ডিজিটাল যুগে সিনেমা নির্মাণে সেলুলয়েডের (ফিল্ম) কদর কমেছে। সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে ফিল্মে তোলা অজস্র সিনেমা। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ‘সংরক্ষণ’ প্রসঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্র মহল ছিল উদাসীন। ১৯৬৪ সালে পিকে নায়ার ‘ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া’ তৈরির মাধ্যমে ভারতীয় ছবিকে সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। ফলে অজস্র ছবি বেঁচে যায়। কিন্তু ফিল্ম শুধু ক্যানে ভরে রাখলেই হবে না। ছবিকে বড় পর্দায় তুলে ধরার জন্য, বিশেষ করে আধুনিক ‘ফোর কে’ রেজ়োলিউশনে প্রদর্শনের জন্য রেস্টোর করা প্রয়োজন। গত ১১ বছর ধরে সেই কাজটিই করে চলেছেন শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর এবং তাঁর সংস্থা ‘ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ (এফএইচএফ)।
আরও পড়ুন:
সদ্যসমাপ্ত ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দু’দিনের জন্য উপস্থিত ছিলেন শিবেন্দ্র। উপলক্ষ ছিল তাঁর রেস্টোর করা একাধিক ছবির প্রদর্শন। তার মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জ়মিন’ ছিল অন্যতম। একের পর এক ছবির উপস্থাপনা। লাগাতার ফোন আসছে। ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সন্দীপ রায়ের বাড়িতে উপস্থিতি। তার মাঝেই আনন্দবাজার ডট কমকে সময় দিলেন শিবেন্দ্র। আলিপুরের হোটেলের ঘরে বসে ফিরে দেখলেন তাঁর সফর। আভাস দিলেন সিনেমা নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের।
চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও সিনেমা সংক্রান্ত কাজে একাধিক বার কলকাতায় এসেছেন শিবেন্দ্র। যেমন গত বছরেই শহরে জার্মান পরিচালক উইম ওয়েন্ডার্সের ছবির রেট্রোস্পেকটিভ আয়োজন করেছিলেন তিনি। শিবেন্দ্র বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বাঙালিদের অবদান নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁদের কাজের একটা অংশ সংরক্ষণ করতে পেরে আমি গর্বিত।’’
সাম্প্রতিক কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির প্রদর্শনে পরিচালক বিমল রায়ের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।
একটি সমীক্ষার দাবি, ভারতে সেলুলয়েডের প্রথম যুগের প্রায় ৭৫ শতাংশ নেগেটিভই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বা হারিয়ে গিয়েছে। নির্বাক ছবির সিংহভাগ আর উদ্ধার করা যায়নি। শিবেন্দ্রের কাজ সেখানে খুব সহজ নয়। সেই কাজ সম্পর্কে জানার আগে কেন রেস্টোরেশন প্রয়োজন, তা জানা প্রয়োজন। ১৯৫১ সালের আগে ফিল্ম স্ট্রিপগুলি তৈরি হত সেলুলোস নাইট্রেট থেকে। গান পাউডার তৈরিতে এই একই উপাদান ব্যবহৃত হত। ফলে ফিল্মগুলি ছিল দাহ্য। আর্দ্র স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এই নেগেটিভগুলি সহজেই নষ্ট হয়ে যেত। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে উত্তাপের কারণে ফিল্মে আগুনও ধরে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ১৯১৭ সালে বিধ্বংসী আগুনে আদিযুগের পরিচালক হীরালাল সেনের সিংহভাগ ছবির নেগেটিভ পুড়ে যাওয়ার ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে।
পরবর্তী সময়ে সেলুলোস অ্যাসিটেট থেকে যখন ফিল্ম তৈরি হল, সেখানেও সমস্যা। ঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করা হলে ফিল্ম স্ট্রিপের আকৃতি ছোট হয়ে আসে। ফলে তা প্রজেক্টরের মধ্যে ঠিক মতো বসে না। অনেক সময়ে নেগেটিভে ছত্রাক জমে। কালার ফিল্মের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ফলে ডিজিটাল প্রযুক্তির পূর্বে সেলুলয়েডের আয়ু ছিল অনেকাংশে সংরক্ষণ-নির্ভর।
ফিল্ম নেগেটিভ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছেন শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর। ছবি: সংগৃহীত।
উদয়শঙ্কর পরিচালিত একমাত্র ছবি ‘কল্পনা’, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, গিরিশ কারনাডের ‘ঘাটশ্রাদ্ধ’, শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’-সহ দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছবি রেস্টোর করেছেন শিবেন্দ্র। চলতি বছরেই ইটালির ‘সিনেমা রিট্রোভাটো ফেস্টিভ্যাল’ এবং টরোন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শোলে’-র রেস্টোর্ড ভার্সন প্রদর্শিত হয়। ছবিটি আগামী ১২ ডিসেম্বর ভারতে বড় পর্দায় মুক্তি পাওয়ার কথা। এখন প্রশ্ন হল, ‘শোলে’ ওটিটি বা ডিভিডিতে রয়েছে। তা সত্ত্বেও রেস্টোরেশন প্রয়োজন কেন? একসময়ে মূলত ১৬ মিলিমিটার বা ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মে ছবির শুটিং করা হত। বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শনমাধ্যম, দর্শকের চাহিদা, প্রদর্শনের সময় এবং সেন্সর বোর্ডের কারণে ছবির নানা ধরনের সংস্করণ বাজারে আসে। সেখানে পরিচালকের মূল ভাবনা অনেক সময়েই অধরা রয়ে যায়। তাই মুক্তির দিনের ছবিকে ফিরিয়ে আনার জন্য মূল ক্যামেরা নেগেটিভ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে সেই ফিল্ম এবং অডিয়ো নেগেটিভ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। আবার যে সব ছবির ডিজিটাল সংস্করণ নেই, সেগুলির ক্ষেত্রেও ছবিটি দেখার জন্য ক্যামেরা নেগেটিভের প্রয়োজন।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় ‘শোলে’। দেশে জরুরি অবস্থার কারণে সেন্সর বোর্ড কয়েকটি দৃশ্যে কাঁচি চালায়। কিন্তু মূল নেগেটিভ পাওয়ার কারণে তার মধ্যে দু’টি দৃশ্য বর্তমান সংস্করণে রাখা হয়েছে বলে জানালেন শিবেন্দ্র। অর্থাৎ, পরিচালক রমেশ সিপ্পি যে ভাবে ছবিটি দর্শককে দেখাতে চেয়েছিলেন, এই প্রথম দর্শক তা দেখতে পারবেন। উল্লেখ্য, ‘শোলে’ রেস্টোর করতে ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রায় ৩ বছর সময় লেগেছে।
‘শোলে’ ছবির মূল সংস্করণ (উপরে) এবং রেস্টোর করা সংস্করণ (নীচে)। ছবি: সংগৃহীত।
রাজস্থানের এক রাজপরিবারের ছেলে শিবেন্দ্র। ছোট থেকেই সিনেমার প্রতি আকর্ষণ। অজস্র বিজ্ঞাপনী ছবি এবং তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। তবে ২০১২ সালে পিকে নায়ারের উপর ‘দ্য সেলুলয়েড ম্যান’ তথ্যচিত্রটি তৈরির পর তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে যায়। শুরু হয় সেলুলয়েডকে সংরক্ষণের নিরন্তর প্রয়াস। শিবেন্দ্র বললেন, ‘‘তথ্যচিত্রটা করার সময়েই বলা যেতে পারে রেস্টোরেশনের প্রতি আমার ঝোঁক বাড়ে। যত ঘুরতে থাকি, বিষয়টা নিয়ে তত বেশি জানতে পারি।’’
শিবেন্দ্রের মতে, রেস্টোরেশনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম নেগেটিভ। তার সঙ্গেই থাকে অডিয়ো টেপ। সেগুলি হাতে আসার পর ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। তবে সেই কাজ শেষ হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। শিবেন্দ্রের কথায়, ‘‘ফিল্মের মধ্যে ধুলো-ময়লা থাকে। দাগ থাকে। অজস্র বার প্রজেক্টরে চলার ফলে ফিল্ম ছিঁড়ে যেতে পারে। সেই সব কিছু নতুন করে মেরামত ও স্ক্যান করে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে পুনর্নির্মাণ করা হয়।’’
পরিচালক শ্যাম বেনেগালের (বাঁ দিকে) সঙ্গে শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর। ছবি: সংগৃহীত।
ছবির রেস্টোরশনকে একজন স্বর্ণকারের কাজের সঙ্গে তুলনা করতে চান শিবেন্দ্র। কারণ, এক মুহূর্ত মনোযোগ সরলে নেগেটিভের এমন কোনও ক্ষতি হতে পারে, যা আর ঠিক করা সম্ভব নয়। সিনেমা পরিচালনা করা বেশি কঠিন, না কি রেস্টোর করা? শিবেন্দ্রের মতে, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চাই ইচ্ছাশক্তি এবং প্যাশন। কারণ, ছবি তৈরির জন্য পরিচালকের কাছে অনেকগুলো বিষয় আগে থেকেই তৈরি থাকে। আর রেস্টোরেশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনুসন্ধান এবং অর্থ। ছবি তৈরির ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা থাকে, তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে থাকে না। বললেন, ‘‘শিল্পীর নিজস্ব দর্শনের পরিবর্তন যাতে না হয়, তা খেয়াল রাখতে হয়। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আমি তো কোনও পরিবর্তন করতে পারব না!’’ ছবির লোকেশন রেকির মতোই ক্যামেরা নেগেটিভের সন্ধানে শিবেন্দ্র এবং তাঁর দল সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ান। শিবেন্দ্রের কথায়, ‘‘আমি একজন পরিচালক বলে বহু ছবি সহজে খুঁজে পেয়েছি। তার বেশি কিছু নয়।’’
দেশে সিনেমা রেস্টোরেশনের জন্য ভাল কোনও ল্যাবরেটরি নেই। ‘এফএইচএফ’ তাদের একাধিক রেস্টোরেশনের কাজ ইটালির বোলোনিয়ার ‘ইম্যাজিন রিট্রোভাটা ল্যাবরেটরি’-তে করে থাকে। শিবেন্দ্র তাঁর চলার পথে পাশে পেয়েছেন মার্টিন স্করসেসির ‘ফিল্ম ফাউন্ডেশন’, ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম আর্কাইভ’, ‘ক্রাইটেরিয়ান কালেকশন’-সহ সারা বিশ্বের বহু প্রসিদ্ধ সংস্থাকে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০০০টি ছবি (৮ মিলিমিটার, ১৬ মিলিমিটার এবং ৩৫ মিলিমিটার) সংস্থার ভল্টে সংরক্ষিত রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সেই সংখ্যা বাড়ছে। ছবির পাশাপাশি সিনেমার পোস্টার, লবি কার্ড, বুকলেট-সহ আরও নানা জিনিস সংরক্ষণ করে থাকে শিবেন্দ্রের সংস্থা। সারা বছর সিনেমা সংক্রান্ত নানা কর্মশালা এবং চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে তারা। তাদের ওয়েবসাইট বলছে, কারও কাছে কোনও নেগেটিভ থাকলে তাঁরা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেন। শিবেন্দ্র সেই শিল্পের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির মূল সংস্করণ (উপরে) এবং রেস্টোর করা সংস্করণ (নীচে)। ছবি: সংগৃহীত।
আগামী বছর উত্তমকুমারের জন্মশতবার্ষিকী। মহানায়কের ছবি রেস্টোর করার ইচ্ছা রয়েছে শিবেন্দ্রের। একই সঙ্গে জানালেন, আগামী বছর কলকাতায় তিনি উত্তমকুমার চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করতে চান। শিবেন্দ্র বললেন, ‘‘বাংলা ছবির অন্যতম আইকন। এর আগে অমিতাভ বচ্চন, দিলীপ কুমার বা দেব আনন্দকে নিয়ে যতটা বড় মাপের উৎসব করেছি, সে রকমই করার ইচ্ছে আছে। সারা দেশে উত্তমকুমারের ছবি দেখাব।’’
এই মুহূর্তে মীনা কুমারী অভিনীত ‘পাকীজ়া’ ছবিটি রেস্টোর করতে ব্যস্ত শিবেন্দ্র। পাশাপাশি আরও কয়েকটি ছবির স্বত্ব নিয়ে কথাবার্তা চলছে। ভবিষ্যতে তাঁর সংস্থার অধীনে একটি ফিল্ম মিউজ়িয়াম গড়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে শিবেন্দ্রের। স্বপ্ন দেখেন, দেশের প্রতি রাজ্যে নিজস্ব ফিল্ম আর্কাইভ থাকবে। সিনেমা যেন আরও বেশি করে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের মতো দেশে পোস্টারের বাইরে সিনেমার সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের একটা বড় অংশ বিস্মৃতির আড়ালেই রয়ে যান। সেখানে তাঁকে বা তাঁর সংগ্রামকে মানুষ কী ভাবে মনে রাখলে তিনি খুশি হবেন? কিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর শিবেন্দ্রের উত্তর, ‘‘‘মেঘে ঢাকা তারা’র শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। আমি সিনেমার জন্যই বাঁচতে চাই। পরবর্তী প্রজন্ম এই ছবিগুলো দেখতে গিয়ে সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত।’’