‘আয় খুকু আয়’-তে প্রসেনজিৎ ও দিতিপ্রিয়া।
প্রিয় বুম্বাদা,
আপনাকে এমন খোলা চিঠি দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারলাম না! আপনি আমার খুরপি দিয়ে মাটি কোপানো ছেলেবেলা! পাড়ার পুকুরে ভোর ভোর সাঁতার শেখা সদ্য কৈশোর! আদিগন্ত নীল আকাশ আর বিস্তৃত সবুজ পেরিয়ে ছুটতে থাকা যৌবন! কী করে ভুলি বলুন তো! সেই সব গ্রীষ্ম ছুটির নিঝুম দুপুর! সকালে পত্রিকার খসখস শব্দ শুনতেই, উল্টেপাল্টে দেখে নেওয়া দ্বিতীয় পাতা! দুপুরে টিভিতে আপনার ‘বই’ দেবে তো! তাড়াতাড়ি গাছপাকা আমের চাটনি দিয়ে দু’দলা ভাত মুখে দিয়েই দে ছুট! সোজা টিভির সামনে! আমি, দিদুন, ছোট মামা, বড় মামি, মিনু, মিনুর মা! কারও মুখে রা নেই! পর্দায় আপনার আবির্ভাব! প্রথমে পা দেখা যাবে! ধীরে ধীরে ক্যামেরা উঁচুতে উঠবে একটু একটু করে! আবহ গমগম! এ বার সেই সিগনেচার দৃশ্য! আপনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবেন! ঝাঁপিয়ে পড়বেন ভিলেনদের দিকে! আপনার এক ঘায়ে উল্টে পড়বে দশ জন! লাফিয়ে উঠবে মিনু! “বুম্বাদা আরও কয়েকটা ঢিসুম ঢিসুম দিয়ে দাও শয়তানগুলোকে,” মিনু গড়গড় করে বলে চলবে ছবির গল্প! ওর সব জানা। ইতিমধ্যে বার কয়েক দেখে ফেলেছে!
‘আয় খুকু আয়’ সেই শৈশব ফিরিয়ে দিল! টালির চালে শুকোতে দেওয়া বিউলির ডালের বড়ি! টবে গাঁদাফুলের চারাগাছ। ঘরের সামনে দু’ফালি ফাঁকা জমিতে শখের বাগান। মুদিখানার বাকির খাতা। আলপথ, পুরনো রাজবাড়ি পেরিয়ে স্কুলঘর! আর দাঁতে দাঁত চেপে আপনার সংলাপ নকল করা টেকো, লম্বু, খ্যাপা, রোগা পোসেনরা! ওরাই ছিল আমাদের পাড়ার হিরো! আপনি আমাদের সবাইকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন! ভিলেনদের একা হাতে দুরমুশ করে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন! ঠিক যেমন স্বপ্ন দেখত নির্মল মণ্ডল! ঠিক যে ভাবে স্বপ্ন চারিয়ে দিত তার ছোট্ট বুড়ি’র মধ্যে! বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন!
বুম্বাদা আপনি ধরে বেঁধে চন্দ্রাশিস’কে দিয়ে ছবি বানিয়েছেন! আমরা বাংলায় ‘নিরন্তরে’র মতো আকাশভর্তি ঘন কুয়াশা পেয়েছি। অতনু ঘোষের পুনর্জন্ম আপনার হাতে! শৌভিক কুণ্ডু তেমনই এক সম্ভাবনাময় আবিষ্কার!
আমার অস্বস্তি হচ্ছিল! ভীষণ অস্বস্তি! কোভিড, লকডাউনে ছারখার দু’টি বছর! চার দিকে আয়ুহীন পরিজনের হাহাকার! কোনও প্রতিফলন নেই বাংলা ছবিতে! শৌভিক সেই সময়ের দাবি নিয়ে এলেন! কিন্তু বড্ড বেশি বিষয়ের ঘনঘটা! নারী পাচার, রাজনীতির রগড়, এমএমএস, মোবাইলের ভাল-মন্দ, মফস্সলের শিল্পীর স্বপ্নহীনতা, বাবা-মেয়ের লড়াই— একসঙ্গে এত কিছু ছুঁতে গিয়ে কেমন যেন গুলিয়ে গেল! কোনওটাই ভাল করে বলা হল না! তবে আপনার প্রশ্রয় পেলে নিশ্চিত ছোটখাটো ভুলচুক তিনি শুধরে নেবেন!
বুম্বাদা, আজকাল আপনার সম্পর্কে সবচেয়ে চালু রসিকতা— “দাদা নিজের আসল মুখটা মনে আছে তো?” কী ভাবে পারেন বলুন তো! প্রত্যেকেটি চরিত্রে নিজেকে দুমড়েমুচড়ে ফেলতে! আপনার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে নির্মলের ক্ষয়! আপনি যখন দু’হাতে হবিষ্যান্ন তুলে ধরে কাক ডাকেন! চোখের সামনে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মুখ ভেসে ওঠে! দলাপাকানো কান্না চেপে রাখি বহু কষ্টে! ছবি জুড়ে আপনাকে অপূর্ব সঙ্গ দিয়ে চলেন শঙ্কর দেবনাথ! চিতার আগুন ছুঁয়ে বালির পাহাড়ে শরীর ছুড়ে দেন অন্ধ শঙ্কর! মৃত্যু ফিসফিসয়ে বলে “আর কদ্দিন? পারবে তো লড়াই জারি রাখতে?”
দিতিপ্রিয়া’কে অপূর্ব মুন্সিয়ানায় ফ্রেমবন্দি করেন ইন্দ্রনীল মুখার্জি। ঠিক যেন আপনার মেয়ে! অভিনয়ও বেশ সাবলীল! রাহুল দেব বসু বরং তুলনায় কিছুটা অপ্রতিভ! সোহিনী সেনগুপ্তের ম্যানারিজম-প্রধান অতিনাটকীয়তা মঞ্চে মানায়! পর্দায় নয়!
জানেন বুম্বাদা, ছবি শেষে নির্মলের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরলাম! ছেলেবেলার গল্প। অজ পাড়াগাঁয়ের গল্প। বাবার কাছে ফেলে আসা অসমাপ্ত ঝগড়ার গল্প! কলসির মতো গড়িয়ে চলা পরিতাপের গল্প! অন্তহীন পরিতাপ!
আপনি নিশ্চয়ই এত ক্ষণে নতুন কোনও পোশাক গলিয়ে নিয়েছেন? নতুন কোনও চরিত্র? আশা রাখি, কোনও এক সময়ে তার সঙ্গেও এমন গল্প জমে উঠবে! অন্তহীন জীবনের গল্প!
ইতি,
নির্মল মণ্ডলের মতো আপনার এক ডাই হার্ড ফ্যান!
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy