Advertisement
E-Paper

মুভি রিভিউ: নগরকীর্তন উলঙ্গ এক রাজার গল্প

গল্প দুই মানুষকে ঘিরে। মধু (ঋত্বিক চক্রবর্তী) পরিমল-পরি-পুটি( ঋদ্ধি সেন)। আপাদমস্তক পুরুষ ঋত্বিকের সঙ্গে চেহারায় পুরুষ মনে নারী ঋদ্ধির ভালবাসা।

আমাদের শ্যাওলা ধরা শিকড়ে আজও মনের প্রেম আছে।

আমাদের শ্যাওলা ধরা শিকড়ে আজও মনের প্রেম আছে।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:০৫
Share
Save

রাজা উলঙ্গ।
তার কাপড় খুলে তাকে রাস্তায় এনে তামাশা লুটছে মানুষ। অশিক্ষা। সংস্কার আর শিক্ষিত সমাজ।

সে ভালবাসার কাঙাল। এমন এক ভালবাসা যা মনের টানে শরীর বদলে ফেলার সাহস নিয়ে ঘোরে।
এ রকম হয় নাকি?
ছেলে ছেলে প্রেম?
আসলে কি ছেলে-ছেলে? নাকি মন?
'পুরুষ শরীরের খাঁচায় বন্দী নারীর মন'।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। আরেকটি প্রেমের গল্পের মোড়কে রূপান্তরকামীর আখর সাজালেন কীর্তনের সুরে।

গল্প দুই মানুষকে ঘিরে। মধু (ঋত্বিক চক্রবর্তী) পরিমল-পরি-পুটি( ঋদ্ধি সেন)। আপাদমস্তক পুরুষ ঋত্বিকের সঙ্গে চেহারায় পুরুষ মনে নারী ঋদ্ধির ভালবাসা।
মন ঘেঁষে থাকা দুই শরীর একদিন হাড়ির গরম জলের মতো ফুটতে থাকে। ফুটে বেরোতে চায় পরিমল-মানবী হয়ে।
ছোটো ছোটো ঘটনায় ছবি নিজস্ব সুরে নদীর মতো বইতে থাকে। ছবির সুরের একটাই নাম 'কীর্তন'। সঙ্গীত পরিচালক প্রবুদ্ধ সুরে সুরে সুর মিলিয়েছেন।

ছবিতে মধুর সঙ্গে ভাব জমিয়ে পুঁটি আসে নবদ্বীপে মধুর বাড়িতে। সেখানে তার বৌদিকে ( বিদীপ্তা চক্রবর্তী) ব্লাউজ বদল করে শাড়ি পরতে দেখে পুঁটি। পুঁটির সেই অন্য নারী শরীর দেখার মধ্যে কী অপার বিস্ময়। চোখ ছলছলিয়ে ওঠে তার। পুটির প্যাডেড ব্রা পরা কৃত্রিম শরীর তো ওই অকৃত্রিম নারী শরীরের পিয়াসী। রাধিকা অঙ্গে তবেই তো সঙ্গ করে সঙ্গীকে তৃপ্ত করবে সে!অল্প সময়ে ভাল লাগে বিদীপ্তাকে।

আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ ‘ভবিষ্যতের ভূত’: শাসকের দিকে আঙুল তুলে মানুষ ভূতে বিলীন হয়েছে

পুঁটির শরীর বদলের এই ধারাকে কেবলমাত্র কিছু ঘটনা দিয়ে বলে যাননি কৌশিক। বাংলার কীর্তনের মধ্যে খুঁজেছেন পাগলিনী রাধা-প্রেম ভাব। যে বাঁশির সুর প্রেমের জন্ম দেয় আবার ঘর ছাড়াও করে। যে প্রেম আগুনে পোড়ার ভয়ে সামনে আসে না। ইতিহাসকে পুঁটির শরীরের মধ্যে দিয়ে ভাঙতে ভাঙতে গিয়েছেন কৌশিক। কৈশোরে ভালবাসার মানুষ সুভাষদার (ইন্দ্রাশিস) কাছ থেকে প্রথম আঘাত পায় পুঁটি। নদীর পাড়ে দুজনে মিলে যে স্বপ্ন তারা দেখেছিল পুঁটির দিদিকে বিয়ে করে সুভাষদা পুঁটিকে ঘরছাড়া করে। প্রশ্ন না করেও প্রশ্ন রেখে যান কৌশিক।
যে পুরুষ নারী ভাবে বিভোর, খুব সহজেই তাকে বুঝি ঠকানো যায়!

আবার 'মধুদা'-র সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায় পুটি। পৌঁছয় কৃষ্ণনগরের উইমেনস কলেজের প্রিন্সিপাল মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বাস্তবের রাস্তায় একটু একটু করে ইতিহাসের পর্দা উন্মোচিত হয়। শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণপ্রেমে পাগল ছিলেন। তাঁর রাধা ভাব তাঁকে ঘরছাড়া করে। তিনি চলার পথে সোহাগ খুঁজে ফেরেন। ঘরছাড়া তো পরিমল ও। মধুদার মধ্যে প্রেম দেখে সে।
শরীরে পুরুষ মনে নারী তাই 'অন্য' কিছু নয়। 'অস্বাভাবিক' কিছু নয়। কৌশিক যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা বোঝাতে চেয়েছেন দর্শকদের। নিজেদের অপ্রয়োজনীয় এবং অযাচিত পুরুষাঙ্গ নিয়ে লজ্জিত থাকে এই নারী ভাবের পুরুষ!


ছবির দৃশ্যে ঋদ্ধি।

বাস্তবের অভিজ্ঞতা দিয়ে এ ছবিতে কয়েকজন বৃহন্নলার অভিনয় মনে রাখার মতো। ছবিতে পুঁটিকে জোর করে একদল হিজড়ে রাস্তায় নগ্ন করে তার ওপর অত্যাচার চালায়। দোলের দিনের সেই দৃশ্যে পরিচালক পুঁটির ওপরে নীল রঙ ঢেলে দিয়ে তার অপমান, কান্না হাহাকারকে কৃষ্ণরূপে এঁকে থমকে দেন দর্শকদের। রঙ দিয়ে অনেক না বলা কথা বলা যায় যে! শীর্ষ রায়কে এ ছবিতে নতুন করে চেনা যায়।
এ ছবি দেখতে দেখতে কেউ নড়ে না। বাজে না মোবাইল ফোন। আসলে ঋদ্ধি সেনের থেকে চোখ ফেরানো যায় না। যদি লিখি তিনি দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন তা হলে কম বলা হয়। এ ছবিতে তো কোনও একটা চরিত্র নয়। কখনও পরিমল। কখনও পরি। কখনও পুঁটি। মানুষের এক জীবনের এক মুখের এতো ভাঙন কী সাবলীল দক্ষতায় দর্শকদের সামনে তুলে ধরলেন ঋদ্ধি সেন।ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হলো বেশ কিছুদিন আগে হিন্দি ছবিতে শাহরুখ খানকে বামনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখে তার ভক্ত থেকে সাধারণ দর্শক কেউ তা মেনে নিতে পারেননি। বামনের চরিত্রের মতো পুরুষ অভিনেতার নারী সাজের চরিত্র করার মধ্যেও দর্শকদের গ্রহণ করার একটা জায়গা থাকে। ঋদ্ধিকে শাড়ি পরে, বিনুনি আর টিপ-সহ প্রথম থেকেই চমৎকার লাগে। তার চরিত্রের লাস্য, কামনা, বিরোধ, তীব্র মৃত্যুময় নীলচে শূন্যতা আমার বা আমাদের কাছ থেকে দেখা অনেক মানুষের অদেখা যন্ত্রণাকে সামনে নিয়ে এলো। বুকের ভেতর কোথাও যেন বিস্ময়ের মনখারাপ! কই এই মানুষগুলোর হাহাকার তো বুঝেই উঠতে পারিনি আমরা।

আরও পড়ুন, কাটল আইনি জটিলতা, ‘নগরকীর্তন’-এর মুক্তি ২২ ফেব্রুয়ারি

আজও যেমন বুঝে ওঠা যায় না ঋত্বিক চক্রবর্তীর অভিনয়ের সীমানা। একজন প্রেমিক পুরুষ হয়ে এই 'নগরকীর্তনে' আর এক পুরুষ দেহের নারীকে যে ভাবে তিনি স্পর্শ করেন। আগলে রাখেন। যত্ন করেন..
.ভালবাসেন...সমাজের সঙ্গে লড়াই করেন... আর তারপর? থাক!
বাংলা ছবির সব দর্শক বরং ছবিটা প্রেক্ষাগৃহে দেখুন গিয়ে।
দেখবেন আমাদের শ্যাওলা ধরা শিকড়ে আজও মনের প্রেম আছে। সবটাই শুধু শরীরের নয়। মনের জন্য কোথাও শরীর কাছে আসে।
বুঝবেন নিজের মতো করে কেউ তথাকথিত সামাজিক হিসেবের বাইরে বেরোতে চাইলে সমাজ তাকে রাস্তায় আনে। উলঙ্গ করে তার মজা লোটে। যে পুঁটি হাততালি দিয়ে বাধ্য হয়েছিল পেটের ভাত জোগাড় করতে সেই পুঁটিকে উলঙ্গ করে রাস্তায় কিছু মানুষ হাততালি দেয়।

জানবেন অপূর্ণ প্রেম ইতিহাসে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও তার চিহ্ন রেখে যায়। বলে যায়, আমরা পারিনি। কিন্তু পরের সময় করে দেখাবে। সেই কারণেই মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় এই জনমেই নিজের রূপান্তর ঘটান। তৈরি হয় আরও মানবী।
আর তাই মানুষ দেখে যাকে উলঙ্গ করে পথে নামানো হল সে আসলে নারী বা পুরুষ নয়! সে রাজা!
সমস্ত হাততালি আর তামাশার উর্দ্ধে সে নির্ভীক স্বর।
মন তার শরীরজমিন।

(সিনেমার প্রথম ঝলক থেকে টাটকা ফিল্ম সমালোচনা - রুপোলি পর্দার বাছাই করা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদনের সব খবর বিভাগ।)

Movie Review Film Review Nagarkirtan নগরকীর্তন Tollywood Celebrities মুভি রিভিউ Kaushik Ganguly Riddhi Sen Ritwick Chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy