Advertisement
E-Paper

ছবিতে দেখানো স্কুল বন্ধের বিষয়টি রাজ্য সরকার বোধ হয় ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেনি: সৌরভ

“আমি কিন্তু বিদেশে ছবি পাঠাব বলে ছবি বানাইনি। ফলে, ছবিতে দারিদ্রকে হাতিয়ার বানাব তেমন ভাবনাও ছিল না।”

উপালি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৫ ০৯:২৪
সৌরভ পালোধির কি অঙ্কে ভয়?

সৌরভ পালোধির কি অঙ্কে ভয়? ছবি: সংগৃহীত।

হঠাৎ জীবনের অঙ্ক কষার বিষম তাগিদ! তাও আবার রুপোলি পর্দায়, উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত সৌরভ পালোধির ‘অঙ্ক কী কঠিন’ ছবিটি। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেই ছবিই ব্রাত্য! কেন? ২৩ মে নিজের শহরে মুক্তি পাচ্ছে সেই ছবি। দর্শক কি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছড়িয়ে দেবে পরিচালকের দেখা স্বপ্ন? সমাজ বদলাবে? ছবিমুক্তির আগে আনন্দবাজার ডট কমের কাছে অকপট সৌরভ।

প্রশ্ন: সৌরভ পালোধি কি অঙ্কে ভয় পান?

সৌরভ: (হেসে ফেলে) এই একটি বিষয়েই আমি বরাবর বেশি নম্বর পেয়েছি। তাই কমার্স নিয়ে পড়েছি।

প্রশ্ন: পড়শি দেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের আবহে মুক্তি পাচ্ছে ‘অঙ্ক কী কঠিন’, অঙ্ক কষে পটভূমিকা তৈরি?

সৌরভ: খুব সরল ভাবে বললে বলব, আমার ছবির ‘অঙ্ক’ মোটেই যুদ্ধের কথা বলে না। বরং, সকলে মিলে বাঁচার কথা বলে। ছোটদের জন্য সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ে তোলার কথা বলে। আমরা যতই যুদ্ধ বা সংঘর্ষের আবহে থাকি না কেন, মনে মনে সকলেই জানি, যে যুদ্ধে যায় সে যুদ্ধ চায় না। আর যে যুদ্ধ চায় সে যুদ্ধে যায় না। মনে রাখবেন, ‘যুদ্ধ না চাওয়া’ মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের নিয়েই এই গল্প। এরা শুধুই ভালবাসা চায়। সম্প্রীতির এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে। আমিও সেটা দেখি। সেই স্বপ্নই দর্শকদের দেখাব।

প্রশ্ন: জীবনের অঙ্ক পর্দায় দেখানো দরকার, কখন বুঝলেন?

সৌরভ: তখন করোনাকাল। আমরা দল বেঁধে ত্রাণ নিয়ে নানা জায়গায় যাচ্ছি। সেই সময় দেখেছিলাম, স্কুলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ছোটদের কাছে আমাদের যে প্রাথমিক প্রশ্ন, বড় হয়ে কী হতে চাও— সেটাই তো নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে! কারণ, করোনার দাপটে একাধিক অবৈতনিক স্কুল, প্রাথমিক স্কুলের গেটে তালা ঝুলছে। অর্থাৎ, স্বপ্নের কারখানাগুলো বন্ধ। রাজ্যের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু কিন্তু প্রথম সারির বেসরকারি স্কুলে পড়তে পারে না। তাদের মা-বাবার সেখানে পড়ানোর ক্ষমতা নেই। তাঁরা পাঠান এই সব স্কুলে, যেখানে বিনামূল্যে মিড-ডে মিল দেয়। সে সব যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন মা-বাবারা শিশুদের স্কুলে পাঠানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তার মধ্যেও পাড়ার কাউকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখে যদি কোনও শিশু স্বপ্ন দেখে, সে চিকিৎসক হবে, হাসপাতাল গড়বে— সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কী করে? তারই সমাধান খুঁজবে আমার ছবি।

গীতশ্রী চক্রবর্তী, ঋদ্ধিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, তপোময় দেব।

গীতশ্রী চক্রবর্তী, ঋদ্ধিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, তপোময় দেব। ছবি: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রশ্ন: এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবির জন্য তারকা-অভিনেতা পার্নো মিত্রকে বাছলেন। বাকি কোনও জনপ্রিয় অভিনেতা নেই। এতে বাণিজ্যের ‘অঙ্ক’ মিলবে?

সৌরভ: আমায় এই অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে পারবেন, অনেক ছবিতে হিট অভিনেতাদের নিয়েও সে সব ছবি কেন ব্যর্থ? সত্যিই এই অঙ্ক মেলে না। মেলানো সম্ভব হয় না। যেমন, ‘লাপতা লেডিজ়’। সকলের পছন্দের ছবি। কিন্তু অভিনেতাদের নাম জিজ্ঞেস করুন। গুগ্‌ল না করে অধিকাংশই বলতে পারবেন না। অথচ ছবি সফল। এ রকম আরও উদাহরণ আছে। বলতে পারেন, আমার ছবির ক্ষেত্রেও এই অঙ্ক কষেছি। মন থেকে বিশ্বাস করি, ছবির বিষয়, অভিনেতা ভাল হলে সেই ছবি ভাল ব্যবসা করবে। আমি প্রজেক্ট বানাই না, ছবি বানাই। এই কারণে হাতে কাজ কম। তবু ছবিই বানাতে চাই। তার জন্য যাঁকে দরকার তাঁকে নেব। দর্শক কিন্তু ভাল কাজ দেখেন।

প্রশ্ন: পার্নোই বা কেন?

সৌরভ: গল্প লেখার সময় থেকে কেন জানি না, কেবল পার্নোর কথাই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, ও পারবে আমার ছবির চরিত্র হয়ে উঠতে। ছবির নায়ক প্রসূন কিন্তু মঞ্চাভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়। তাই বিপরীতে এমন কাউকে নিতে হবে, যাঁর পরিচিতি আছে, আবার শক্তিশালী অভিনেত্রীও। পার্নোকেও বলে নিয়েছিলাম, বিপরীতে কিন্তু তথাকথিত নায়ক নন! কিন্তু খুব ভাল অভিনেতা। পার্নো এক কথায় রাজি। দু’জনের যাতে কাজ করতে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য লম্বা মহড়া দিয়েছিলাম। বাকিটা পর্দায় দেখতে পাবেন।

প্রশ্ন: শিশুশিল্পীদেরও মহড়া দেওয়াতে হয়েছে?

সৌরভ: অবশ্যই। শিশুরা দেখবেন, সুর করে কথা বলতে অভ্যস্ত। এই অভ্যাস ছবির পক্ষে ভাল নয়। সেটা কাটাতে হয়েছে। আবার শিশুরা ভীষণ তীক্ষ্ণবুদ্ধির। জটিলতা কম বলে দ্রুত সব কিছু শিখে যায়। ফলে, ওদের নিয়ে কাজ করেও আরাম। ওরা গল্পের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।

প্রশ্ন: প্রযোজক রানা সরকারও আপনার বিশ্বাসেই বিশ্বাসী?

সৌরভ: এটা আমায় অনেকটা সহযোগিতা করেছে। রানাদা আমায় বিশ্বাস না করলে ছবিটাই হয়তো হত না। প্রথম দিন গল্প শুনেই দাদা বলেছিলেন, ‘‘সৌরভ, যা-ই হয়ে যাক, আমরা এই ছবিটা বানাচ্ছি। এটা বানানো খুবই জরুরি।’’ প্রযোজকের এই ভরসা পরিচালককে কতটা এগিয়ে দেয় সেটা কেবল তিনিই জানেন। জানি, কিছু লোকের ভাল লাগবে, সকলের ভাল লাগবে না। তার পরেও বানিয়েছি। রানাদাও কোনও আপত্তি করেননি। ছবি দেখার পর রানাদা কোনও কাটছাঁট করাননি। বলেছিলেন, ‘‘চল, এ বার ছবিটাকে মুক্তি দিই।’’

প্রশ্ন: বস্তি অঞ্চলে শুটিং করেছেন? খুব সমস্যা হয়েছে?

সৌরভ: লাগাতার বৃষ্টি ছাড়া আমাদের আর কোনও সমস্যা হয়নি। তার জন্য তিন বার আমার ছবির শুটিং বন্ধ রাখতে হয়েছে। মানুষের থেকে প্রচণ্ড সহযোগিতা পেয়েছি। রাজারহাট-নিউ টাউন অঞ্চলের বস্তিতে গিয়ে শট নিয়েছি। ছবির দৃশ্য জীবন্ত করব বলে। সর্বত্র খুবই ভাল অভিজ্ঞতা। অনায়াসে কাজ হয়ে গিয়েছে। আগাম প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছিলাম বলে খুব দ্রুত শুটিং হয়ে গিয়েছে।

প্রশ্ন: অনেকে ছবির বিষয় শুনে বলছেন, ‘অঙ্ক কী কঠিন’ নাকি বামপন্থী সৌরভের এজেন্ডা?

সৌরভ: হ্যাঁ, আমার এই ছবি অবশ্যই রাজনৈতিক। ফাঁকা, পড়ে থাকা বাড়িতে বাচ্চারা যদি ভাবে হাসপাতাল গড়বে, সেটা যদি বামপন্থীমনস্কতার পরিচয় হয় তা হলে তাই-ই। আমি গর্ববোধ করছি, আমি সঠিক রাজনীতির সমর্থক।

প্রশ্ন: বরাবরের ধারণা, সত্যজিৎ রায়ের আমল থেকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতীয় দারিদ্র খুব ভাল বিক্রি হয়। আপনার ছবিও বিদেশে সমাদৃত...

সৌরভ: (একটু থেমে) আমি কিন্তু বিদেশে পাঠাব বলে ছবি বানাইনি। ফলে, ছবিতে দারিদ্রকে হাতিয়ার বানাব তেমন ভাবনাও ছিল না। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিন। প্রত্যেকের নিজের কাজের প্রতি দুর্বলতা থাকে। আমারও রয়েছে। কিন্তু রানাদা-সহ বাকিরা? তাঁরা কিন্তু ছবি দেখেই বলেছিল, ‘অঙ্ক কী কঠিন’ বিদেশে পাঠানোর মতোই। তখন বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সর্বত্র ছবি প্রশংসিত হওয়ার পরে, অবাঙালি দর্শক ছবির শেষে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন— চোখে জল এনে দিয়েছে।

প্রশ্ন: ছবি করতে করতে নিশ্চয়ই অতীত ফিরে দেখেছেন? সৌরভের জীবনের অঙ্ক কেমন?

সৌরভ: আমি ভাগ্যবান। আমার ছেলেবেলা অভাব-অভিযোগে এত কঠিন ছিল না। খাওয়া-পরা নিয়ে ভাবতে হয়নি। কিন্তু আমার জীবনে হই-হট্টগোল, পাড়ার প্রভাব আজও ভীষণ বর্তমান। এখনও পাড়ায় আড্ডা দিয়ে তার পর বাড়িতে ঢুকি। এ গুলোই আমার ছবির শিশুদের জীবনে আনতে চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন: সৌরভ বামপন্থী। গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তী বামপন্থা ছেড়ে তৃণমূলপন্থী। তিনি আপনার ছবিতে গাইলেন!

সৌরভ: (হেসে ফেলে) এই অঙ্কটা না আমিও মেলাতে পারিনি। ছোট থেকে আমি আর আমার মা পাগলের মতো নচিদার ভক্ত। বাবাকে লুকিয়ে আমরা দাদার গান শুনতে যেতাম। আমার মাকে ‘মা’ বলতেন তিনি। সেই নচিদাকে এখন দেখা হলেই বলি, নচিদা বদলে গিয়েছ। এই নচিদার শো দেখতে যাই না। আমার খুব কষ্ট হয়। কেউ একজন নির্দেশ দেবেন, ‘‘নচি গাও’’। তখন দাদা তাঁর পছন্দমাফিক গাইবেন, এই দৃশ্যটা নিতে পারি না। শিল্পী ঠিক করবেন, কখন তিনি গাইবেন, কী গাইবেন। বিপরীতে থাকা মানুষটি বা মানুষগুলোকে সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে হবে বলে আমি মনে করি। যে নচিদা সংগ্রামের কথা বলতেন সেই নচিদা এখন যে যে মঞ্চে যা যা গান— মেনে নিতে কষ্ট হয়। তার পরেও বলব, ওঁর সঙ্গে কাজে কোনও আপত্তি নেই। তার পরেও বলব, আমার ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ হারিয়ে গিয়েছে। ছবির প্রচারে এসে নচিদা সেই কথা বলেছেন, ‘‘সৌরভ বলে, আমি নাকি বদলে গিয়েছি। আমি একটুও বদলাইনি।’’

প্রশ্ন: আপনার ছবি সমাজকে বদলাতে পারবে?

সৌরভ: কখনওই না। কোনও ছবি বা নাটক সমাজ বদলাতে পারে না। রাজনীতিকরা সমাজ বদলাতে পারেন। সেটা উৎপল দত্তের সময়েও ছিল। রাজনীতিমনস্কদের পাশে তিনি এবং তাঁর মতো শিল্পীরা পাশে ছিলেন বলে মনে হয়, বুঝি শিল্প-সংস্কৃতি সমাজবদলের ডাক দিল। আদতে তা না। সমাজ বদলাতে পারে ইভিএম।

 ‘অঙ্ক কী কঠিন’ ছবিতে পার্নো মিত্র, প্রসূন।

‘অঙ্ক কী কঠিন’ ছবিতে পার্নো মিত্র, প্রসূন। ছবি: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রশ্ন: অনেক ভাল ছবি নামী ব্যক্তিত্ব নিবেদন করেন। সরকারের কাছে করমুক্তির আবেদন জানানো হয়। তেমন কিছু ভাবনায় আছে?

সৌরভ: এতগুলো আন্তর্জাতিক স্তরে ছবি প্রশংসিত হল। অথচ, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অঙ্ক কী কঠিন’ দেখানো হল না! মনে হয় রাজ্য সরকার ছবিতে দেখানো স্কুল বন্ধের বিষয়টি ভাল ভাবে নিতে পারেনি। আর আমার ছবির নিবেদক সাধারণ দর্শক। ছবি ভাল হলে ওঁরা দায়িত্ব নিয়ে ছবিকে সকলের কাছে পৌঁছে দেবেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে হয়তো ছবি দেখতে আসার অনুরোধ জানালেও জানাতে পারি।

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বাংলা ছবি আর দেশের ভবিষ্যৎ কি খুবই কঠিন?

সৌরভ: দেশের ভবিষ্যৎ সত্যিই খুব কঠিন। যেখানে সেকুলারদের দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় এবং সেটা উদ্‌যাপন করা হয়— তাকে কঠিন ছাড়া কী বলব! বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি বলার কে! তার জন্য প্রথম সারির পরিচালক-প্রযোজকেরা রয়েছেন। ‘লাপতা লেডিজ়’ দেখে টলিউড বলে, দেখেছ, বিষয়ই আসল রাজা! অথচ, তেমন কোনও বিষয় নিয়ে নতুন কোনও পরিচালক-প্রযোজকদের কাছে গেলে তাঁরা তাঁদের পছন্দের তারকাদের নিতে বলেন! এ বার আপনারা বাকিটা বুঝে নিন।

Saurav Palodhi Onko Ki Kothin Rana Sarkar Parno Mitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy