Advertisement
E-Paper

সুরের পাহাড়

সারা ভারত যখন গরমে জ্বলছে তখন তিনি একশো দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হিমালয়ের ঠান্ডায়।শান্তনু মৈত্র-র সেই কাহিনি শুনলেন সংযুক্তা বসু আজ আমার র‌্যাঞ্চোর কথা খুব মনে পড়ছে। ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির র‌্যাঞ্চো যে কিনা তার শেষ ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল প্রকৃতির মাঝখানে। আমিও তো আজ সেই হিমালয়ের কোলে...ঠিক র‌্যাঞ্চোর মতোই...হারিয়ে যেতে চাইছি।

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০১:৩৫

আজ আমার র‌্যাঞ্চোর কথা খুব মনে পড়ছে। ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির র‌্যাঞ্চো যে কিনা তার শেষ ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল প্রকৃতির মাঝখানে। আমিও তো আজ সেই হিমালয়ের কোলে...ঠিক র‌্যাঞ্চোর মতোই...হারিয়ে যেতে চাইছি। কোথায় যেন গান বাজছে…

‘বহেতি হাওয়া সা থা ও

উড়তি পতঙ্গ সা থা ও

কহাঁ গয়া উসে ঢুঁঢো।’

সুরের খোঁজে

সমতল থেকে সাড়ে ষোলো হাজার ফুট ওপরে লাদাখের এক নির্জন জায়গা।

সেখানেই বিরাট এক মালভূমি। মেঘ আর কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারপাশ। একপাল চমরি গাই চরে বেড়াচ্ছে মালভূমির সবুজ প্রান্তরে। তাদের চরাচ্ছে যে রাখাল তার গলায় অদ্ভুত এক সুর। সেই সুরের নিশানা মেনেই চমরি গাইরা চরে বেড়াচ্ছে। রাখালের সুর যদি থেমে যায় তারা গড়িয়ে পড়তে পারে অতল খাদে। হাই ফ্রিকোয়েন্সির সেই সুর শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। এ ভাবেই একশো দিন ধরে হিমালয় ভ্রমণ করব আমরা। একশো দিনের মধ্যে ২৬ দিনের ভ্রমণ শেষ হয়েছে। ভ্রমণের শেষে পাহাড়ের এই সব সুর আমার কাছে রয়ে যাবে। ওই চমরি গাই চরানো রাখালের সুর থেকেই হয়তো সৃষ্টি করব নতুন কোনও সুর।

আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা

সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখেই আমার হিমালয় সম্পর্কে একটা টান জন্মেছিল কৈশোর থেকেই।

সেই কাঞ্চনজঙ্ঘাকেই খুঁজে পেলাম এ বার সান্দাকফু বেড়াতে গিয়ে। বেড়ানো বললে ভুল বলা হবে। এ হল এক অভিযান। একশো দিন ধরে হিমালয়ে ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে আমি আর আমার বন্ধু ধৃতিমান মুখোপাধ্যায় বেড়িয়ে চলেছি গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। একশো দিনের মধ্যে পঁচিশ দিন পার হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি ধৃতিমান হল বিশ্বের সেরা তিন জন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফারের মধ্যে এক জন। যার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বিশ্বের সেরা অরণ্যরাজি আর পাহাড়ের সুবিশাল নিস্তব্ধ রূপ।

কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে সান্দাকফুতেই দেখা হয়েছিল নেপালি ড্রাইভার সঞ্জিতের সঙ্গে। সারাদিন সে গাড়ি চালায়। আর রাত হলে গান ধরে। নেপালি সুরের গান গায় গিটার বাজিয়ে। গরিব সঞ্জিত খুব সস্তায় ওই গিটারটা কিনেছে। ওর গানের সুর এখনও কানে লেগে আছে। রেকর্ডও করে এনেছি।

বেশ কিছু দিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল নিজের ভেতরে যে সুর আছে তা বের করে চলেছি। কিন্তু নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য কিছুই গ্রহণ করছি না প্রকৃতি বা বিশ্বচরাচর থেকে। সেই জন্যেই এই বেরিয়ে পড়া। সিনেমার সুর দেওয়া কিংবা রিয়্যালিটি শোয়ে বিচারক হওয়া আমাকে আর তৃপ্তি দিচ্ছিল না। বেরিয়ে পড়লাম নিজের সৃষ্টির জগৎ থেকে। ইতিমধ্যে লাদাখ এবং উত্তর বাংলা ঘোরা হয়ে গিয়েছে। এখনও যেতে বাকি লাহুল-স্পিতি, উত্তরাখণ্ড, নেপালের আরও অনেক জায়গা, ভূটান, অরুণাচল প্রদেশ, তিব্বত। একশো দিনের এই ভ্রমণ শেষ হলে আমাদের কাছে জমা হবে হিমালয়ের অজস্র ছবি, অগুনতি সুর। প্রতিবারই পাহাড় থেকে ফিরে আমি ওয়েবসাইটে, ইন্সটাগ্রামে, ফেসবুকে পাহাড়ের সেই অনির্বচনীয় রূপের কথা লিখছি। আর চেষ্টা করছি মানুষকে পাহাড়ের প্রতি আকৃষ্ট করার ।

যেখানে সুরের উত্তাপে ঠান্ডা কমে যায়

আমরা যারা শহরে থাকি তাঁদের বেশির ভাগের কাছে হিমালয় মানে বরফে ঢাকা এক বিশাল পাহাড়। বড়জোর হিমালয় মানে কার্গিলের যুদ্ধ বা উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু রাজনৈতিক অস্থিরতা। কিংবা হিমালয় মানে মাঝে মাঝে সুন্দর হিল-স্টেশনে বেড়াতে যাওয়া। এর চেয়ে গভীরে যান আর ক’জন?

ভারতবর্ষের মুকুটের মতো এই হিমালয়।

হিমালয় যদি সরে যায় দেশটার চেহারা হবে মুকুটহীন রাজার মতো। রামায়ণ আর মহাভারতে অনেক নদীর কথা পাওয়া যায়। নদীর ধারে এক ধরনের সুরের চর্চা হয়। মূলত সাত সুরই তার সম্পদ। কিন্তু পাহাড়ে বা হিমালয়ে কোথাও রয়েছে পাঁচ স্বরের ব্যবহার, কোথাও বা রয়েছে একটিই স্বর। হিমালয়ের আনাচে কানাচে কত গান। কত রকম তার সুর। প্রত্যেক ৫০ কিলোমিটার অন্তর এখানে মানুষের জীবনধারা পাল্টে যায়, পাল্টে যায় মুখের ভাষা। পাল্টে যায় গানের সুরের ধরন।

একদিন ভোরবেলা লাদাখের এক মঠে শুনলাম এক স্বরের ব্যবহারে বারোজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রার্থনা করছেন। সেই গান শুনতে শুনতে আমার আর ধৃতিমানের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও গরম লাগতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে এক সন্ন্যাসী বললেন, ‘‘কী! আপনাদের গরম লাগছে? এই মন্ত্রের সুর শুধু প্রার্থনা নয়, আমরা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার জন্য গেয়ে থাকি। এই এক স্বরের মন্ত্র উচ্চারণ করলে ঠান্ডা কম লাগে।’’ আমরা অবাক হয়ে গেলাম। তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিলেন শুনেছিলাম। কিন্তু এ তো দেখছি সত্যি গান গেয়ে হিমশীতল প্রকৃতির মাঝখানে উষ্ণতা জাগিয়ে তোলা।

হিমালয়ে এলে ‘থ্রি ইডিয়টস’য়ের র‌্যাঞ্চোর কথা খুব মনে পড়ে

কেন বেরিয়ে পড়লাম

পাহাড়ের মানুষের জীবন দর্শনও যেন আলাদা। লাদাখের ছাংপা আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে দেখলাম কী আশ্চর্য তাঁদের সহিষ্ণুতা। ভোরবেলা ওই গ্রামে গিয়ে দেখি মানুষজন শোকে মুষড়ে পড়েছে। সবাই নীরব। কারণ আগের দিন রাতে একটা স্নো-লেপার্ড এসে তাঁদের পাঁচটা ভেড়াকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু অবাক হলাম দেখে কেউ স্নো-লেপার্ডের প্রতি কোনও ভাবে রুষ্ট নয়।

বন্য প্রাণীর দুনিয়াতে স্নো লেপার্ডকে ঈশ্বর বলে মানা হয়। সারা পৃথিবীতে স্নো লেপার্ডের ছবি তোলার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। সেই স্নো-লেপার্ড পাঁচটা ভেড়াকে মেরে ফেলেছে দেখেও গ্রামবাসীরা এতটুকু বিরক্ত নন! কেন? তার উত্তরে এক গ্রামবাসী বললেন, ‘‘ওর খিদে পেয়েছিল, ও খেয়েছে। আমরা তো ওর বাড়িতেই, ওর আশ্রয়ে থাকি। অকারণে কেন স্নো লেপার্ডের ওপর রেগে যাব?’’ প্রতিকূল প্রকৃতি ও হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে এই ভাবেই সহাবস্থান করে চলেছে যুগযুগান্ত ধরে পাহাড়ের মানুষজন। এই অসহিষ্ণুতার সময়ে ওঁদের সহিষ্ণুতা দেখে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

হিমালয়ের কোলে যাওয়া মানে প্রতিপদেই বিস্ময়। মানুষের চিন্তা ভাবনারও যে কত রকম বৈচিত্র। দ্রাসে গিয়ে আলাপ হল বিহারের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, যিনি মাইনাস থার্টি ডিগ্রিতে ভোরবেলায় বিরিয়ানি বিক্রি করেন। আমরা ভোরবেলা সেই গরম গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি খেয়ে উত্তপ্ত বোধ করলাম। আসল কথা মাইনাস থার্টি ডিগ্রিতে শরীর গরম রাখতে হলে অ্যানিম্যাল প্রোটিনই খেতে হবে। সাদামাঠা পাউরুটি ডিমসেদ্ধ খেলে হবে না। তাই ওখানকার লোকেরা ভোরবেলা উঠে চিকেন বা মাটন বিরিয়ানিই খান। আমরাও খেয়ে স্বস্তি বোধ করছিলাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে ঘুর ঘুর করতে লাগল। কেন বিহার থেকে ওই ভদ্রলোক এতটা পথ উজিয়ে এসে বিরিয়ানি বিক্রি করছেন? জানলাম, ওই ভদ্রলোক প্রথমত ঠান্ডা জায়গাতেই নিজের রুটিরুজির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, চেয়েছিলেন এমন এক জায়গায় বাসা বাঁধতে যেখানে পোকামাকড়ের উপদ্রব নেই। তৃতীয়ত, ওঁর ইচ্ছা ছিল এমন জায়গায় বসত করা যেখানে মানুষজন সরল প্রকৃতির। এই সবই তিনি একসঙ্গে পেয়েছেন দ্রাসে এসে।

তেনজিং নোরগের লাইভ কমেন্ট্রি

হিমালয়ের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ভ্রমণ মানে ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্যবদল, জীবন ধারা বদল। বিজ্ঞানের, প্রযুক্তির প্রবেশ নেই সেই সমস্ত জায়গায়। মানুষে মানুষে সম্পর্কই সেখানে সব চেয়ে বড় কথা।

হিমালয়কে খুঁজতে গিয়ে আমার বারবার মনে পড়ছে তেনজিং নোরগের কথা। বাবার মুখে শুনেছিলাম যে দিন তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিলেন সেদিন রেডিওতে লাইভ কমেন্ট্রি হয়েছিল। সেই গল্প আমার হিমালয়ের প্রতি টান জাগিয়ে তুলেছে বারবার। দিল্লির বাঙালি পাড়ায় থাকতাম। ভ্রমণবিলাসী বাঙালিরা প্রায়ই পাহাড়ে যান। আমিও ওঁদের দ্বারা কত বার প্রভাবিত হয়েছি।

একশো দিনের হিমালয় ভ্রমণের এই পরিকল্পনাটা করতে কি দেরি হয়ে গেল? এই প্রশ্নটা একবার গুলজারজিকে করেছিলাম। উনি বলেছিলেন, ‘‘দেরি হয়নি মোটেই। বরং আগে গেলে মনটা পরিণত হত না। এখনকার এই যাত্রার মধ্যে আছে পরিণত বোধ।’’

আজকের চোখ দিয়ে যে হিমালয়কে দেখছি তার রূপ, আজ থেকে দশ বছর আগে যে হিমালয়কে দেখেছি তার চেয়ে অনেক আলাদা। এই দেখার মধ্যে এক ধরনের পূর্ণতাবোধ আছে যেটা আগে হয়তো ছিল না। আর এই পূর্ণতা বোধ আমার মধ্যে জাগিয়ে তুলল হিমালয়ই।

3 idiots Shantanu Moitra Interview
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy