Advertisement
E-Paper

‘সমস্ত ভাল থাকাটা বিয়ের গায়ে হেলান দিয়ে হবে না’

দু’জনের কথায় এক সুর। কবিতার মধ্যে দু’জনকে ধরা যায়। সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। নারী দিবসের প্রাক্কালে দু’জন বসলেন পাশাপাশি। গল্প করতে করতে বেরিয়ে এল অনিশ্চিত বিয়ে, জটিল সম্পর্ক, নারী আর ‘বৌ’-এর বাস্তব মুখ।মেয়েদের পরাধীনতার ইতিহাস দীর্ঘ। এখানেই ‘মুখার্জীদার বউ’-এর গুরুত্ব।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ১৮:৪৬
শাশুড়ি-বউমা সম্পর্কই তুলে ধরা হয়েছে ‘মুখার্জীদার বউ’ ছবিতে।

শাশুড়ি-বউমা সম্পর্কই তুলে ধরা হয়েছে ‘মুখার্জীদার বউ’ ছবিতে।

নারী দিবসে ‘মুখার্জীদার বউ’ কেন? এই ছবি কি নারী স্বাধীনতা নিয়ে?
সম্রাজ্ঞী: মহিলাদের স্বাধীনতা উদযাপনের দিন নারী দিবস ঠিকই। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বলি, স্বাধীনতাকে যদি একটা কনসেপ্ট ধরি তা হলে নারী কেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই পরাধীনতা আছে। কিন্তু মেয়েদের পরাধীনতার ইতিহাস দীর্ঘ। এখানেই ‘মুখার্জীদার বউ’-এর গুরুত্ব। ছবিতে যে সংলাপ আছে, সাইকলজিস্ট বলছেন, ‘মেয়েরা মেয়েদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়ে না। সমাজ তাঁদের দাঁড় করায়,’ এই জায়গা থেকে ছবিটা অন্য ভাবনা নিয়ে চলে। মেয়েদের মেয়েদের বিরুদ্ধেই লড়াই করিয়ে দেয় পিতৃতন্ত্র! ফলে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময়ও পায় না মেয়েরা।
অনুত্তমা: সম্রাজ্ঞীর কথার রেশ টেনে বলি, আমরা পিতৃতন্ত্রকে আত্মস্থ করেছি। দেখুন, এক জন মহিলা রোজগার করলেই এমপাওয়ার্ড হয় না। থেরাপিস্ট হিসেবে দেখেছি তার এটিএম কার্ড মহিলার স্বামী কন্ট্রোল করে। প্রশ্নটা ‘স্বাধীনতা’র নয়, ‘স্বনির্ভরতা’র। আমরা কতটা স্বনির্ভর? স্বনির্ধারিত? এই দুটো প্রশ্নে। এখন ধাক্কা খাচ্ছি আমরা।

আরও পড়ুন: দুরদর্শনের গানে এমন নাচ! দেখুন ভিডিয়ো​

মনে হয়নি শাশুড়ি-বৌ কেন? এ ছবি দুটো মেয়ের গল্প হিসেবেও প্রচার পেতে পারতো?
সম্রাজ্ঞী: শাশুড়ি-বৌ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এটা অস্বীকার করা যাবে না। ট্রেলারে যে ভাবে সাড়া পড়েছে তাতে মনে হয় দর্শক শাশুড়ি-বৌয়ের গল্প ভেবেই হলে যাবে। আর সেখান থেকে কিন্তু একটা উত্তরণের গল্প নিয়ে ফিরবে। শাশুড়ি-বৌয়ের বন্ধুতা। শাশুড়ি-বৌ একসঙ্গে ওয়াইন খাচ্ছে। এ রকম ইন্টারেস্টিং জায়গা আছে।

শাশুড়ি-বৌ ওয়াইন খেলে কী হয়?
সম্রাজ্ঞী: না, শুধু ওয়াইন খাওয়া দিয়ে কিছু হয় না। প্রেমিক-প্রেমিকাও তো একসঙ্গে ওয়াইন খায়। তার পরেও দেখা গেছে তাদের হয়তো সম্পর্ক ভেঙেছে।
অনুত্তমা: বা সম্পর্ক ভেঙেছে বলে প্রেমিক-প্রেমিকা ওয়াইন খাচ্ছে এ-ও হয়। (হাসি)
সম্রাজ্ঞী: আসলে রেড ওয়াইন ছবিতে উদযাপনের চিহ্ন।

বাংলা ছবিতে শাশুড়িকে সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাচ্ছে বৌমা...
সম্রাজ্ঞী: শুধু নিয়ে যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বৌমাও যাচ্ছে। তখন এই গল্প সরে দাঁড়ায়। সত্যিকারের মনের সমস্যা খুঁজছে এই ছবি। সেই কারণে আমার মনে হয়, ‘মুখার্জীদার বউ’ কোথাও আমাদের দৈনন্দিন ছবিগুলোকেও সামনে নিয়ে আসবে। দর্শক নিজেদের জায়গাগুলো পাবে।
অনুত্তমা: থেরাপিস্ট হিসেবে আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, আমি এ রকম ক্লায়েন্ট পাইনি যেখানে বৌমা শাশুড়িকে নিয়ে এসেছে! ছেলে নিয়ে এসেছে পেয়েছি। ভাবা যায়? আমরা বলে থাকি, ‘তোমার সমস্যা, তুমি যাও।’ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলি, এই ছবি কিন্তু দু’জনকেই আনছে। ক্ষমতার সমীকরণ বদলাচ্ছে।’ ডিকনস্ট্রাকশন অব পাওয়ার’ যাকে বলা যায়।


সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়।

একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। এই যে বৌমা, শাশুড়ি, বিয়ে। আজকের সমাজে বিয়েটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হয়?
অনুত্তমা: খুব গোলমেলে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বিয়েটা রয়েছে। মানুষ দুটো বিয়েতে নেই। সম্পর্ক খাতায়কলমে। দৈনন্দিন জীবনে বিয়ের কিছু কার্যকারিতা আছে। সেই জায়গাটা ধরে মানুষ থেকে যাচ্ছে। এই ছবিটার বিষয়ে সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে বেশ কয়েক বার আমার কথা হয়েছে। সেই জায়গা থেকে বলি, অনেক সময় অচেনা কথা জানানোর জন্য, বোঝানোর জন্য অচেনা কিছু দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছলে মানুষ তা নেয় না। এই যে শাশুড়ি-বৌয়ের চেনা ন্যারেটিভ, এই ন্যারেটিভ ধরে ছবিটা দর্শককে অন্য কথা জানাবে। অচেনা হলে মানুষ হলে পৌঁছবে না, ভাববে আমার গল্প নয়। আর চেনা গল্প হলে মানুষ হলে যাবে, ভাববে এ তো আমার গল্প! ছবিটা দেখতে দেখতে ভাববে, এ কি, আমার গল্প তো অন্য রকম হয়ে উঠতে পারে! আমিও অন্য রকম করে বিষয়টা ভাবতে পারি। আমি অন্তত খুব আশাবাদী ছবিটা নিয়ে।

আরও পড়ুন: ২৫০ কোটি, ১৩৫ কোটি, ১০০ কোটি...বছরের শুরুতেই চার-ছক্কার বন্যা বলিউডের ব্যাটে​

আপনারা দু’জনে ‘মুখার্জীদার বউ’-এর সঙ্গে কেমন করে যুক্ত হলেন?
সম্রাজ্ঞী: ওর সঙ্গে আমার মানসিকতার মিল আছে। আমি যখন চিত্রনাট্য লিখছি তখন থেরাপিস্টের অংশটায় অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলাম। এটা কি ঠিক পথটা নিলাম? ওর সঙ্গে শেয়ার করেছি ভাবনা। আমার কাছে অনুত্তমার কাজ, লেখা সবটাই একটা ভরসার মতো হয়ে আসে।
অনুত্তমা: আমি সম্রাজ্ঞীর লেখার ভক্ত। ও যখন ফোন করে আমায় বলে ও ছবির জন্য লিখছে, তাতে আমি যারপরনায় খুশি হই। এন্টারটেনমেন্টের মিডিয়াতে অন্য রকম ভাবনার মানুষ যদি না আসে, শুধু এটা হচ্ছে না ওটা হচ্ছে না সমালোচনা করে কী লাভ? আমাদের কাছে বহু মহিলা আসছেন শ্বশুরবাড়ির সমস্যা নিয়ে, কিন্তু শাশুড়ি আসছেন না। এই ছবি দেখে এই না আসার ব্যবধান যদি ঘোচে...

সিনেমা লেখার পর লোকে বলছে সম্রাজ্ঞী এক জন লেখক। আগে যেন তিনি লিখতেন না!
সম্রাজ্ঞী: খুব সহজ ভাবে বলি। খুব ভাললাগার বিষয় এখন তৈরি হয়েছে। এত মানুষ ট্রেলর দেখে হোয়াটস্অ্যাপ করছেন। আলাপ করতে চাইছেন। এটা আমার কাছে সত্যি ভাললাগার। তার সঙ্গে একটা কথা বলি। এখন মনে হচ্ছে, আমি এই প্রথম লিখলাম! এটা আক্ষেপ করে লাভ নেই জানি, বড় পর্দার কাজের আলো আর কবিতা লেখার রোদ্দুরের বিস্তার এক নয়। তবে আমি মনের ভেতর এটা বলি যে, এই আলো থেকে আবার আমায় রোদ্দুরে ফিরতে হবে। কবিতা আমার কথা বলার জায়গা।

এর পর তো চিত্রনাট্য লেখার অফারও পেয়েছেন?
সম্রাজ্ঞী: কথা চলছে। অদ্ভূত ভাবে, লেখালেখির জন্য কৃত্তিবাস বা সাহিত্য আকাদেমির যুব পুরস্কার আমায় এত ফোন কল দেয়নি যা এই ছবির ট্রেলর দেখে মানুষ করেছে।

মনে হয় না, এই সাড়া জাগানোর কাজটা সম্ভব হয়েছে উনডোজ প্রোডাকশনের জন্য?
শিবপ্রসাদদা আর নন্দিতাদির কথা বলতেই হবে। কারণ তাঁরা পৃথাকে, আমাকে— সব নতুনদের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। কই, আমার গল্পের ওপর তো তাঁরা বলেননি, এটা এ ভাবে লেখ! চাইলেই বলতে পারতেন। পৃথাই আমায় অ্যপ্রোচ করে গল্প লেখার জন্য। আর অভিভাবকের মতো শিবপ্রসাদদা আর নন্দিতাদি যখন অ্যাপ্রিসিয়েট করেন তখন আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

আরও পড়ুন: ১৪ বছর আগে কেবিসি-তে এসেছিলেন আজকের এই বলি নায়িকা​

প্রসঙ্গ পাল্টাই। নারী দিবস এল। এখনও আপনারা দু’জনেই সমাজের চোখে ‘মহিলা কবি’...
অনুত্তমা: কবিতা সিংহ কত দিন আগে লিখে গেছেন! তার পরেও আমাদের ট্যাগ করা হচ্ছে ‘মহিলা কবি’। কবিতা নাম দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। তবুও আমরা ‘মহিলা কবি’।
সম্রাজ্ঞী: যেন কবিতা বরাবর পুরুষরাই লিখতেন! হালে মহিলারা কবিতা লিখছেন তো তাই ‘মহিলা কবি’। আর পুরুষরা তো মেয়েদের দেখে কবিতা লিখছেন। আমি বলি আমরাও কিন্তু পুরুষ দেখে কবিতা লিখি।
সম্রাজ্ঞী: আমার যাপনে পোস্ট ম্যারেজ ইসু আছে বহু দিন থেকেই। বহু দিন ধরেই জানি বিবাহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সেই ধারা এই ছবি লেখার ক্ষেত্রে কাজ দিয়েছে।
অনুত্তমা: বিয়ে তো প্রতিষ্ঠান। তবে নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি আশাবাদী, নারী-নারী বা পুরুষ-পুরুষের বিয়ে বা একসঙ্গে থাকার সিভিল রাইটস্ প্রতিষ্ঠা হবে। বিয়ে নামক মোড়কে ঢুকে দু’জন মানুষ এতটাই আশ্বস্ত হয়ে যান যে প্রতিনিয়ত পরস্পরকে আবিষ্কার করার কাজটা তাঁরা আর করেন না। সহিষ্ণুতা থেকেও সরে আসছেন তাঁরা। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান নিয়ে আত্মসন্তুষ্টি বন্ধ করতে হবে। বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, এটা ভুল ধারণা। সমস্ত ভাল থাকাটা বিয়ের গায়ে হেলান দিয়ে হবে না।
সম্রাজ্ঞী: এই সম্পর্কে জল লাগবে। শ্রম লাগবে। এটাও গাছ। অসুখী দাম্পত্য কাটিয়ে ষাট বছর সেলিব্রেট করে কী লাভ?

উঠে পড়েন অনুত্তমা। সঙ্গে সম্রাজ্ঞী।
মোহ, মায়া আর বসন্তের আলতো হাওয়ায় লেগে থাকে আবেগ। যার আর এক নাম সম্পর্ক!

Tollywood Celebrities Actors Interview Mukherjee Dar Bou
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy