Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Entertainment News

‘নকশালবাড়ির ৫০ বছরেই মেঘনাদবধ রহস্য রিলিজটা কাকতালীয়’

রবিবার ‘মেঘনাদবধ রহস্য’-র ৫০ দিন পূর্ণ হচ্ছে। সত্তরের নকশালপন্থীদের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালের মাওবাদীদের সেতুবন্ধন সম্বলিত এই কাহিনি ভবিষ্যতে টলিউডে রাজনৈতিক ছবির ধরনটাই হয়তো বদলে দেবে। পরিচালক অনীক দত্ত কিন্তু সুরবেক বিশ্বাস-কে বললেন, তিনি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ছবি বানাননি!রবিবার ‘মেঘনাদবধ রহস্য’-র ৫০ দিন পূর্ণ হচ্ছে। সত্তরের নকশালপন্থীদের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালের মাওবাদীদের সেতুবন্ধন সম্বলিত এই কাহিনি ভবিষ্যতে টলিউডে রাজনৈতিক ছবির ধরনটাই হয়তো বদলে দেবে। পরিচালক অনীক দত্ত কিন্তু সুরবেক বিশ্বাস-কে বললেন, তিনি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ছবি বানাননি!

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৩:০৮
Share: Save:

এই বছর নকশালবাড়ি আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী। তাই, পরিকল্পনা মাফিক, ভেবেচিন্তেই কি ২০১৭-তে ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ মুক্তি পেল?

অনীক: একেবারেই না। এটা নিছকই কাকতালীয়। বলা যায়, সিনেম্যাটিক সমাপতন। ছবিটা মুক্তি পাওয়ার সময়ে এক জন মনে করিয়ে দিলেন। ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিল না।

মাথায় ছিল না! এমন একটা রাজনৈতিক ছবি যিনি বানাচ্ছেন, নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী তাঁর মাথায় ছিল না, এই কথাটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?

অনীক: আমার কিন্তু রাজনৈতিক ছবি শব্দবন্ধটা নিয়ে আপত্তি আছে। মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’ যে অর্থে রাজনৈতিক ছবি, আমার এই ছবি সেই অর্থে রাজনৈতিক ছবি নয়। রাজনীতি অবশ্যই একটা উপাদান, তবে আমি নিখাদ রাজনৈতিক ছবি করতে চাইনি। পটভূমিতে নকশালবাড়ি আন্দোলনকে রাখতে চেয়েছি। আমি আরও কিছু বলতে চেয়েছি, দেখাতে চেয়েছি। আর আমি অনেক আগেই বলেছি, আমি থ্রিলার তৈরি করিনি। দর্শক থ্রিল্‌ড হলে সেটা তাঁর ব্যাপার। হ্যাঁ, ছবির নামকরণে ‘রহস্য’ শব্দটা আছে। ছবির ক্লাইম্যাক্সে একটা উন্মোচন বা উদ্ঘাটন আছে। তার পরেও বলব, এটা তথাকথিত থ্রিলার না।

আরও পড়ুন: মুভি রিভিউ: ‘ড্যাডি’ গ্যাংস্টার থেকে গডফাদার হয়ে ওঠার জার্নি

আপনি না চাইলেও ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ রাজনৈতিক ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং বলব, রাজনৈতিক ছবির পটভূমিকায় কিছু সামাজিক তথা পারিবারিক উপকরণ চলে এসেছে। ছবির উপজীব্যই তো রাজনীতি। নকশাল আন্দোলন তথা অতি বাম রাজনীতি কী ভাবে আপনার উপর প্রভাব ফেলল?

অনীক: নকশাল আন্দোলনের যখন উত্তাল সময়, আমি তখন শৈশবে। কিছু ঘটনা আবছা মনে আছে। যেমন, কোনও প্রতিবেশীর খোঁজে পাড়ায় প্রচুর পুলিশ ঢুকেছে কিংবা কোনও আত্মীয় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তখন নকশাল শব্দটার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হওয়া। তার পর আশির দশকে যখন কলেজ ছাত্র, ওই অধ্যায় নিয়ে আবার প্রবল কৌতূহল ও আগ্রহ তৈরি হল। কিছু বই পড়লাম, কয়েক জন মানুষের সঙ্গে কথা হলো, বহু জিনিস জানলাম। তবে এ টুকুই। নকশাল আন্দোলনের অধ্যায় নিয়ে গোটা একটা ছবি করার মতো পড়াশোনা আমার নেই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকার তো প্রশ্নই নেই। সঙ্গত কারণে শুধুই নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান নিয়ে ছবি করার স্পর্ধা আমি দেখাতে পারিনি।

তা হলে কে এই অসীমাভ বসু?

অনীক: আমার এক পরিচিত সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন। মেধাবি ছাত্র ছিলেন, তাঁর বাবা ছিলেন ব্যুরোক্র্যাট। প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েন, পরে আন্দোলনের প্রতি মোহভঙ্গ হয় এবং তিনি বিদেশে পড়াশোনা করতে চলে যান। সেখানে প্রতিষ্ঠা পান। এই পর্যন্ত ছবির অসীমাভ বসুর সঙ্গে তাঁর মিল আছে। তার পর আমি অসীমাভকে যে ভাবে দেখিয়েছি, মানে এক কমরেডের সঙ্গে তাঁর আপাত বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টা— ওটা সম্পূর্ণ আমার কল্পনা। তার সঙ্গে বাস্তবে আমার ওই পরিচিতের কোনও মিল নেই।

‘মেঘনাদবধ রহস্য’-র একটি দৃশ্যে সব্যসাচী চক্রবর্তী।

‘ভূতের ভবিষ্যত্’-এ দেখেছি, সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে আপনার অভিমত, আপনার অবস্থান আপনি বিভিন্ন চরিত্রের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে পেশ করেছেন। ‘মেঘনাদবধ রহস্য’-তে সত্তর দশকের এক নকশালপন্থী দম্পতির সন্তান সাম্প্রতিকের মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত। এমনকী, পুলিশ ভর্তি গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া বিস্ফোরক জঙ্গলে মাওবাদী স্কোয়াড-সদস্যদের হাতে যিনি পৌঁছে দেন, তাঁর সঙ্গেও নকশালপন্থী দম্পতির সন্তানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তার মানে কি আপনি বলছেন, নকশাল আন্দোলনের ধারাই এখনকার মাওবাদীরা বহন করছেন?

অনীক: প্রথম কথা, আমার ছবিতে মাওবাদ বা মাওবাদী শব্দটা কোথাও নেই। তবে নাম না করে অবশ্যই সাম্প্রতিকের মাওবাদীদের কথা বলা হয়েছে, দেখানো হয়েছে। সেটা অস্বীকার করা যাবে না। ২০১৬-তে ঝাড়গ্রামে বিস্ফোরণে পুলিশ ভর্তি গাড়ি ওড়ানোর ঘটনা আছে। তবে এটা কাল্পনিক, চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে দেখানো। কারণ, এখন এই রাজ্যে মাওবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপ হয়তো নেই। অবশ্য ঝাড়গ্রামে এই ধরনের ঘটনা না ঘটলেও লাগোয়া প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে এমনটা হচ্ছে। ছবিতে নকশাল দম্পতির সন্তান যখন মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, তখন কিন্তু তিনি জানতেন না যে, তাঁর মা-বাবা নকশালপন্থী ছিলেন। অর্থাৎ, মা-বাবা নকশালপন্থী ছিলেন বলে তাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তান মাওবাদী হলেন, এমনটা নয়। মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনেক পর তিনি মা-বাবার পরিচয় জেনেছেন।

আরও পড়ুন, মেঘনাদ বধ রহস্য: ফের ছন্দ ভাঙলেন অনীক

কিন্তু দু’টো সময়ের আন্দোলনকে এক করে দেওয়ার ব্যাপারটা এখনকার মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কয়েক জনেরও আপনার ছবি দেখার পর মনে হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, সত্তরের দশকের বিপ্লবীদের অধিকাংশেরই পরবর্তী মোহভঙ্গ হয়। সেই জন্য তাঁরা চাননি, তাঁদের সন্তান বা বংশধরেরা এই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হোন। চাইলে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ওই লোকটার, মানে কিষেণজির এই রাজ্যে আসার প্রয়োজন হতো না। কী বলবেন?

অনীক: আবারও বলছি, ছবিটা বাস্তবের কিছু তথ্য আর আমার কল্পনার মিশ্রণ। জঙ্গলমহলে কিছু দিন আগেও মাওবাদী রাজনীতির বাস্তবতা ও মাওবাদীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। মাওবাদী স্কোয়াড যখন জঙ্গলমহলে কাজ করছে, সেই সময়ে শহর ও শহরাঞ্চলে কাজ করছে তাদের গণ সংগঠন, সক্রিয় তাদের সিমপ্যাথাইজাররা। দুয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন দেখানো হয়েছে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রটার মধ্যে দিয়ে। মাওবাদীদের একটি মহিলা সমিতি-কে আমি ছবিতে প্রীতিলতা স্কোয়াড বলেছি। আর একটি গণ সংগঠনকেও বোঝাতে চেয়েছি ওপিডিআর নামে। অস্বীকার করব না, নকশাল রাজনীতি ব্যাপারটাই আমাকে রোমাঞ্চিত করেছে। সেই জন্য একটা সময়ে ভেবেছিলাম, ময়দানে এক নকশাল নেতাকে পুলিশের গুলি করে হত্যা করার ঘটনা এক বিখ্যাত অভিনেতা যে ঘটনাচক্রে দেখে ফেলেছিলেন, সেটা নিয়ে ছবি করব। সেই সময়ে দিব্যেন্দু পালিতের ‘সহযোদ্ধা’ পড়েছিলাম। বেশ খানিকটা এগিয়েও ছবিটা আর করা হয়নি। মাওবাদীরা তো বহু বার চারু মজুমদারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা বলেছেন। তা হলে দু’টোকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে কী ভাবে? ছবিতে মোচড় দেওয়ার কারণে দেখিয়েছি, দুই প্রজন্মই অতি বাম রাজনীতির পথ নিয়েছে। কিন্তু সেটা তো জেনেশুনে বা পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে না।

‘মেঘনাদবধ রহস্য’-র একটি দৃশ্য।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোপালচন্দ্র সেনকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন যে নকশাল নেতা, তিনি পরে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন। সেখানেই থিতু ও প্রতিষ্ঠিত হন। আশির দশকের গোড়ায় কলকাতার এক সাংবাদিক নিউ ইয়র্কে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেন। অসীমাভ বসুর প্রথম বার পলায়নে কি তার প্রতিফলন?

অনীক: আপনি যাঁর দিকে ইঙ্গিত করছেন, শুধু তিনি নন। আরও অনেকে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। কারও ক্ষেত্রে ভয় কাজ করেছিল, কারও ক্ষেত্রে মোহভঙ্গ। সে দিক থেকে আমার অসীমাভ বসু ওই শ্রেণির প্রতিনিধি তো বটেই। তবে আমার ছবিতে বিশ্বাসভঙ্গ, বিশ্বাসঘাতকতা, বদলা, পুলিশের থার্ড ডিগ্রি সহ্য করতে না পেরে অতি গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া— এগুলো বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। কেন জানেন? আমি সত্তরের দশকের বিপ্লবী আন্দোলনের পটভূমিকায় এ সব দেখিয়েছি বটে। তবে আমি মনে করি, এখনকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেগুলোর চেহারা আরও কদর্য। তাই, এ সব জিনিস ছবিতে দেখানো জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE