Advertisement
১০ মে ২০২৪
Review of Mahisasura Marddini

কেমন হল থিয়েটার-সিনেমার মিশেলে তৈরি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’, জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন

সিনেমার পর্দা জুড়ে একটি উঠোন, থুড়ি মঞ্চ। সেখানেই যাতায়াত করে চরিত্ররা। তার মাঝেই রূপ নেয় বর্তমান সমাজের নানা বিষয়।

কেমন হল ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’?

কেমন হল ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’? ফাইল চিত্র।

শতরূপা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৪৬
Share: Save:

শেক্সপিয়ার সেই কোন কালে লিখে গিয়েছিলেন, সারা পৃথিবীটা একটা মঞ্চ। সেই মঞ্চে আমরা এক এক জন এক একটি পুতুল। আমরা একে একে আমাদের সময় মতো সেই মঞ্চে প্রবেশ করি, বিধাতার দেওয়া বাক্য বলি এবং যথা কালে সেই মঞ্চ থেকে বিদায় নিই। রঞ্জন ঘোষ পরিচালিত ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ দেখতে দেখতে বার বার সেই কথাটাই মনে হচ্ছিল। প্রথমেই বলা দরকার, এই ছবির কোনও চরিত্রের কোনও নাম নেই। তারা এক একটি চরিত্রই। তারা পর্দার সামনে আসে, তাদের সংলাপ বলে এবং একে একে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করে। পুরো ঘটনা ঘটে কোনও এক গ্রামের এক পুরনো বনেদি বাড়ির উঠোনে। সেখানে দু’দিন পরেই ষষ্ঠী। মায়ের মূর্তি গড়া প্রায় সম্পূর্ণ।

সেই মঞ্চে প্রবেশ ঘটে চার জন কলেজের ফাইনাল বর্ষে পড়া ছেলেমেয়ের। তারা তাদের ‘ম্যাম’-এর বাড়িতে এসেছে পুজো কাটানোর জন্য। ‘ম্যাম’ দেশের প্রথম হতে-চলা নভশ্চর। আপাতত তিনি ভারতীয় বায়ুসেনার টেস্ট পাইলট। তিনি সংবেদনশীল, নারীবাদী, অন্যের দুঃখে কাতর। এর মধ্যেই খবর আসে যে, পাশের ধানক্ষেতে পাওয়া গিয়েছে এক কিশোরীর গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা দেহ। পর্দায়, থুড়ি মঞ্চে নেমে আসে স্তব্ধতা। সেই স্তব্ধতাকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে নিয়ে যায় বাড়ির পাশের আবর্জনা বিনে কুড়িয়ে পাওয়া একটি শিশুকন্যা। ম্যাম এবং ছেলেমেয়েরা শিশুকন্যাটিকে নিয়ে আসেন। তারাই তার দেখভাল করে।

ছবিতে কোনও নির্দিষ্ট গল্প নেই। টুকরো টুকরো পোস্টকার্ডে উঠে এসেছে নানা ইস্যু। দেশের মেয়েদের উপর অত্যাচার, পুরুষতান্ত্রিকতা, ধর্ষণ, এখনও জন্মের পর ফেলে দেওয়া কন্যাসন্তানের মতো ঘটনা। বা ধর্ষিতার ধর্ষকদের সুবিচার দেওয়ার বদলে যেখানে চলে ধর্মের রাজনীতি।

রঞ্জন ঘোষ পরিচালিত ছবি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ র একটি দৃশ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

রঞ্জন ঘোষ পরিচালিত ছবি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ র একটি দৃশ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু মহিষাসুর কি শুধু মূর্তিতেই আবদ্ধ? সমাজের রক্তমাংসের মহিষাসুরদের কী হবে? পরিচালক এই সব বাস্তব টুকরো ছবির সঙ্গেই মিশিয়েছেন পুরাণকে। যেখানে সেই কবে থেকেই চলে আসছে সীতার সতীত্ব প্রমাণ করার তাড়না। যেখানে সূর্পণখার নাক কেটে দেওয়া হয়। যা চুঁইয়ে পড়েছে এই মঞ্চের উপর হাঁটাচলা করা বাস্তব চরিত্রদের জীবনের ঘটনাবলির উপরও। ম্যাম এক জায়গায় বলেন, মহাত্মা গান্ধীর এ বছর ১৫০ বছর পূর্ণ হল। কিন্তু কস্তুরবা গান্ধীরও যে ১৫০ বছর হল, সে কথা মানুষ কি আদৌ মনে রেখেছেন? বা মানুষ বিনয়-বাদল-দীনেশের কথা বলেন। কিন্তু বিপ্লবী বীণা দাসকে খুন করে মৃতদেহ রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়েছিল। সে কথা এখন কত জন মনে রেখেছেন?

আছে বর্তমানের কলঙ্কিত রাজনীতিবিদও। যে কি না এক সময়ে ইউনিয়নের নেতা হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠে-ময়দানে গলা ফাটাত, সে-ই এখন বাচ্চা মেয়ে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থেকেও আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যায়। পরিচালক প্রশান্ত কিশোরের মতো একটি চরিত্র এনেছেন ছবিতে। সে বিবাহিত। কিন্তু ডেটিং সাইটে নিজের নাম লিখিয়েছে। এর মধ্যেই আসে একটি আলো-করা চরিত্র— একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্ণধার যারা বেওয়ারিশ লাশ দাহ করার দায়িত্ব পালন করে। অন্য দিকে, পরিশেষে শিশুকন্যার বেঁচে ওঠাকে কেন্দ্র করেও পরিচালক একটি আশার বার্তা রাখেন।

ছবিতে সিনেমার সঙ্গে থিয়েটারকে মিশিয়েছেন পরিচালক। সেই জন্যই বাড়ির উঠোন মঞ্চের রূপ পায়। প্রথম থেকে শেষ— এক পোশাকেই অভিনয় করে গিয়েছেন শিল্পীরা। মাত্র একটি রাতের ঘটনা উন্মোচিত হয় ছবি জুড়ে। ছবিতে সে রকম কোনও ক্লাইম্যাক্স নেই। ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ দেখতে দেখতে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মুখোমুখি’ ছবির কথা মনে পড়ে। সে ছবিতেও ছিল এ রকম থিয়েটার এবং সিনেমার মিশেল।

মাঝে মাঝে ছবির সংলাপ একটু উচ্চকিত মনে হয়। ইস্যুভিত্তিক যে ঘটনাবলী পরিচালক সংলাপের মধ্যে দিয়ে এনেছেন তা আরও একটু বিস্তৃত ভাবে দেখানো হলে বোধ হয় আরও ভাল হত। শিল্পীরা সবাই ভাল অভিনয় করেছেন। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (ম্যাম), শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (রাজনীতিবিদ), পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের (প্রশান্ত কিশোর) অভিনয় নিয়ে বলার কিছু নেই। সম্পূর্ণ গ্ল্যামার-রহিত ঋতুপর্ণাকে দেখতে বেশ সুন্দর লেগেছে। চার জন তরুণও ভাল করেছেন। ছোট্ট একটি চরিত্রে (মুসলমান নেতা-গোছের একটি চরিত্র) থিয়েটারের কৌশিক কর খুব ভাল। অতিথিশিল্পী হিসেবে সাহেব ভট্টাচার্যও ভাল । ছবির চিত্রনাট্যও রঞ্জনের। সেখানে কোনও গলদ নেই। পরিচালক যা এবং যে রকম ভাবে দেখাতে চেয়েছেন তাই দেখিয়েছেন। ছবির রঙের গ্রেডিং খুব ভাল। সঙ্গীতও পরিমিত। যেটা ছবির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, ‘মহিসাসুরমর্দ্দিনী’ রঞ্জনের সবচেয়ে পরীক্ষামূলক ছবি। তাঁর আগের ছবিগুলোর থেকে এই ছবি স্বাদে-গন্ধে-সৃজনে একেবারে আলাদা। এই প্রচেষ্টার জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE