজের ইউটিউব চ্যানেলে গেয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছেন! সেই গানের মধ্যে অনেক কিছু এসে জড়ো হচ্ছে।

আমি বলব না, গানের বিবর্তন হবে না। অবশ্যই গানের বিবর্তন ঘটবে। আমি যে ভাবে কাজ করি সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে পোশাকশিল্পী সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ কথা হচ্ছিল। আলোচনা করতে করতে দেখলাম, আমাদের মত মিলে গেল। উভয়ের একটাই চিন্তা, বহু মানুষকে কী করে এক জায়গায় আনা যায়। কোনও ব্যক্তিবিশেষকে নয়। এই জায়গা থেকে কয়্যারের কথা উঠে আসে। কয়্যারে হয়তো প্রত্যেকের মুখ দেখা যেত না। কিন্তু সকলের মিলিত কণ্ঠ একটা অদ্ভুত সুর বা আবহ তৈরি করত। সেই জায়গাগুলো কী করে আবার ফিরিয়ে আনা যায়?

এখন আধুনিক প্রযুক্তি, বাদ্যযন্ত্রের কল্যাণে গলা যেমনই হোক, গান এত সুরেলা! ইদানীং পশ্চিমে আবার বেসুরো গানের চল হয়েছে। ওরা বুঝেছে, এত সুরেলা, যান্ত্রিক গান শ্রোতা চাইছে না! একটু ত্রুটি না থাকলে গান তাদের কান ছুঁয়ে যাচ্ছে না। আমি নাম করে বলছি, বেলে এলিস, অ্যাডলের গান কিন্তু ত্রুটিযুক্ত করা হচ্ছে।

কেউ কেউ বলে, এটা হল ‘গানের গণতন্ত্রীকরণ’— কেউ চাইলে গাইতেই পারে। সকলের অধিকার আছে সুরে মিশে যাওয়ার। অবশ্যই আছে। আমি সেটা মানি। কিন্তু গণতন্ত্র যখন শৃঙ্খলাহীন হয়, তখন সে একপ্রকার ভাঙন ডেকে আনে।

এখন একটা জায়গায় গান নেই— আছে গান দেখানো। সুর নেই— আছে সাউন্ড এফেক্ট। গলির গায়ক এখন আর গলির নয়! সে একটা মিথ্যে আলোয় সেজে আছে। আর যে গায়ক আসলে গাইতে জানে, সে ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যাচ্ছে।

সুরে সুরে দেবজ্যোতি মিশ্র।

সুরে সুরে দেবজ্যোতি মিশ্র। ছবি: সংগৃহীত।

এই চুপ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই আজকাল সত্যি গান খুঁজে পাই। হয়তো শুনে ফেলি এক বয়স্ক মহিলাকে, ভোরবেলা নিজের মতো করে ঠুমরি গাইছেন। ফোনে রেকর্ড করা নেই, ক্যামেরাও নেই, কিন্তু শব্দে একটা অতীত কাঁপছে। তাতে কোনও ‘রিল’ নেই— আছে প্রেম, ব্যথা আর উজ্জ্বল আনন্দ।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটা ঘটনা। কিছু দিন আগে বননবগ্রামে বাংলা নাটক ডট কমের গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু বাউল শিল্পীকে দেখলাম, শুনলাম। যাঁরা গান গেয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা পৃথিবীর প্রান্তরেও পৌঁছোচ্ছেন। কিন্তু দেখে তাঁদের বোঝার উপায় নেই। হয়তো তাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ্যালে গেয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁদের দেখে বুঝতে পারা যায় না সেটা। তাঁদের বিনয়, বিনম্রতা এগুলোই চোখে পড়বে। তাঁরাও কিন্তু গাইছেন, তাঁরাও শিল্পী।

এ ভাবেই আরও একটা বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের আগমন। বিশ্ব সঙ্গীতের দুনিয়ায় বাংলা গান এখন কতটা সমাদৃত?

২০২৫-এ দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। এখনও গানের জন্য সত্যিই যদি একটা দিন ধার্য হয়ে থাকে, তা হলে সে দিকে তাকিয়ে সকলের আগে মনে হবে সারা পৃথিবীর মানুষ কেমন আছেন? এই যে যুদ্ধ, ধ্বংস— একটা বীভৎস অবস্থার মধ্যে যেন রয়েছি। ভয় পাচ্ছে মানুষ, বিশ্বাস হারাচ্ছে মানুষ, আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। সঙ্গীতের মতো আগলে রাখার ক্ষমতা, অতি যন্ত্রণায় জড়িয়ে রাখার ক্ষমতা কিন্তু দ্বিতীয় আর কিছুতেই নেই। আদরে, ভালবাসায় রাখতে পারে, স্নিগ্ধতায় রাখতে পারে। এই যে চারিদিকে পুড়ে যাওয়া ক্ষতগুলো, এর মধ্যেও সঙ্গীত যদি স্বকীয়তায় জেগে থাকতে পারে তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে? সেটা পৃথিবীর যে প্রান্তে হোক বা আমাদের বাংলায় হোক। আমরা তো সবই দেখতে পাচ্ছি। সারা পৃথিবীর তুলনায় বাংলা ভাল আছে, এমন কথা বলার জায়গায় তো আমরা নেই। বাংলায় যা ঘটছে, যা ঘটে যাচ্ছে— সেখানে দাঁড়িয়ে বিশ্ব সঙ্গীতের একটা দিন। আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। যদিও প্রতিটি দিন সঙ্গীতের জন্য উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। সেটা যদি না-ও হয় তা হলেও বলব, একটা দিনও যদি সঙ্গীতের জন্য ধার্য করা হয়ে থাকে তা হলেই বা কম কী?

একটা দিন সকলে মিলে গাইবেন, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে— আমার কাছে অনেকটা পাওয়া। একটা দিন তাঁরা ভাল থাকবেন, সকলের পক্ষেই এটা খুব ভাল কথা।

গানই পারে সমস্ত শ্রেণিকে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিতে। গানের অপরিহার্য অঙ্গ হারমোনিয়াম। পাশ্চাত্য থেকে যখন এ দেশে, এই বাংলায় বাদ্যযন্ত্রটি এল চাষির ঘর থেকে বড়ে গোলাম আলি খাঁর তাঁর অনায়াস বিচরণ! গিটার যেমন একটা বিপ্লবী যন্ত্র। গিটারও পাশ্চাত্যের চাষির ঘর থেকে পল ম্যাকার্টনির ঘরে রাজত্ব করে। ওই চাষিও গিটার বাজিয়ে ইচ্ছেমতো সুর তোলেন। ৮৩ বছরের পল ম্যাকার্টনিও। আবার আমাদের দেশের একটি ছেলেও গিটার বাজিয়ে গায়! কী চমৎকার ব্যাপার, না?

কয়্যারের গান ‘মিস’ করেন দেবজ্যোতি মিশ্র।

কয়্যারের গান ‘মিস’ করেন দেবজ্যোতি মিশ্র। ছবি: সংগৃহীত।

হারমোনিয়ামের দিনের গানগুলো আমার কানে এখনও কী চমৎকার বাজে! এবং সেই গানগুলোর নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরা কী অসম্ভব ভাল গান তৈরি করেছেন, তাঁরা কত আনন্দ করে, ভালবেসে, চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে গানগুলো বেঁধেছেন, গেয়েছেন— বিশ্ব সঙ্গীত দিবস বললে পরে আমার কাছে সেই সমস্ত মুহূর্তগুলো ফিরে ফিরে আসে। সেই সমস্ত মুহূর্তগুলো কি আবার জড়ো হতে পারে? এই ‘আবার জড়ো হতে পারে’— কথাটা বলছি কেন? কারণ, আমাদের গানের মধ্যে কী কী ঢুকে গিয়েছে এখন? এখন সারা ক্ষণ ‘আমার গানটা শুনুন’, ‘আমার গানটা দেখুন’-এর মতো কথাগুলো চলে এসেছে। এই যে এত ‘দেখুন দেখুন’, ‘শুনুন শুনুন’ কথাটা এসেছে— সেটা এবং সমাজমাধ্যমে যে ভাবে আমাদের যুগে চলে আসবে সে ভাবে চলে এসে আমাদের কী করে দিয়েছে? আমাদের সমস্ত মানুষের হৃদয়ে গান আছে। সেই গানটা গলায় এসে জড়োও হয়। কিন্তু গলায় জড়ো হওয়ার পরে উচ্চারণ যদি চারিধারে নানা ভাবে হতে থাকে তা হলে গানের গুরুত্ব কমে যেতে থাকবে।

এইটা আমার বারে বারে মনে হয়। এইটা আমার সংশয়। নিজেরই বিরক্ত লাগতে থাকে, যে এত গানের মধ্যে আদতে একটা গান কি হারিয়ে যাবে?

Debojyoti Mishra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy