ইমন চক্রবর্তী। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।
লোকে গান শোনে না। গান গোনে।
জলসায় গান গাইতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্ব।
‘দাদার কীর্তি’ রিলিজের পর বনগাঁর এক জলসায় হেমন্তবাবুকে ঢিল ছুড়ে মারা হয়েছিল। শ্রোতাদের গান পছন্দ হচ্ছিল না বলে।বললেন রূপঙ্কর। সদ্য কৃষ্ণনগরে ইমন চক্রবর্তীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কম গান গেয়েছেন বলে তাঁকে চরম হেনস্থার বিষয় জানতে চাওয়া হলে কিছুকাল পেছনে হেঁটে বলেন রূপঙ্কর, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে পয়সা না দিয়ে বন্দুক দেখিয়েও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গান গাওয়ানো হয়েছে এমন অজস্র উদাহরণ আছে। এ ঘটনা নতুন নয়। দিল্লিতে শো করতে গিয়ে হেনস্থা করা হয়েছে আমায়। তখন লাইভ বিষয়টা ছিলই না। শুধু গানের জগৎ নয়। কত ডাক্তারদের রাতবিরেতে অন্যায়ভাবে মারধর করা হয়। পাবলিক ফিগার হলে এই সব আক্রমণ হবেই।’’সাফ জবাব রূপঙ্করের।
পঁচিশ বছর ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে শো করার অভিজ্ঞতা। তাই ইমন চক্রবর্তীর ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি লোপামুদ্রা মিত্র।‘‘আমাদেরও ভুল আছে। পারফর্মার হিসেবে আমাদের আড়ালে থাকা উচিত। বড্ড বেশি মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছি আমরা। শ্রোতারা জড়িয়ে ধরে সেলফি তুলছে। যখন যা ইচ্ছে হচ্ছে ফেসবুকে লিখে দিচ্ছে। কোথাও থামা দরকার! আর শিক্ষিত শ্রোতা গুটিয়ে গেছে। বাংলা গান আর চটুল হিন্দি গানের নাচের অনুষ্ঠানের কোনও ফারাক নেই। আমরা শুধু এন্টারটেনার হয়ে রয়ে যাচ্ছি। খুব খারাপ লাগছে বলতে, বিষয়টা এরকম, ‘নাচ ছেমলি নাচ’আফশোস লোপামুদ্রার গলায়।
আরও পড়ুন: ইমনের পাশে এ ভাবেই দাঁড়ালেন সোমলতা-লোপামুদ্রারা
নাহ্, অনুরোধ এলেও ‘বেণীমাধব’ আরগান না তিনি। কারণ শ্রোতাদের পঞ্চাশ শতাংশ ‘বেণীমাধব’গাইতে বললেও বাকি পঞ্চাশ শতাংশ শ্রোতা চান নাচের গান। বা,‘দিদি মেডলি করুন...মেডলি।’ শঙ্কিত লোপামুদ্রা।‘‘আর একটা কথাও বলতে চাই। হয়তো কেউ রেগে যেতে পারে। এই সারেগামাপা-য় রোজ মানুষ সাজগোজ করা, গ্ল্যামারাস মডেল দেখে ভাবতে শুরু করেছে ওই ভাবে গান না গাইলে সেটা গান নয়। আমাদের দোষ। আমরা মানুষকে শিক্ষিত করতে পারিনি। উল্টে অশিক্ষার দিকে নিয়ে যাচ্ছি’’, সবাক লোপামুদ্রা।
তিরিশ বছরের সঙ্গীত জীবনের অভিজ্ঞতায় খুব একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি তাঁকে। ‘‘আমার বিষয় আমায় সম্মানটুকু এনে দিয়েছে। দু’-একবার শ্রোতাদের সঙ্গে মতবিরোধ হলেও আমি সামলে নিয়েছি। প্রকাশ্যে আনিনি। ইমন বা সোমলতা বা অন্য শিল্পীদের সঙ্গে যা হল তা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিল্পী হিসেবে আমাদেরও শ্রোতাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আমি শুনেছি গাঁধীজি সে সময় অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য এক টাকা নিতেন!’’তাঁর বক্তব্য অল্প কথায় বুঝিয়ে দিলেন শ্রাবণী সেন।
প্রতিবাদ করেছিলেন গলা তুলে। কৃষ্ণনগরে আয়োজকদের সঙ্গে বিবাদ ‘লাইভ’ করেছেন ইমন চক্রবর্তী। সে লাইভের কথা লোকের মুখে মুখে। ‘‘আমার এই ঘটনাকে এখন যে যার সুবিধেমতো ব্যবহার করছে নিজের পাবলিসিটির জন্য। উল্টে আমাকেই আক্রমণ করা হচ্ছে। আমি যে বলেছি আমি বাইজি নই, সেই কথা ধরে লোকে লিখছে, আমি বলতে চেয়েছি বাইজি মানে খারাপ! কী আশ্চর্য! একজন মহিলা বলেই এই ধরনের আক্রমণের স্বীকার! পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের সম্মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর ভাল লাগছে না কিছু!’’হতাশ ইমন চক্রবর্তী।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে আরতি মুখোপাধ্যায়— সকলেই এক সময় বাঁশ পোঁতা মঞ্চে গান গেয়েছেন। সে সময়ে অনেক শিল্পীকে নিয়ে জলসা হত। এখন একজন শিল্পীকে অনেক বেশি টাকা দিয়ে আয়োজকরা নিয়ে যান যাতে নাচ, গান, এন্টারটেনমেন্টের সমস্তটাই তাঁর থেকে নিংড়ে নেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন: ‘শিল্পীদের টাকা দিয়েছেন বলে কিছু মানুষ তাঁদের কেনা গোলাম বলে মনে করেন’
‘‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পীদের হেনস্থার কথা জেনে খুব খারাপ লাগছে। ওঁরাই তো আমাদের অনুজ। আগামী। আমাদের সময় শ্রোতারা বলতেন এই গান নয়, অমুক গান করুন। এই পর্যন্তই। মান্নাদা, রফিজি, মুকেশজি কত অনুষ্ঠান করেছেন। রবীন্দ্রসরোবরে লতাজি এলেন। এমনকি, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াও খোলা মঞ্চে গেয়েছেন। আমার মনে হয়, শুধু শ্রোতা নয়। শিল্পীদের একটু দায়িত্ব নিতে হবে। কম কথা বলা। কথায় শালীনতা। পোশাকে ডিগনিটি। যা বলার অ্যাঙ্কার বলুন। গানের সময় এত কথা কেন? আর ফেসবুকে ব্যক্তিজীবন মেলে না ধরলেই ভাল,’’অভিজ্ঞতার স্বর বেজে উঠল সুদূর আরব সাগর থেকে। ফোনের ও পারে আরতি মুখোপাধ্যায়।
হেনস্থার ঘটনার পর ইমন পাশে পেয়েছেন এই শিল্পীদের।
বাইরে অনুষ্ঠান থাকলে মনখারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে থাকলে শান্তিতে থাকেন তিনি। মনোময় ভট্টাচার্য।‘‘আমায় একজন আয়োজক বলেছিলেন, দাদা, টুপি পরে মঞ্চে উঠবেন না। আপনার গানের সময় মাথার ওপর লাইটিং হবে। ধোঁয়া উঠবে। টুপি পরলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। টুপি পরলে টাকা ফেরত দিন।’’বললেন মনোময়।
অগত্যা ঠান্ডা লাগলেও টুপি না পরেই অনুষ্ঠান করেছিলেন মনোময়। শ্রোতা আর শিল্পীর মধ্যে আগে ফারাক ছিল। শিল্পীদের জন্য মঞ্চ ছিল। আজ সেই ব্যবধান ঘুচে গেছে। এই প্রসঙ্গে যোগ করলেন মনোময়, ‘‘আমি রাতে একটা অনুষ্ঠানে গান গাইছি, মঞ্চে একজন মাতাল উঠে নাচছে। আর বারংবার বলছে,‘দাদা গান তো খুব ভাল, কিন্তু আপনি পাঞ্জাবি পরেননি কেন?’’
এরকম দুঃসহ পরিস্থিতিতে শিল্পীরা গান গাইতে যান। ‘‘কিছু করার তো নেই, ওটাই আমাদের ব্রেড অ্যান্ড বাটার,’’বললেন ইমন।অন্য দিকে আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী বলছেন, ‘‘শিল্পীরা একজোট হয়ে কোথাও দরবার করুক, এরকম হেনস্থা চলবে না।’’
‘‘এ দেশে স্টেজক্রাফ্ট তো আর হাতে ধরে শেখানো হয় না। আমরা সঙ্গীত পরিচালক, সুরকারদের পরামর্শেই চলতাম। বাধ্য ছিলাম।’’স্মৃতি হাতড়ালেন আরতি মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ‘আমারও আফশোস রয়েছে’, কী নিয়ে মুখ খুললেন করিনা?
শুধু শিল্পী বা শ্রোতা নয়।সার্বিক ক্ষতির জায়গা থেকে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্রর মনে হয়েছে, ‘‘ভারতের মতো দেশে আমরা মানুষকে শিক্ষিত করতে পারলাম না। তাই এই অবস্থা। ’৮৩-তে সলিল চৌধুরী, সবিতা চৌধুরীর সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে গেছি। আয়োজকদের ক্ষোভ, তাঁরা সলিল চৌধুরী-সহ আমাদের সারা রাত আটকে রাখলেন। মদ্যপ অবস্থায় হুমকিও দিলেন। সেই ধারা চলছে। আসলে শিল্পী বলতে যা যা বোঝায় তার সঙ্গে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কোনও সম্পর্ক নেই। আজও মুজরোকে সম্মানের চোখে দেখা হয় না। যে মানুষ আজ মেয়েদের মুখ অ্যাসিড ছুড়ে জ্বালিয়ে দেয় সেই মানুষই শিল্পীদের সঙ্গে অমন ব্যবহার করে।’’
শিল্পী আর শ্রোতার সুরের বাঁধন ক্রমশ আলগা হচ্ছে। ‘‘আমি পয়সা দিয়েছি। তাই যা খুশি করব। সিনেমা হলে গিয়ে ফোন করব। কোনও শিল্পের ওপর আর সম্মান নেই। আর শিল্পী-শ্রোতার মাঝে যে সিকিওরিটির প্রশ্ন উঠছে এটা খুব দুঃখের। লোপা, আমার বন্ধুবান্ধবেরা কত দূরে শো করতে যায়। এখন বেশ দুশ্চিন্তার জায়গায় চলে যাচ্ছে বিষয়টা। আমি গত পনেরো বছর গিটার বাজিয়েছি মঞ্চে, এরকম দিন আসবে ভাবিনি,’’চিন্তিত সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার জয় সরকার।
শিল্পীরা বাইরের অনুষ্ঠান নিয়ে কুণ্ঠিত। কেউ ভাবছেন, এ বার কি বেছে বেছে অনুষ্ঠান করবেন? কেউ ভয় পাচ্ছেন, শ্রোতারা কেমন করে চড়াও হবেন এই ভেবে। কেউ প্রশাসনের কাছে যাবেন ভাবছেন। কেউ চুপ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy