Advertisement
E-Paper

এই ব্যোমকেশ অতি আধুনিক

গতানুগতিক পথে একেবারে হাঁটেননি। সারা ছবি জুড়ে অ্যাডভেঞ্চার করেছেন দিবাকর। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী।গতানুগতিক পথে একেবারে হাঁটেননি। সারা ছবি জুড়ে অ্যাডভেঞ্চার করেছেন দিবাকর। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী।

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৯

এই ব্যোমকেশ সবচেয়ে বেশি ঐতিহ্যঋদ্ধ, সবচেয়ে বেশি আধুনিক। দেশজ, অথচ আন্তর্জাতিক। কমিক, তবু অনেক বেশি ডার্ক। শরদিন্দুর গল্প থেকে দূরে, অথচ মেজাজ ও মনে লেখকের খুব কাছে।

সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ থেকে মঞ্জু দে-র ‘শজারুর কাঁটা’, হাল আমলে অঞ্জন দত্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষ, শৈবাল মিত্র অবধি প্রায় এক ডজন ব্যোমকেশ পর্দায় এসেছে। দিবাকর এঁদের চেয়ে আলাদা, কেন না তিনি শরদিন্দুর লেখা বিশেষ কোনও গল্প অনুসরণ করেননি। ব্যোমকেশকে নিয়ে লেখা শরদিন্দুর সাড়ে ৩২টি গল্প তিনি মিক্সারে মিশিয়ে ছেঁকে এনেছেন ধুতি, মহাযুদ্ধের কলকাতা, জাপানি বোমা, মেসবাড়ি, সহকারী অজিত, শ্যামলা সত্যবতী, তার দাদা সুকুমার অনেককেই। শেষ দৃশ্যে ভিলেন অনুকূল গুহ যে ভাবে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ান, একেবারে ব্যাটম্যান সিরিজের ‘ডার্ক নাইট রিটার্নস।’ ব্যোমকেশ হাফ-পাগলের মতো হ়ড়বড়িয়ে কথা বলে, অজিতের হাতে মার খায়। রবার্ট ডাউনি জুনিয়ারের শার্লক হোম্সও তো এ রকমই। লক নেসের দানব, ঠান্ডা যুদ্ধের আন্তর্জাতিক গুপ্তচরচক্র সব কিছু নিয়ে, বিলি ওয়াইল্ডারের মতো দুঁদে পরিচালকও কি তৈরি করেননি তাঁর নিজস্ব শার্লক হোম্স? দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আন্তর্জাতিকতার উত্তরসূরি।

এই আন্তর্জাতিকতা কলকাতার লুপ্ত বিষাদ। তার চরিত্রে একদা এটি ছিল। ছবির শুরু ১৯৪১ সালে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ত্রস্ত কলকাতায়। চিনে আফিং স্মাগলিং-এর একটি দৃশ্য আসে। ক্রমে বোঝা যায়, কলকাতা, মায়ানমার, চিন জু়ড়ে বিস্তৃত এক স্মাগলিং নেটওয়ার্কের কথা। শরদিন্দুর গল্পে এই জাতীয় গ্যাং-এর কথা ছিল না। কিন্তু কলকাতার তৎকালীন মেট্রোপলিটন জীবন? মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাত খাওয়ার চাল আসে তৎকালীন বার্মা থেকে। বাংলা, বিহার জু়ড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বহু আগে শুরু করেছিল আফিং-এর চাষ। সেই আফিং মুম্বই হয়ে পা়ড়ি দিত চিনে। চিন সেই সময় জাপানি আক্রমণে বিধ্বস্ত, শরদিন্দু না লিখলেও রেঙ্গুন, চিন হয়ে আফিং-এর চোরাচালানের কাহিনি ছড়িয়ে আছে নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কালো ভ্রমর’ ও অনেক গল্পে।

যুদ্ধত্রস্ত এই কলকাতার কথা মনে রেখেই নিকোস আন্দ্রিতসাকিসের সিনেমাটোগ্রাফিতে পুরো ছবি জুড়ে লো লাইট। বিষণ্ণ লালচে সিপিয়া টেক্সচার। মাঝে মাঝে বেজে ওঠে সাইরেন। সাবাস! সেই সময়ের কলকাতা মানেই ঠুলি পরানো আলো, ব্ল্যাক আউট, এয়ার রেডের সাইরেন। দিবাকর ও উর্মি জুভেকরের চিত্রনাট্যে এক বারও দেখা দেয়নি ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা বিয়াল্লিশের মন্বন্তর। এই কলকাতার প্রেক্ষিতেই চিত্রনাট্য তখন তৈরি করতে চায় রহস্যময় গথাম নগরী।

এই নগরীতে ইতিহাস আসে দূরাগত ইশারায়। সত্যবতী ব্যোমকেশের মেসে এসেছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে হাল্কা সুরে ‘ফ্যান দাও গো মা।’ সত্যবতীদের প্রেমিকের মেসে আসার সাহস ছিল কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে সবাই ‘সা়ড়ে চুয়াত্তর’ ছবির ঢঙে গোল্লা গোল্লা চোখে তাকায়, তৈরি হয় কমিক সিচুয়েশন। ইতিহাসের বাস্তবতা আর সিনেমার বাস্তবতা আলাদা।

ছবির আর এক উল্লেখ্য সংযোজন, আঙুরীর চরিত্রে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। শরদিন্দুর গল্পে এই জাতীয় কোনও সেক্সি সিডাকট্রেস ছিল না। আর স্বস্তিকা সারা ছবিতে সাদা রঙে। হেমেন মজুমদারের নারীরাও কি আবেদন জানাতেন না এমনই সিক্ত শুভ্রতায়? সেক্সি সাইরেনদের এই শহর হেলেন, বিন্দুর বহু আগে থেকে চেনে। বিশ শতকের শুরুতে পাঁচকড়ি দে-র গোয়েন্দা উপন্যাসে খলনায়িকা জুমেলিয়া প্রেমিককে খুন করে ‘মদ্যপূর্ণ’ বোতল শেষ করে এক কলকে গাঁজা ফুঁকে দেয়, তাতেও নেশা জমে না। তখন এক বাটি সিদ্ধি খেয়ে সে টোড়ি রাগ গাইতে থাকে। ব্যোমকেশ বক্সিই একমাত্র ধুতি-পরা গোয়েন্দা নন। তাঁর জন্মের ঢের আগে পাঁচকড়ি দে-র গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় ধুতি পরতেন, সুন্দরী খলনায়িকাদের খপ্পরেও বন্দি হতেন। স্বস্তিকা সেই লুপ্ত ঐতিহ্যই ফের মনে পড়িয়েছেন।

চমৎকার করেছেন অজিত চরিত্রে আনন্দ তিওয়ারি। এই অজিত ব্যোমকেশের ল্যাংবোট নয়, মাথা গরম। দুম করে ব্যোমকেশকে মেরে বসে। ব্যোমকেশকে চলন্ত গাড়ির সামনে থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। অজিতের নিখোঁজ বাবা সম্বন্ধে ব্যোমকেশ কখনও ভাবে, ভদ্রলোক দুশ্চরিত্র ছিলেন। কখনও বা ভাবে, তিনি জিনিয়াস কেমিস্ট। সব মিলিয়ে, ব্যোমকেশ বক্সিকে নিয়ে অজিত কনফিউজ্ড। নীরজ কবির অনুকূল গুহ মনে রাখার মতো। এই অনুকূল গুহ সামনে মেস ম্যানেজার, আড়ালে বিপ্লবী। এবং ভিতরে ভিতরে ড্রাগ ডিলার, হেরোইনের চোরাকারবারি। ব্যোমকেশ ছাদে সকলের সামনে বলে, ‘যাকে নেতা ভাবছ, দেশপ্রেমিক ভাবছ, সে আসলে নিজের হেরোইন বেচার সাম্রাজ্য তৈরি করতে চায়।’ জাপানিরা শুধুই বোমা ফেলতে কলকাতায় হানা দেবে না, গঙ্গার ধারে লুকিয়ে রাখা আছে চিনা স্মাগলারদের কোকেন। মানচিত্র দেখে সেখানে হানা দেবে তারা। জাদু-বাস্তবতার ঢঙে এ ভাবেই অতীত-বর্তমান মিশিয়ে দিবাকর তৈরি করেন তাঁর ডার্ক ফ্যান্টাসির বয়ান।

আর সুশান্ত সিংহ রাজপুত? চমৎকার লেগেছে। উত্তমকুমার না আবীর না সুশান্ত কে ব্যোমকেশ হিসাবে ভাল, সেই আলোচনা নিস্প্রয়োজন। বেনেডিক্ট কুম্বারবাচ যখন বিবিসির সিরিজে বিভিন্ন গ্যাজেট নিয়ে আধুনিক শার্লক হোম্স হয়ে ওঠেন, আমরা কি আলোচনা করি, তিনি ভাল না খারাপ? নতুন বয়ানটি দেখতে অন্য রকম লাগে, এই যা!

সুশান্ত সিংহ রাজপুতের সেই বয়ান তৈরিতে ভুল নেই। কিন্তু পরিচালকের কিছু ভুল রয়ে গিয়েছে। সারা ছবির সংলাপে ‘ইয়াঙ্গন’। তখন রেঙ্গুন বলা হত। ব্যোমকেশরা চায়ের সঙ্গে আলুভাজা খাবে কেন? অম্বল অনিবার্য। হাওড়া ব্রিজ ১৯৪৩ সালে খুলে দেওয়া হয়, ’৪২ সালে কলকাতার রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল না। দেশপ্রেম মানে এক বাড়িতে কয়েক জনের আন্তঃপার্টি সংগ্রাম মার্কা বকবক। ত্রুটিগুলি না থাকলে লেটার মার্কস দেওয়া যেত।

শেষ কথা একটাই। শরদিন্দুর গল্প নিয়ে ‘ডার্ক নাইট’ তৈরি চমৎকার লাগছে। শরদিন্দু নিজে তন্ত্রমন্ত্র, কোষ্ঠী, অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতেন। বরদা নামে এক তান্ত্রিককে নিয়ে কিছু গল্পও লিখেছিলেন। যিনি ‘প্রিজনার অব জেন্ডা’ থেকে ‘ঝিন্দের বন্দি’ লেখেন, তিনি নিজে যে এই ছবিটা উপভোগ করতেন, সন্দেহ নেই!

আগেই বলেছিলাম, এই ছবি শরদিন্দুর গল্প থেকে দূরে, কিন্তু তাঁর মেজাজের কাছে!

Detective Byomkesh Bakshi Dibakar Bandopadhyay Sushant Singh Rajput Swastika Mukhopadhyay Satyajit Ray Gautam Chakroborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy