Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Entertainment News

মুভি রিভিউ ‘শাহজাহান রিজেন্সি’: ‘চৌরঙ্গী’র অনুচ্চারিত সত্য বার হয়ে আসে এখানে

অভিনয়ে এখানে উতরে গেছেন সকলেই। অঞ্জন দত্ত, পরমব্রত, আবীর, স্বস্তিকা, অনির্বাণ। তবে একটা কথা বলা দরকার, শাহজাহান রিজেন্সির প্রথম দিকের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে দৃশ্যায়নের কাজ বড্ড একমাত্রিক।

সৃজিতের ছবির একটা মজা হল, বাঙালিত্বের এমন কিছু নিজস্ব রেফারেন্স সেখানে থাকে যা খাঁটি বাঙালি না হলে উপভোগ্য হয়ে ওঠে না।

সৃজিতের ছবির একটা মজা হল, বাঙালিত্বের এমন কিছু নিজস্ব রেফারেন্স সেখানে থাকে যা খাঁটি বাঙালি না হলে উপভোগ্য হয়ে ওঠে না।

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ১৫:২৩
Share: Save:

পরিচালক: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনেতা: অঞ্জন দত্ত, মমতা শংকর, আবির চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

কেন ‘নায়ক’? কেন ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’? কেন ‘সন্ন্যাসী রাজা’? কেন ‘চৌরঙ্গী’? কেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় সেই ২০১০ থেকে আজ অবধি, একের পর এক উত্তমকুমারের সেরা ছবিগুলোকে নতুন চেহারা দিয়ে, মুখে নতুন ভাষা দিয়ে আমাদের সামনে ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনছেন, কান না পাতলেও দেখবেন এই প্রশ্নটা শহরের আকাশে বাতাসে হামেশাই ভেসে বেড়ায়। ভেসে বেড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার বহু মানুষের আলো জ্বলে থাকা টাইমলাইনে।

কেন? কেন? এই প্রশ্ন যারা করে তারা সবাই যে সিনেমা খায়, সিনেমা মাথায় দেয়, সিনেমার জন্য বাঁচে-মরে, ব্যাপারটা তেমন না। কিন্তু কম বোদ্ধা বা বেশি বোদ্ধা, সবারই সৃজিতের এই ‘উত্তম-ক্লাসিক’-এর প্রতি প্রগাঢ় দুর্বলতা সম্পর্কে কৌতূহল আছে। আমারও আছে, এবং এই প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা ছিল না। কিন্তু এই কেন, কেন করতে করতে শঙ্করের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’ অবলম্বনে ১৯৬৮-তে নির্মিত উত্তমকুমারের ব্যাপক সফল ছবি ‘চৌরঙ্গী’র রিমেক ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ যখন সৃজিত মুখোপাধ্যায় বানিয়ে ফেললেন তখন সেই ছবি দেখতে গিয়ে ‘চৌরঙ্গী’র অন্তরাত্মাটাকে এক রেখে পরতে পরতে তিনি চিত্রনাট্যে যে রদবদলগুলো ঘটালেন, তা-ই সটান ওই কেন’র উত্তর হিসেবে এই সমালোচকের চোখের সামনে উঠে এল।

সৃজিতের ছবির একটা মজা হল, বাঙালিত্বের এমন কিছু নিজস্ব রেফারেন্স সেখানে থাকে যা খাঁটি বাঙালি না হলে উপভোগ্য হয়ে ওঠে না। ছবি শুরু হয় লীলা মজুমদারকে কোট করে, ‘এখানে (এই শহর কলকাতায়) জায়গারও ভূত আছে।’ আসলে কলকাতা নিজস্ব নিয়মেই একটা ভূতগ্রস্ত শহর। শুধু এখানে সময় একটা আলাদা চরিত্র যা কখনও প্রাণ পায়, কখনও জ্বলে উঠতে গিয়ে নিভে যায়। চিহ্নগুলো বদলায় শুধু সময়ের। বাকি সব এক থাকে। সৃজিত সম্ভবত এই বদলটাকেই বার বার তুলে আনতে চেষ্টা করছেন তাঁর ‘অটোগ্রাফ’ থেকে শুরু হওয়া জার্নিটার মধ্যে। সেই কারণেই শাহজাহান রিজেন্সিতে আপনি সেই বিস্ময় আর ঘোরের মধ্যে হোটেলে চাকরি নিয়ে রোজির জায়গা দখল করা শঙ্করকে পাবেন না। আপনি পর্তুগিজ ম্যানেজার মার্কোকে পাবেন না।

আরও পড়ুন, ‘উরি’ দেখাল ইতিহাস লেখেন সত্য নায়করাই...

এবং হাত দিয়ে বুক চেপে ধরুন, কারণ দুঃখের বিষয়, ‘চৌরঙ্গী’র রিমেকে আপনার সবচেয়ে পছন্দের ফ্রন্ট অফিস ম্যানেজার ‘স্যাটা বোস’ ভদ্রলোকটিও প্রকৃতপক্ষে মিসিং। আসলে পাঁচতারা হোটেলের রিসেপশনেও তো এখন আর ক্যালেন্ডার ঝোলে না। নিউ মার্কেট এলাকায় এখন আর ঘুরে বেড়ায় না ভাঙা ভাঙা বাংলা বলা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। ’৬০-এর দশকের হোটেলের লবিতে চুরুট খাওয়া, কোট-টাই পরা বিদেশিরাও এখন অমিল। এখন তারা প্লেন থেকে নেমে আসে আরমানির ট্র্যাক বটম আর জ্যাকেট পরে, সেই পোশাকেই চেক ইন করে। এখন মিস শেফালির ক্যাবারে নেই। মার্টিনিতে চুমুক দিতে দিতে ক্যাবারে দেখতে আসা অভিজাত বাঙালিও হারিয়ে গেছে চৌরঙ্গি আর পার্ক স্ট্রিট থেকে। চারিদিকে শুধু গাদাগাদা কেজো মুখ। ভাঙনের সমীকরণে সৃজিতের শাহজাহান রিজেন্সির ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি মালিক মরকন্দ পাল স্বয়ং একটা ভগ্নস্তূপ। যাঁর শেষ পরিণতি অধিকাংশ বাঙালি প্রতিষ্ঠানের মতো সব বেচেবুচে দূরে কোথাও সরে যাওয়া।

আরও পড়ুন, শেষের চমকেই বাজিমাত বিজয়া, গণেশকে দর্শক মনে রাখবেন

তাই শঙ্করের আধুনিক সংস্করণ অনেক সপ্রতিভ, অনেক ঠোঁট কাটা, স্মার্ট না হলেও হাবাগোবা নয়। এবং সর্বোপরি সে এই যুগের এক জন অতি সাধারণ যুবক। যে এমনকি, নিজের কৌতূহলকে দমন করার চেষ্টাটাও করে না। সেই জন্যই সব যখন বদলে যায়, পুরনো সমস্ত মানুষ যখন ছেড়ে চলে যায়, হোটেল হাত বদল হয়ে যায়, ওরিয়েন্টাল স্টাইল পাল্টে ফেলে আমেরিকান জাঁকজমক এসে জায়গা দখল করে, তখন সে-ই একমাত্র টিকে থাকতে পারে এই পরিবর্তনের পরিবেশে, কারণ তার টিকে থাকার পেছনে তার নিজেরই কোনও শর্ত ছিল না। এখানে রুদ্র নামের শঙ্কর ঠিক এই সময়েরই এক জন গড়পড়তা যুবক যার আবেগ চেপে রেখে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকার ক্ষমতাটাই প্রধান। আসলে প্রবল বৈচিত্র্য আর বৈশিষ্ট্যের চরিত্রগুলো, বিশেষ রকম মুদ্রাদোষ আর বিশেষ শরীরী ভাষাময় একটা একটা ক্যারেক্টারকে তাদের সব স্পেশালিটিগুলো খুলে দিয়ে, এক রকম ফ্ল্যাট আর আকর্ষণবিহীন করে হাজির করেছেন সৃজিত এই ছবিতে। ক্লোজ শটে মুখের রেখায় রেখায় যে অভিনয় ধরা পরে সে অভিনয় এখানে কম। ফলে স্যাটা বোস, যে কি না এখানে সমীরণ, পর্দায় তার ইন্ট্রোডাকশনটাও হয় যথেষ্ট চমক ছাড়া। শুধু করবী গুহর আধুনিক রূপ কমলিনী গুহ ঠিক এখনকার মতোই ভয়ঙ্কর প্রখর। এখানেই বলে রাখা ভাল যে স্বস্তিকার পর্দা উপস্থিতি এই ছবির অনিবার্য প্রহেলিকা।


স্বস্তিকার পর্দা উপস্থিতি এই ছবির অনিবার্য প্রহেলিকা।

আসলে পাঁচতারা হোটেল গুলোর আলো, আঁধারি, গ্ল্যামার কোশেন্ট, রহস্যময়তা সেই ‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’ গানটার মতোই আগেও আমাদের আচ্ছন্ন করত, এখনও করে। চৌরঙ্গী ছবিটার সঙ্গে শাহজাহান রিজেন্সির পার্থক্যটা এখানেই যে, যে কথাগুলো সেই ’৬০-এর দশকে শুধুমাত্র ইঙ্গিতেই পরিবেশিত হত তা এখন সপাটে উচ্চারিত হয়। যেমন, মার্কো কেন ডিটেকটিভ লাগিয়েছিল তা আমরা কখনও জানতে পারি না। যদিও এখানে সৃজিতের তৈরি প্লটটা আমার একটু দুর্বল লেগেছে, তবুও বলতেই হয় যে হোটেল মালিক মকরন্দ পালের জীবনও এই সময়ের মতো কোন প্রাইভেসির ধার ধারে না। এখানে তার তুচ্ছ কর্মচারীও তার যাবতীয় বিপর্যয়ের সাক্ষী। কারণ লার্জার দ্যান লাইফ বলে এই সময়েই তেমন কিছু হয় না। তাই স্যাটা বোস এখানে এত সাদামাটা। তাই কমলিনী গুহ নিজের হোস্টেস স্ট্যাটাসটাকে নষ্ট মেয়ে হিসেবে অনায়াসে জাহির করে। চৌরঙ্গীর অনুচ্চারিত সব সত্যি এখানে বের হয়ে আসে।

সে কারণেই ছবিতে সেই নাটকও আমরা দেখতে পাই যেখানে কমলিনী গুহ একটা রাত গেস্টের সঙ্গে শুতে চাইছে না কিন্তু ধেনো চ্যাটার্জি তার গলা টিপে ধরে তাকে বাধ্য করছে গেস্টকে এন্টারটেন করতে। এখানে আড়াল কম। রাখঢাক নেই। চৌরঙ্গীতে বিশ্বজিৎকে আমরা দেখেছিলাম অনিন্দ্য পাকড়াশির চরিত্রে। শান্ত, ভদ্র, মিষ্টি ব্যবহার। মায়ের অনুগত। এখানে অনিন্দ্য পাকড়াশির নাম অর্ণব সরকার। তুলনায় অনেক স্মার্ট। অনেক অ্যাগ্রেসিভ। যে প্রথম আলাপেই কমলিনীকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আপনি এই পেশায় কেন? আর কি কিছু করার ছিল না?’’ ফলে কমলিনীর চরম পরিণামের পরও তার জীবনে ‘মুভ অন’ করে যাওয়াটা এই সময়টার মতোই আড়ম্বরহীন ও অতি স্বাভাবিক। এই সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অদলবদলগুলোই আসলে ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে শাহজাহান রিজেন্সি বানানোর প্রয়োজনীয় কারণ। সৃজিত কেন ‘অটোগ্রাফ’ বানান, কেন ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ বানান তার উত্তরগুলো ধরা আছে এখানেই।

আরও পড়ুন, ‘সিম্বা’-র হাত ধরে বিয়ের পর দর্শকদেরই পাল্টা উপহার রণবীরের

সুজয়প্রসাদ অভিনীত নিত্যহরি এখানে শুচিবায়ুগ্রস্ত, খিটখিটে বুড়ো নয়, যে রোজ সকালে পাপ ধুতে গঙ্গাস্নানে যাবেই আর হোটেলে গঙ্গাজল ছিটোবে। সে এখানে এক জন মধ্যযৌবনের হাউসকিপিং ম্যানেজার যার বিপন্নতাগুলো তার সেক্সুয়াল প্রেফারেন্সের কারণে এই সময়ের ঠিক সেই মানুষগুলোর মতোই, যারা নিজেদের প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে ভীত,হতাশাগ্রস্ত। অবশ্য একটা কথা বলা দরকার। চৌরঙ্গী ছবির সেই বিখ্যাত বালিশ দৃশ্যটা এখানেও আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, পাঁচতারা হোটেলে এখন হাউসকিপিং-কে একটা ফোন করলে তারা বালিশই বলুন, তোয়ালেই বলুন আর শাওয়ার জেলই বলুন, আপনাকে বিনা প্রশ্নে যত খুশি সরবরাহ করবে।

মমতাশঙ্করকে একটা নতুন মোড়কে দেখতে পাবেন দর্শক এখানে। এবং বলা বাহুল্য, মিসেস সরকার হিসেবে তিনি সার্থক। তাঁর মতো এক জন অভিনেত্রীর এখনও অনেক দেওয়ার আছে বাংলা ছবিকে। যেটা আমাকে ইমপ্রেস করতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা হল মিসেস সরকারের ড্রয়িংরুম কিংবা তার শাড়ি, সাজগোজ। গ্রুপ অব কম্পানিজের মালকিন, নামজাদা সোসালাইটের কি দেশি ব্র্যান্ডের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা? কিন্তু এই যৎসামান্য ত্রুটিগুলো এড়িয়ে শাহজাহান রিজেন্সি আপনি দেখবেন, কারণ আপনাকে এটা তো দেখতেই হবে, কী করে অঞ্জনা ভৌমিক অভিনীত সেই বিখ্যাত এয়ারহোস্টেস চরিত্রটা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে দিয়েছেন সৃজিত। আসলে প্রিন্টেড সিল্ক পরা, ঘাড় তোলা খোঁপা করা, প্রবল এটিকেটের বিমানবালিকাও তো এখন কোন আকাশে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। ঋতুপর্ণার চরিত্রটা সৃজিতের নিজস্ব সংযোজন। হোটেলের লবিতে বসে সেতার বাজিয়ে চলা এক একাকিনী যে আসলে নিজেই একটা প্রতীক। চৌরঙ্গী থেকে শাহজাহান রিজেন্সিতে পৌঁছেও সময় যে হল্ট করে না, তা যে আরও পরিবর্তনশীল ও ধাবমান, সম্ভবত তারই প্রতীক।

আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ জোজো’: রাজ চক্রবর্তী নিরাশ করেননি

অভিনয়ে এখানে উতরে গেছেন সকলেই। অঞ্জন দত্ত, পরমব্রত, আবীর, স্বস্তিকা, অনির্বাণ। তবে একটা কথা বলা দরকার, শাহজাহান রিজেন্সির প্রথম দিকের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে দৃশ্যায়নের কাজ বড্ড একমাত্রিক। প্রায় অনাধুনিক দৃশ্য ভাষা। তবে আসল কথা হল চৌরঙ্গীর শেষ আধ ঘণ্টায় যে ভাঙা হাট, সৃজিতের ছবিতেও সেই ভাঙনের সুর ধরা পড়ে, ছুঁয়ে যায়। সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।

আমাকে বেশ অনেক দিন আগে এক চেন অব হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার বলেছিলেন, ‘‘হোটেল হল এমন একটা বাড়ি যেখানে দিনের যে কোনও সময় আপনি দিন শুরু করতে পারেন।’’ আর হোটেল বাড়ির আনাচেকানাচে গল্প অনেক। শঙ্করের চৌরঙ্গী উপন্যাস নিয়ে, উত্তমের চৌরঙ্গী নিয়ে গল্প ভালবাসা বাঙালির মোহ এত সহজেই শেষ হওয়ার নয়। সেই মোহই কিছুটা নতুন করে ধরা রইল শাহজাহান রিজেন্সিতে।

(মুভি ট্রেলার থেকে টাটকা মুভি রিভিউ - রুপোলি পর্দার সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদন বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Movie Review Film Review Tollywood Celebrities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE