Advertisement
E-Paper

জ্বলছে না কি জুড়োচ্ছে? শ্মশানে গার্গীর প্রশ্ন! উপস্থিত নীল, রজতাভ, ঋতব্রতেরও একই ধন্দ?

প্রতি মুহূর্তে অত্যাচারে বিধ্বস্ত নারী। প্রায় প্রতি দিন শ্মশানে তার চিতা জ্বলছে। পরিবারের সদস্যদের মতো, এখানেও জ্বলছে সে। সত্যিই কি জ্বলে, না কি জ্বালা জুড়োয়?

উপালি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৫ ০৮:৩৬
‘পাগলা ঘোড়া’ ছবিতে গার্গী রায়চৌধুরী।

‘পাগলা ঘোড়া’ ছবিতে গার্গী রায়চৌধুরী। নিজস্ব ছবি।

‘পাগলা ঘোড়া খেপেছে, বন্দুক ছু়ড়ে মেরেছে...’! পাগলা ঘোড়ার এই খ্যাপামি ছোটবেলা থেকে মা-দিদিমাদের মুখে মুখে ফিরেছে। পাগলা ঘোড়া খেপলে তাকে থামাতে বন্দুক ছুড়ে মারা ছাড়া গতি নেই, ছড়ার দু’টি পংক্তিতে সে কথা পরিষ্কার। কোনও ভাবে পুরুষ যদি ‘পাগলা ঘোড়া’ হয়ে ওঠে? ভালবাসায় কিংবা লালসায়...!

গ্রামের এক শ্মশানে বসে সেই আলোচনায় মগ্ন চার পুরুষ। পেশায় কেউ কম্পাউন্ডার, কেউ শিক্ষক, কেউ বা অন্য কিছু করেন। পুরুষের বঞ্চনার শিকার এক নারী। সে আত্মহত্যা করেছে। তাকে দাহ করতে চার মাথা একত্র। চার জনেই ঈষৎ মত্ত। এ অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই চার পুরুষের মাথা আর মন সমান্তরালে নেই। নিশুতি রাতে এলোমেলো মন যেন তাদের দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে তাদের জীবন কাহিনি।

এই চার পুরুষ কোনও ভাবে ওই আত্মঘাতিনীর মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত নয় তো?

সেটে নীল মুখোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত।

সেটে নীল মুখোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত। নিজস্ব ছবি।

অলরাইট ভেরি গুড...

উত্তর নিয়ে আসছে শেখর দাশের আগামী ছবি ‘পাগলা ঘোড়া’। এ বছর নাট্যকার বাদল সরকারের জন্মশতবর্ষ। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পরিচালক নাটককারের সত্তরের দশকে লেখা বিখ্যাত নাটক ‘পাগলা ঘোড়া’কে পর্দায় তুলে আনতে চলেছেন। সম্প্রতি তারই সেট ভিজ়িটে আনন্দবাজার ডট কম পৌঁছে গিয়েছিল টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োয়। মেঘের ভারে আকাশ প্রায় ভেঙে পড়ার জোগাড়। সকাল থেকে কখনও জোরে কখনও ঝিরিঝিরি ধারাপাত। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর ভিতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ। সেখানে শ্মশান লাগোয়া টিনের কারশেড। চৌকির উপরে আধময়লা চাদর বিছানো। চার পুরুষের সামনে বোতল, গ্লাস আর সঙ্গী কিছু খাবারদাবার। বাকিদের থেকে অনেকটাই ছোট স্কুল শিক্ষক একমাত্র প্রকৃতিস্থ। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তিন জন পুরুষ উঠে দাঁড়ালেও শিক্ষক খাটে আধশোয়া।

তিন বার মহড়া তিন বার টেকের পর শট ‘ওকে’। তখনও দৃশ্যের ঘোর কেটে বেরোতে পারেননি নীল মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়।

আপনি কোনও দিন শ্মশানে রাত কাটিয়েছেন? প্রশ্ন ছিল নীলের কাছে। অভিনেতা জানিয়েছেন, তাঁর মা-সহ অনেক ঘনিষ্ঠের মৃত্যুতে শ্মশানে রাত কাটাতে হয়েছে তাঁকে। এখানে এলে মন বদলে যায়, এ কথা অস্বীকার করেননি। “প্রেক্ষিতটা অনবদ্য। সমাজের তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আঙুল তোলা হবে। এক নারীর মৃত্যুকে ঘিরে চার পুরুষের উপলব্ধি বলতে পারেন। প্রত্যেকের জীবনে বেদনাদায়ক অধ্যায় আছে। সে সবও প্রকাশ্যে আসবে”, ব্যাখ্যা দিলেন অভিনেতা।

গার্গী রায়চৌধুরী, নীল মুখোপাধ্যায়, পরিচালক শেখর দাশ।

গার্গী রায়চৌধুরী, নীল মুখোপাধ্যায়, পরিচালক শেখর দাশ। নিজস্ব চিত্র।

নাট্য পরিচালক যদি পর্দায় নাটকে তুলে ধরেন তা হলে কি সেটি বেশি নিখুঁত হয়?

এমন কোনও কথা নেই, জানালেন নীল। তাঁর মতে, বার্গম্যান, অমল পালেকর হয়ে শেখর দাস বা অনির্বাণ ভট্টাচার্য— প্রায় প্রত্যেক অভিনেতা-পরিচালক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। তাই নাট্য পরিচালকেরা নাটককে পর্দায় তুলে ধরলে তাঁরা বেশি ভাল পরিচালনা করবেন, সেটা ঠিক নয়। সেই জায়গা থেকেই নীলের বক্তব্য, “বাদল সরকারের লেখা এই নাটক সত্তরের দশকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। একুশ শতকেও ছবির আকারে পর্দায় ছাপ ফেলবে বলেই মনে হচ্ছে।”

পুরুষ বলে লজ্জিত নই, পুরুষতান্ত্রিকতার কুফল কমাতে পারিনি, তার জন্য লজ্জিত

২৩ বছর পরে আবারও শেখর দাসের সঙ্গে কাজ করলেন রজতাভ। তিনিও মঞ্চ এবং পর্দাসফল অভিনেতা। যখন নাটক পর্দায় ওঠে কেমন লাগে? নাকি নাটক শুধু মঞ্চে থাকা উচিত? “এ ভাবে বলা খুবই মুশকিল”, বক্তব্য রজতাভের। উদাহরণ দিয়েছেন, মরাঠি বা ইংরেজি নাটক থেকে অনেক ভাল ছবি দর্শক উপহার পেয়েছে। তাই নাটক থেকে ছবি তৈরি না হওয়ার যৌক্তিকতা তিনি অন্তত বোঝেন না। তবে নাটককে সিনেমায় রূপান্তরিত করার আগে চিত্রনাট্য, সংলাপ ইত্যাদির পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, জানিয়েছেন তিনি। তবে পর্দায় ‘পাগলা ঘোড়া’কে তুলে ধরতে গিয়ে শেখর খুব বদল ঘটাননি, এ কথাও বলেছেন তিনি।

গল্পে পুরুষততান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। আপনিও পুরুষ। অভিনয় করতে করতে কী উপলব্ধি আপনার?

রজতাভের কথায়, “আমার চারপাশের অনেক পুরুষকে দেখেছি, যাঁরা পুরুষতান্ত্রিকতার মিথ ভাঙার দলে শামিল। আবার এও দেখেছি, অনেক নারীর অন্তরে পুরুষতন্ত্রের বাস। তাই পুরুষ হওয়ায় লজ্জিত নই। পুরুষতান্ত্রিকতার কুফল কমাতে পারিনি বলে তার জন্য লজ্জিত।”

সুপ্রতীম ভোলের ক্যামেরায় চোখ চার অভিনেতার।

সুপ্রতীম ভোলের ক্যামেরায় চোখ চার অভিনেতার। নিজস্ব ছবি।

এত আরাম করে শেষ কবে শুট করেছি...?

ঋতব্রত মনে করতে পারেননি! তিনি চার পুরুষের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় আধশোয়া হয়ে শট দিয়েছেন তিনি। তার উপর দৃশ্য অনুযায়ী তাঁকে মদ্যপানের অনুরোধ জানানো হচ্ছে! প্রসঙ্গ তুলতেই অভিনেতার হাসিমাখা জবাব, “একে তো এখন আর সেটে শুটিং হয় না। তার উপরে এত আপ্যায়ন, শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘর। অনেক দিন এত আরামে কাজ করিনি।” ছোটবেলায় ‘পাগলা ঘোড়া’ পড়েছেন ঋতব্রত। অভিনয়ের আগে আরও এক বার পড়তে গিয়ে প্রথম সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। প্রত্যেক পুরুষের জীবনে কিছু না কিছু বেদনা রয়েছে। সেই গল্পই এই ছবিতে।

টানা কয়েক দিন তিনি অভিনয় দুনিয়ার খ্যাতনামা অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করছেন। কেমন অভিজ্ঞতা? অভিনেতার কথায়, “প্রত্যেকে আমার বাবা শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের বন্ধু। কিংবা ছোট থেকে ওঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। ফলে, ভয় কাজ করে না। বরং, অনেক কিছু শিখতে পারি।”

যে নারীকে নিয়ে চার পুরুষের এত বিলাপ সেই আত্মঘাতিনীর চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরী। এর আগে নাটক থেকে তৈরি ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন গার্গী? অভিনেত্রী আনন্দিত, এই ধারার কাজ এই প্রথম এবং শুরু বাদল সরকারের মতো নাট্যকারের বিখ্যাত ছবি দিয়ে।

জ্বলছে? না কি জুড়োচ্ছে....?

তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে বলতে বসে এ কথাই বললেন অভিনেত্রী। যে চরিত্রে একদা তৃপ্তি মিত্র অভিনয় করেছেন সেই চরিত্রে তিনি। এ কথা জানিয়ে গার্গী বলেছেন, “‘পাগলা ঘোড়া’ পাগল প্রেমিক পুরুষের প্রতীক। একটা পাগল করা প্রেম! প্রত্যেক নারীই এই পুরুষকে কামনা করে। যাকে পোড়ানো হচ্ছে সে যেন নারীজাতির প্রতীক।” চরিত্র সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি আরও জানিয়েছেন, চার জন পুরুষের সঙ্গে ওই মেয়েটি জড়িয়ে পড়েছিল। এ বার সে যেন ওই পুরুষের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা নিংড়ে বার করছে। আর প্রশ্ন তুলেছে, “বলো না বলো! জ্বলছে? না জুড়োচ্ছে!” অভিনেত্রীর মতে, এই দার্শনিক মত পর্দায় ফুটিয়ে তোলাই মস্ত চ্যালেঞ্জ।

ছবির জন্য কোনও একটি চরিত্রে অভিনয় আর নাটকের চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা— কোনটায় বেশি তৃপ্তি?

পরনে ধনেখালির লাল-কালো-সাদা ডুরে শাড়ি। কোমর ছোঁয়া বিনুনি। আর কোনও সাজ নেই গার্গীর। মেকআপ রুমে বসে শেষ টাচ দিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রশ্ন শুনে স্মিত হাসি তাঁর। বললেন, “আমি অভিনয় করে তৃপ্ত।” বর্তমানে দেশ, রাজ্য, শহর জুড়ে নারী অপমানিত, অবদমিত। প্রায় প্রতি দিন তাঁদের চিতা জ্বলছে। তাঁরা কি পুড়ছেন, নাকি জুড়োচ্ছেন? অভিনেত্রীর উপলব্ধি, “জ্বলতে জ্বলতে জুড়োচ্ছে। তাঁদের সব অপমান, অনুতাপ, যন্ত্রণা পুড়ে খাক হয়ে যায় দাহকাজের সময়।”

মুখোমুখি গার্গী, নীল।

মুখোমুখি গার্গী, নীল। নিজস্ব ছবি।

মাইকটাও আমার সঙ্গে বজ্জাতি করছে...!

শেখর দাশ। ‘মহুলবনীর সেরেঙ’, ‘কালের রাখাল’, ‘ক্রান্তিকাল’-এর মতো অন্য ধারার ছবি তাঁর ঝুলিতে। শতবর্ষ পালন ছাড়াও কি নাটককে পর্দায় তুলে ধরার পিছনে অন্য কারণ ছিল? শেখরের কথায়, “চেকভের একটি নাটক নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। তখনই প্রযোজনা সংস্থা স্বভূমি ফিল্মস একটি ছবি তৈরির অনুরোধ জানায়। আমি বেছে নিই বাদলদার নাটককে। যা দেখে ছোট থেকে বড় হয়েছি।”

বরাবর নারীদের নিয়েই ছবি বানিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংক্তি ধার করে তাই রসিকতা, ‘নর বলে আমি বড় নারীঘেঁষা...!’ সেই নারীদের বড় দুর্দশা। চোখ মেললেই খবরের কাগজে বড় হরফে সেই খবর। তাই কি সেই বিষয় নিয়ে ছবি? “অনেকটা তাই। নাটকে পুরুষতান্ত্রিকতার নেতিবাচক নিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পর্দাতেও সেটাই অবিকৃত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”

কথার ফাঁকেই পরের শটের জন্য সেট থেকে হাঁক। শেখর টেকনিশিয়ানদের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়লেন, “মাইক বড় বজ্জাতি করছে আমার সঙ্গে। কেউ আমার কথা শুনতেই পাচ্ছেন না!” পরিচালকের দুই পাশে ততক্ষণে নীল আর গার্গী বসে পড়েছেন। নিজেদের পার্ট ঝালিয়ে নিচ্ছেন। তারই ফাঁকে শেখরের বক্তব্য শুনে গার্গীর মুচকি হাসি, “একেই বলে যন্ত্রের যন্ত্রণা!”

Pagla Ghora Gargi Roychowdhury Sujan Neel Mukherjee Rajatava Dutta Ritabrata Mukherjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy