বৃদ্ধ হওয়ার আগে বুদ্ধদার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি তখন ২২, বুদ্ধদা ৫৯। ছত্রিশ বছরের ব্যবধান। আমাদের ভালবাসার সম্পর্কে বয়সের ফারাক কোনও দিন গুরুত্ব পায়নি। তবে শরীরের বয়সের তফাত তো ছিলই। আমরা জানতাম, হয়তো এমন একটা দিন আসবে যখন বুদ্ধদা আমার আগে চলে যাবে। সেই নিয়ে দু’জনের মনেই একটা বেদনা বোধ যেন চিনচিন করত। বুদ্ধদা মজা করে বলত, “তোমার পঞ্চাশ বছরে একটা দাঁত পড়া দেখে তবে আমার মৃত্যু।” পঞ্চাশ বছরে যদিও সকলের দাঁত পড়ে না, তবু অনেক বছর ধরে ভালবাসার পথ পেরিয়ে আমরা বিয়ে করলাম, ২০১৫ সালে। দশ বছর হয়ে গেল আমাদের বিয়ের।
আমরা যদিও প্রাতিষ্ঠানিক বিয়ের কথা ভাবিনি। তা-ও বিয়ে করেছিলাম আমরা। বুদ্ধদা তো আগেই বিয়ে করেছিলেন। সন্তান ছিল। প্রথম স্ত্রী চলে যান ক্যানসারে। বুদ্ধদা আমাদের এই বিয়েটা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমি চাই আমার স্ত্রী হিসেবে তোমার নাম থাকুক।” আমার দিক থেকে বলতে পারি, বিয়ে এখনও অনেক কিছু সামলে দেয়। আমি ওর সমস্ত খেয়াল রাখতাম। এমনও হয়েছে, ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে একটা সইয়ের জন্য। আইননির্ধারিত কোনও এক ব্যক্তির জন্য। যাঁর সই প্রয়োজন। অথচ, তাঁর সঙ্গে বুদ্ধদার সে অর্থে কোনও সম্পর্কই নেই। এটা ভাল লাগছিল না। আর ভালবেসে বিয়ে করার অন্য মজা আছে। সেটা ভালও লাগে।

ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং সোহিনী দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।
আরও পড়ুন:
আমাদের দাম্পত্য অবশ্য অন্য রকম ছিল। আমি আজও জানি না, দাম্পত্য ব্যাপারটা ঠিক কী। আমাদের এক সিনেমাকর্মীকে বুদ্ধদা বলেছিল, “তুমি কব্জি ডুবিয়ে সংসার করলে সিনেমা হবে না। দিদি যেমন কড়ে আঙুল ডুবিয়ে সংসার করে তেমন করো।”
ওই কড়ে আঙুল ডোবানো সংসারে বুদ্ধদা আগের রাত থেকে পরের দিনের মেনু ঠিক করত। সেটাও আবার তিন থেকে চার বার বদলে যেত। এমনই ছিরির সংসার ছিল! রোজ রাতে আমাদের নাইট শো হত। আমি ওয়াইন হাতে, বুদ্ধদা হয়তো হুইস্কি। ছিল একের পর এক সিনেমা দেখা। আর আড্ডা। মানুষটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তিনি যখন আড্ডা দিতেন, সেখানে শক্তি, সুনীল, ভাস্কর চক্রবর্তীরা আসতেন। আমি সেখান থেকেই সারা পৃথিবীকে দেখতে পেতাম। পুরুলিয়ার ধু-ধু লালচে প্রান্তর, যার তল নেই, কূল নেই। দূরে হঠাৎ কোনও মানুষ বা একখানা গাছ। আমাদের জীবনটাও তেমন বড় প্রান্তরের মতো ছিল। কত মানুষের আনাগোনা।
আমাদের অসম বয়সের বিয়ে, বুদ্ধদার অসুস্থতা, বুদ্ধদার পরিবার, সব মিলিয়ে নানা কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। আমার কোনও আফসোস নেই। বরং সারা ক্ষণ নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, যা আমায় সমৃদ্ধ করেছে। আমায় একক মানুষ হিসেবে শক্তি দিয়েছে। আমি ওর কথা ভেবেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট করেছি। জন্মদিনে ছবির ফেস্টিভ্যাল হল। এই কাজের মধ্যে দিয়েই ওকে মনে রাখি। আরও অনেক কাজ হবে।

২০২১ সালের ১০ জুন প্রয়াত হন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।
এমন একটা সময় এল যখন বুদ্ধদার ডায়ালিসিস শুরু হল। আমরা বুঝতে পারছিলাম, বুদ্ধদা আর থাকবে না। আমাদের ভালবাসার মধ্যে এই চলে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিরন্তর বজায় ছিল। আর ছিল সিনেমা। আর কিছু হয়নি বলে সিনেমা করতে আমি আসিনি। বরং অনেক কিছুই হতে পারত যা ছেড়ে আমি সিনেমা করতে এলাম। আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের যে যে ছবির সঙ্গে আমি জড়িয়ে রইলাম তাতেই মনে হয়, অনেক পাওয়া হয়েছে। আমি জানতাম না, এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে জানতে পারি, অনেককেই আমার খেয়াল রাখার কথা বলেছিলেন। তবে কোনও দিন আমায় মৃত্যুর কথা বলেনি।
একেবারে শেষের দিকে বোধহয়। হাসপাতালে গিয়ে বললাম, “কী হল? দেখতে পাচ্ছ না?” বললাম, “কটা আঙুল?’’ হেসে বলল, “৬টা।” খুব হেসে উঠলাম। মৃত্যু যে দিন দুয়ারে, দু’জনে বুঝেই অনেক ক্ষণ ধরে অনেক অনেক কথা বলেছিলাম। খুব ব্যক্তিগত কথালাপ। তবে ওখান থেকে দু’জনেই স্বীকার করেছিলাম, ভাগ্যিস আমাদের দেখা হয়েছিল।
বুদ্ধদা এমন একদিনেই চলে গিয়েছিল। আমি দিশাহারা। একা বাড়িতে থাকতে পারতাম না। কোন কাজ করব, আর কোন কাজ করব না, বুঝে উঠতে পারছি না। এমন এক অসময়ে বুদ্ধদার ছবির সামনে এলাম। কথা বলা শুরু করলাম। চলে যাওয়ার পরের যে বুদ্ধদা, সে আমায় বলল, “তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো। তুমি তো আমায় চেনো। তুমি প্রশ্ন করলে তোমার মনে যে উত্তর আসবে সেটা আমিই দেব।” এ ভাবেই কথা বলতে শুরু করলাম। জীবনকে ওর মতো করেই আলিঙ্গন করলাম। বাঁচতে শিখলাম।